৫২টি ম্যারাথনে দৌড়ানো ৯৩ বছর বয়সী মানুষটির কাছে জানুন বয়স বাড়লেও কীভাবে শরীর ভালো রাখতে হয়

বন্ধুদের মতে, জন স্টারব্রুক কিংবদন্তিতুল্য। নিয়মিত ব্যায়াম ও উদ্দীপনা মানুষকে কতটা তারুণ্যদীপ্ত রাখতে পারে, তার এক জলজ্যান্ত উদাহরণ তিনি। ব্রিটিশ দৈনিক ‘দ্য গার্ডিয়ান’-এর সাংবাদিক ফিল ডাউস্ট তাঁর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার চেষ্টা করেছিলেন কয়েক দিন। ডাউস্টের মতে, ‘কোনোরকমে টিকে থাকতে পেরেছি।’ জন স্টারব্রুকের সঙ্গে তিনি পানিতে নেমেছিলেন ওয়াটার পোলো খেলতে। সেই খেলার অভিজ্ঞতা আর স্টারব্রুকের অসাধারণ প্রাণশক্তির বর্ণনা জানা যাক তাঁর লেখাতেই।

সব মিলিয়ে মোট ৫২টি ম্যারাথনে অংশ নিয়েছেন স্টারব্রুকছবি: ইনস্টাগ্রাম থেকে

নিজেকে একজন শক্তিমান সাঁতারু ভাবতেই পছন্দ করি। আমি দ্রুতগতির নই, ডাইভ দিতে পারি না বা টাম্বল টার্ন (পানিতে উল্টো হয়ে ঘুরে আসা) করতে পারি না, তবে জুত করতে পারলে আনন্দের সঙ্গে ৫০-৬০ লেন্থ পাড়ি দিতে পারি। বড় ও সুন্দর একটা হ্রদ পেলে ব্যাকস্ট্রোক সাঁতার দিতে দিতে হ্রদের মাঝখানে চলে যাব। ওই লেকের পানিই হবে আমার স্বর্গ। হঠাৎ করে কোনো ব্যথা অনুভব করা বা ভাসতে ভুলে যাওয়ার কোনো ভয়ই মনে আসবে না। কিন্তু ওয়াটার পোলো খেলার কথা কোনো দিন চিন্তাও করিনি। ওয়াটার পোলো হচ্ছে সাঁতার, বাস্কেটবল ও কুস্তির সমন্বয়ে এক খেলা। ৬০ বছর বয়সে এসব তারুণ্যের খেলায় অংশ নেওয়ার কথা ভাবতেও পারি না।

দক্ষিণ-পশ্চিম লন্ডনের ওয়াটার পোলা ক্লাব ‘হ্যাম্পটন পুল’-এর সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ খেলোয়াড় ৯৩ বছর বয়সী জন স্টারব্রুক। ৮০ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন সাঁতারু তিনি। যৌবনে জাতীয় সাঁতার চ্যাম্পিয়নশিপে বাটারফ্লাই স্টাইলে সাঁতরাতেন। কোনো পুরস্কার-টুরস্কার না পেলেও সাঁতারের প্রতি ভালোবাসা অটুট থেকেছে সব সময়। নিজের ৮০তম জন্মদিন তিনি পালন করেছিলেন এক মাইল সাঁতরে। এখনো সপ্তাহে তিন দিন সাঁতরান। সুযোগ পেলেই চলে যান জিমে।

লন্ডনের ওয়াটার পোলা ক্লাব ‘হ্যাম্পটন পুল’-এর সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ খেলোয়াড় ৯৩ বছর বয়সী জন স্টারব্রুক
ছবি: হ্যাম্পটন পুল

মিডলসেক্সে নিজের বাড়ির কাছে ‘টেমস ক্লাব’ নামের একটি স্পোর্টস সেন্টারের সদস্য জন স্টারব্রুক। এলাকার ছেলে-বুড়ো সবার কাছেই প্রিয় ‘দ্য লিজেন্ড’ নামে। ৬২ বছর বয়সী স্ত্রী যখন কাছে থাকেন না, তখন বেশির ভাগ সময়ই স্টারব্রুক চলে যান জিমে। আমার সঙ্গে কফি খেতে খেতে স্টারব্রুক বললেন, ‘স্পিন ক্লাস (ইনডোর সাইক্লিং) আমাকে উজ্জীবিত করে। বিকেল চারটা থেকে পাঁচটার দিকে আমি আবার শরীরের উপরিভাগের ব্যায়াম শুরু করি।’

স্টারব্রুক নিয়মিত দৌড়ানো শুরু করেছিলেন ৫৩ বছর বয়সে। ইংল্যান্ড থেকে ডেনমার্ক হয়ে বার্বাডোজ পর্যন্ত সব মিলিয়ে মোট ৫২টি ম্যারাথনে অংশ নিয়েছেন। তাঁর দ্রুততম ম্যারাথনটির দৈর্ঘ্য ছিল ৪ ঘণ্টা ১৪ মিনিট। সেটা ২০-২৫ বছর আগের কথা। চার ঘণ্টার ওই দৌড় দেওয়ার পর স্টারব্রুক প্রায়ই মজা করে বলেন, ‘সেদিন আমাকে একটা ভেড়া তাড়া করেছিল।’

এখন পর্যন্ত স্টারব্রুকের সর্বশেষ ম্যারাথনটি ছিল ২০১৯ সালে। সেবার দৌড়েছিলেন ২৬ মাইল। তখন তাঁর বয়স ছিল ৮৮ বছর। প্যারাস্যুট নিয়ে লাফ দিয়েছেন কয়েকবার, ট্রায়াথলনেও অংশ নিয়েছেন। জন স্টারব্রুক ‘এজ ইউকে’ নামক একটি দাতব্য সংস্থার প্রতিনিধি। সংস্থাটি বয়সীদের জন্য বেশ কিছু জিম পরিচালনা করে। এই সংস্থার জন্য তিনি ৫০ হাজার পাউন্ডের অনুদান সংগ্রহ করেছিলেন।

স্টারব্রুক বলেন, ‘অনেকেই মনে করেন, বয়স ৫০ হয়ে যাওয়া মানেই বুড়ো হয়ে যাওয়া। আমাকেও অনেকেই এ কথা বলেন। তবে এটা বুঝি না, তাঁরা এমনটা কেন মনে করেন!’ স্টারব্রুকের নাতনি ইয়ার্না তাঁর সঙ্গেই লন্ডন ম্যারাথনে অংশ নিয়েছিলেন। নাতনিকে অনুপ্রাণিত করতে পারলেও স্টারব্রুকের নিজের ছেলে বাবার দৌড়াদৌড়িতে খানিকটা চিন্তিত। স্টারব্রুক যখন কোথাও যাওয়ার জন্য হনহন করে রাস্তা দিয়ে হাঁটেন, ছেলে তখন বলেন, ‘একটা বাসে উঠে পড়লেই তো হয়!’ ১৫ বছর আগের স্মৃতি রোমন্থন করে স্টারব্রুক বলেন, চিকিৎসক তাঁকে বলেছিলেন, আর দৌড়াদৌড়ি করা যাবে না। কিন্তু সেই পরামর্শকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তারপর তিনি আরও ১৫টি ম্যারাথনে অংশ নিয়েছেন!

স্টারব্রুক শুধু হ্যাম্পটন পুলেরই সবচেয়ে বয়সী খেলোয়াড় নন, পুরো ইংল্যান্ডে সবচেয়ে বয়সী ওয়াটার পোলো খেলোয়াড়। আমাদের খেলার রেফারি ছিলেন অ্যালান ক্যামিজ নামের একজন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্তা। ক্যামিজের মতে, স্টারব্রুক অসাধারণ খেলোয়াড় এবং নিয়মিত স্কোর করেন।

স্টারব্রুককে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘কীভাবে এখনো ফিটনেস ধরে রেখেছেন?’

উত্তরে তিনি বলেন, ‘বিশেষ কিছু করি না। কখনো খুব একটা মদ্যপান বা ধূমপান করিনি। সকালে পরিজ দিয়ে নাশতা করি। প্রচুর সবজি খাই। ভাজাপোড়া কম খাই। আর আমার ফিটনেস কিছুটা জিনগত মনে হয় আমার কাছে।’

যদি স্টারব্রুকের তারুণ্য সত্যিই জিনগত হয়ে থাকে, তাহলে সম্ভবত তিনি তাঁর মায়ের জিন পেয়েছেন। পাঁচ বছর বয়সে তিনি নিউমোনিয়ায় বাবাকে হারিয়েছিলেন। ত্রিশের দশকে তাঁর মা চরম অর্থকষ্টের মধ্যে তিন সন্তানকে বড় করেছেন।

৯৩ বছর বয়সী জন স্টারব্রুক আজও ফিট
ছবি: ইনস্টাগ্রাম থেকে

স্টারব্রুকের ছোট ভাই ডেভিড ১৯৭২ এবং ১৯৭৬ সালের অলিম্পিকসে জুডোতে রুপা এবং ব্রোঞ্জপদক জিতেছেন। বর্তমানে তাঁর বয়স ৭৮ বছর, জুডোর কোচ হিসেবে কর্মরত।

স্টারব্রুক জীবনের পয়লা চাকরিটা নিয়েছিলেন ‘ইউনাইটেড ডেইরিজ’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানে, ১৯৪৫ সালে। যুবকেরা তখন সেনাবাহিনীতে। স্টারব্রুকের মতো কিশোরেরা তখন বাড়ি বাড়ি দৌড়ে দুধ সরবরাহ করত। এই চাকরিও তাঁকে ফিট থাকতে সাহায্য করেছে বলে মনে করেন স্টারব্রুক।

পরবর্তী সময়ে স্টারব্রুক সেনাবাহিনীর মেডিকেল কর্পে যোগ দেন। সেখানে তাঁর সুপারভাইজার ছিলেন পানির পোকা, সাঁতারের ওস্তাদ। সেনাবাহিনীতে থাকাকালে স্টারব্রুক বিভিন্ন সাঁতার প্রতিযোগিতায় নাম লেখাতেন। ওই চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন ২৮ বছর আগে। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি তিন সন্তানের জনক। সন্তানদের লালন-পালনের পাশাপাশি একটি পাওয়ার প্ল্যান্টের নির্মাণকাজে অংশ নিয়েছেন, বিভিন্ন দোকানে কাজ করেছেন, ২৫ বছর ধরে হিথরোর বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ডিম সরবরাহ করেছেন। স্টারব্রুক বলেন, ‘কাজ থেকে অবসর নেওয়ার এত দিন পরও অনেকে আমাকে “জন দ্য এগ” বলে ডাকে।’

‘কত দিন বাঁচবেন বলে ধারণা করেন?’ এ প্রশ্নের উত্তরে স্টারব্রুক বলেন, ‘কত দিন বাঁচব, তা নিয়ে মাথাব্যথা নেই। যত দিন কোনো কষ্ট না হচ্ছে, তত দিন বাঁচতে চাই।’

সামান্য ব্যথা-বেদনা বাদ দিলে স্টারব্রুক ভালোই আছেন। তাঁর বাঁ পায়ে কিছুটা আর্থ্রাইটিস দেখা দিয়েছে। এ কারণে মাঝেমধ্যে তাঁর স্পিন ক্লাস কামাই করতে হয়। অনিয়মিত হৃৎস্পন্দনের জন্য ব্লাড থিনারও গ্রহণ করেন।

স্টারব্রুকের সঙ্গে কথোপকথনের কদিন পর তাঁর সঙ্গে ওয়াটার পোলো খেলতে নেমেছিলাম আমি। ৪০ মিনিটে মাত্র দুবার বল ছুঁতে পেরেছিলাম। মাঝেমধ্যে ভুলেই যাচ্ছিলাম আমি কোন দলে! স্টারব্রুক সাদা দলে খেলছিলেন। আমি ছিলাম নীল দলে। শুধু আমাদের মাথার টুপিগুলো দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, কে কোন দলে। কিন্তু আমি তো আমার মাথার টুপি দেখতে পাচ্ছিলাম না!

২০১৮ সালে স্টারব্রুক সবচেয়ে বয়সী প্রতিযোগী হিসেবে অংশ নিয়েছিলেন ৩২তম লন্ডন ম্যারাথনে
ছবি: ইনস্টাগ্রাম থেকে

তবু আমার সময়টা ভালো কেটেছে। কিছুক্ষণ পরপর বলের পেছনে ছুটছিলাম। কিন্তু বুঝতে পারছিলাম না, বলটা আমি কী করব। বল যখন আমাদের গোলের দিকে এগিয়ে আসছিল, তখন মরিয়া হয়ে বলটিকে লক্ষ্যচ্যুত করার জন্য হাত তুলছিলাম। শুধু সবার পথে বাধা সৃষ্টি করছিলাম আরকি! গোলকিপারের দৃষ্টিসীমাকে বাধাগ্রস্ত করছিলাম। মনে হচ্ছিল, নীল দল আমাকে নিজেদের দলে নিয়ে নিজেরাই যেন ঝামেলায় পড়ে গেছেন। তবে এই তেতো সত্যটা কেউ আমার মুখের ওপর বলেননি।

আদতে স্টারব্রুকের সদা হাস্যোজ্জ্বল মুখ আমাকে খুশি থাকতে অনেকটাই সাহায্য করেছিল। স্টারব্রুক বলেছিলেন, ‘কোনো কিছুই আমাকে বিচলিত করে না। আমার স্ত্রী বলে, আমি সব সময় ফুর্তিতে থাকি।’

স্টারব্রুককে অন্য খেলোয়াড়েরা ডাকেন ‘গোল হ্যাঙ্গার’ বলে। তিনি আমাদের আর সবার মতো শুধু পানির মধ্যে হন্তদন্ত হয়ে ঘুরপাক খাচ্ছিলেন না। বরং প্রতিপক্ষের গোলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখছিলেন। সুযোগ খুঁজছিলেন প্রতিপক্ষের জালে সজোরে বল নিক্ষেপ করার।

খেলা শেষ করে যখন আমরা পোশাক বদল করছিলাম, তখন একজন খেলোয়াড় জিজ্ঞেস করলেন, ‘খেলতে ভালো লেগেছে? আরও খেলবে?’ উত্তর দিতে আমার বেশি চিন্তা করতে হয়নি, ‘হ্যাঁ, ভালো লেগেছে। আবার খেলব।’

মূল: ফিল ডাউস্ট

ভাষান্তর: আলিয়া রিফাত