যেসব ভুলে খাবারে মিশে যাচ্ছে ক্ষতিকর প্লাস্টিককণা

প্লাস্টিকে সংরক্ষিত খাবারে মাইক্রোপ্লাস্টিক থাকবে, এটা অবধারিত
ছবি: পেক্সেলস

আমাদের চারপাশেই ছড়িয়ে আছে প্লাস্টিকের বহু উৎস। রান্নার পাত্র, পানির বোতল, চা-কফির কাপ, পণ্যের মোড়ক—কোথায় নেই প্লাস্টিক? এগুলো থেকে প্রতিনিয়ত আমাদের খাবারে মিশে যাচ্ছে প্লাস্টিক।

ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয় ও সিয়াটল চিলড্রেনস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের শিশুবিশেষজ্ঞ এবং পরিবেশগত ও পেশাগত স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক শীলা সত্যনারায়ণ বলেন, প্লাস্টিক থেকে মুক্ত থাকার ব্যাপারটি কঠিন মনে হলেও এর কোনো বিকল্প নেই। ধীরে ধীরে প্রতিদিনকার জীবনযাপনে প্লাস্টিকের ব্যবহার কমিয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।

আরও পড়ুন
খাবার প্লাস্টিকের ব্যাগে মোড়কজাত করা ঠিক নয়
ছবি: পেক্সেলস

খাবারের মোড়ক ও খাবারের পাত্র

প্লাস্টিকে সংরক্ষিত খাবারে মাইক্রোপ্লাস্টিক থাকবে, এটা অবধারিত। প্লাস্টিকের এই প্যাকেটগুলো খোলার সময় মাইক্রোপ্লাস্টিকের এক রকম বিস্ফোরণ ঘটে। গবেষণা বলছে, কাঁচি, হাত, ছুরি কিংবা ঢাকনা ঘুরিয়ে যেভাবেই আমরা প্লাস্টিকের প্যাকেট খুলি না কেন, প্রতি সেন্টিমিটারে তৈরি হয় প্রায় আড়াই শ মাইক্রোপ্লাস্টিক। আবার প্লাস্টিকের পাত্র, এমনকি মেলামাইন, সিলিকন যত পুরোনো হতে থাকে, সেটা থেকে মাইক্রোপ্লাস্টিক ছড়ানোর পরিমাণ তত বাড়তে থাকে। খাবার অল্প সময়ের জন্য প্লাস্টিকের পাত্রে রাখলেও দূষণের আশঙ্কা রয়েছে।

খাবার

ফল, শাকসবজি, মধু, রুটি, দুগ্ধজাত দ্রব্য, মাছ ও মাংস থেকে শুরু করে লবণে পর্যন্ত মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। ডিমের সাদা অংশ ভেদ করে কুসুমেও পৌঁছে গেছে মাইক্রোপ্লাস্টিক। সমুদ্র ও খনি দূষণ এবং প্রক্রিয়াজাতকরণের সময় নানাভাবে লবণের সঙ্গেও মিশে যাচ্ছে প্লাস্টিকের সূক্ষ্ম কণা।

এক গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৯০ সালের চেয়ে ৬ গুণ বেশি প্লাস্টিক ২০১৮ সালের মানুষের শরীরে ঢুকেছে। শিল্প এলাকায় চাষাবাদ করা ফসলে মাইক্রোপ্লাস্টিক ঢুকে পড়ছে। আবার ফসল প্রক্রিয়াজাতকরণের সময়ও এসব ক্ষতিকর পদার্থ মিশে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। পরিবেশদূষণের প্রভাবে ও খাদ্যের মাধ্যমে প্রাণিদেহেও ঢুকছে প্লাস্টিক। আমরা যখন এসব উদ্ভিদ ও প্রাণী খাবার হিসেবে গ্রহণ করছি, তখন এই প্লাস্টিকের কণাগুলো আমাদের শরীরেও প্রবেশ করছে।

তবে গবেষকেরা দেখেছেন, চাল ধুয়ে রান্নার কারণে মাইক্রোপ্লাস্টিকের পরিমাণ ২০ থেকে ৪০ শতাংশ কমে যায়। মাছ-মাংস ভালোভাবে ধুয়ে নিলেও সূক্ষ্ম প্লাস্টিকের এসব কণার পরিমাণ অনেকটাই কমে আসে। এ ক্ষেত্রে প্লাস্টিকের মোড়কজাত ও প্রক্রিয়াজাত খাবার বাদ দিয়ে তাজা খাবার খাওয়ার কথা বলেন বিশেষজ্ঞরা। একই সঙ্গে রান্নাঘরে ও দৈনন্দিন ব্যবহারে প্লাস্টিকের পণ্য কমিয়ে আনার পরামর্শ দেন তাঁরা। বিশ্বব্যাপী পরিবেশে প্লাস্টিকের দূষণ যদি ৯০ শতাংশ কমিয়ে আনা যায়, তাহলে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোতে প্লাস্টিক গ্রহণের মাত্রা অর্ধেকে নামিয়ে আনা সম্ভব।

আরও পড়ুন
প্লাস্টিকের বোতলে প্রতি লিটার পানিতে প্রায় ৫৫৩টি মাইক্রোপ্লাস্টিক তৈরি হয়
ছবি: পেক্সেলস

পানি

ট্যাপ থেকে হোক বা বোতল, মাইক্রোপ্লাস্টিকের সংস্পর্শে আসার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উৎপাদন হলো পানি। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, প্লাস্টিকের বোতলে প্রতিবার খোলা–বন্ধের ঘটনায় প্রতি লিটার পানিতে প্রায় ৫৫৩টি মাইক্রোপ্লাস্টিক তৈরি হয়। যুক্তরাজ্যের একটি গবেষণায় ১৭৭টি ট্যাপের পানির নমুনার প্রতিটিতেই প্লাস্টিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। চীন, ইউরোপ, জাপান, সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্রে অনুসন্ধানের ফলাফলও একই রকম। বলতে গেলে মাইক্রোপ্লাস্টিক এখন একটি বৈশ্বিক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ক্ষেত্রে পানির ফিল্টার ব্যবহার একটি সমাধান হতে পারে। ভালো ফিল্টার ও পানির পাত্র কমাতে পারে প্লাস্টিক গ্রহণের মাত্রা।

রান্নাঘরে বাসনপত্র

কাটাকুটির জন্য এখন ঘরে ঘরেই ব্যবহার হয়ে থাকে প্লাস্টিকের চপিং বোর্ড। এর প্রতিটি স্লাইসে বের হতে পারে আনুমানিক ১০০ থেকে ৩০০টি মাইক্রোপ্লাস্টিক। ২০২২ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাতে একটি গবেষণায় সুপার মার্কেটে প্লাস্টিকের চপিং বোর্ডে কাটা মাংসের ভেতর মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া যায়। গবেষকেরা জানান, তিন মিনিট ধরে ভালোভাবে ধোয়ার পর মাইক্রোপ্লাস্টিকের পরিমাণ কমলেও মাংস থেকে তা পুরোপুরি দূর হয়নি।

দাগ বা আঁচড় পড়া নন-স্টিক রান্নার পাত্র থেকে প্রতিবার ব্যবহারে হাজার থেকে লাখ লাখ প্লাস্টিকের কণা নির্গত হয়। প্লাস্টিকের ব্লেন্ডারে তীব্র ঘর্ষণে তৈরি হয় অসংখ্য মাইক্রোপ্লাস্টিক। প্লাস্টিকের পাত্রের নিরাপদ বিকল্প হিসেবে অনেকে সিলিকন সুপারিশ করলেও এটা থেকে কম মাইক্রোপ্লাস্টিক উৎপন্ন হয়, এমন কোনো প্রমাণ নেই। বরং এ ক্ষেত্রে প্লাস্টিকের পাত্রের বদলে কাচ বা স্টেইনলেস স্টিলের পাত্রে খাবার সংরক্ষণ করা হলে তা প্লাস্টিকের মাত্রা কমিয়ে আনতে পারে।

তাপ

প্লাস্টিক যত বেশি উত্তপ্ত হয়, তত বেশি এর থেকে মাইক্রোপ্লাস্টিক তৈরি হওয়ার প্রবণতা বাড়ে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, মাইক্রোওয়েভে তিন মিনিট গরম করা প্লাস্টিকের পাত্র থেকে প্রতি বর্গসেন্টিমিটারে ৪২ লাখ ২০ হাজার মাইক্রোপ্লাস্টিক তৈরি হয়। ডিসপোজেবল প্লাস্টিকের কাপে গরম পানীয় রাখলে প্লাস্টিকের কণা তার সঙ্গে মিশে যায়। অতিরিক্ত ঠান্ডা যেমন রেফ্রিজারেটরে প্লাস্টিকের পাত্র রাখলেও সেখান থেকে লাখ লাখ মাইক্রোপ্লাস্টিক উৎপন্ন হতে পারে। লবণ, চর্বি বা ফ্যাট, অ্যাসিড ও তাপ—এই চারটি উপাদান প্লাস্টিককে দ্রুত মাইক্রোপ্লাস্টিকে ভেঙে ফেলতে পারে।

রান্নাঘরে প্লাস্টিকের ব্যবহার্য জিনিস বাতিল হলে কাচ, স্টেইনলেস স্টিল বা ক্ষতিকর নয়, এমন জিনিস ব্যবহার করতে হবে
ছবি: পেক্সেলস

পরিষ্কার করার সময়

বাসন মাজার সময় আমরা যে প্লাস্টিকের মাজুনি ও স্পঞ্জ ব্যবহার করি, সেখান থেকেও প্রচুর মাইক্রোপ্লাস্টিক উৎপন্ন হয়। পুরোনো মাজুনি থেকে প্রতি গ্রামে ৬৫ লাখ পর্যন্ত মাইক্রোপ্লাস্টিক ছড়িয়ে যেতে পারে। স্পঞ্জে ডিটারজেন্ট বা ডিসওয়াশার ব্যবহারের সময় এর মাত্রা আরও বৃদ্ধি পায়।

প্লাস্টিকভর্তি রান্নাঘরের জন্য কী ব্যবস্থা

আমাদের রান্নাঘরে ও নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্রের মধ্যে এত প্লাস্টিকের সামগ্রী রয়েছে যে একনিমেষেই সব কটি দূর করে দেওয়া সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে সমাধান হলো আস্তে আস্তে প্লাস্টিকের জিনিসপত্রের পরিমাণ কমিয়ে আনা। যখন প্লাস্টিকের কোনো ব্যবহার্য জিনিস পুরোনো বা বাতিল হবে, তখন তার পরিবর্তে কাচ, স্টেইনলেস স্টিল বা ক্ষতিকর নয়, এমন উপাদানে তৈরি জিনিস ব্যবহার করতে হবে।

সূত্র: বিবিসি

আরও পড়ুন