কিশোরগঞ্জের এই কলেজের ৪৫ ভাগ শিক্ষার্থীই ভিনদেশি

জহুরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের পরিবেশ শিক্ষার্থীদের মন ভালো করে দেয়
ছবি: প্রথম আলো

ক্যাম্পাসের গাছগুলোর ছায়ায় দাঁড়িয়ে কী যেন গল্প করছিলেন দুজন। একজন ভারতের আসামের তরুণ আবু মো. সুফিয়ান। অন্যজন ত্রিপুরার অনুরাগ পাল। এগিয়ে গিয়ে পরিচিত হলাম। আলাপ করে বেশ লাগল। চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে এক বছর আগে বাংলাদেশে এসেছেন তাঁরা। কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরে অবস্থিত জহুরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েছেন। ভর্তি হওয়ার আগে অবশ্য শুধু কলেজের নাম, ছবি আর কল্পনায় থাকা কিছু দৃশ্য—এই ছিল সম্বল।

কল্পনা আর বাস্তবে মিল হলো কতখানি?

প্রশ্ন শুনে হেসে ফেললেন দুজন। সুফিয়ানের ভাষ্য, কল্পনার চেয়েও বেশি কিছু পেয়েছেন তিনি। আর অনুরাগ পালের কাছে ক্যাম্পাসের সবুজের সমারোহটাই সবচেয়ে প্রিয়।

চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী নেপালের আশিস পাডেলের অনুভূতি অবশ্য একটু আলাদা। হয়তো এখানে অনেকটা সময় কাটিয়ে ফেলেছেন বলেই। তাঁর কাছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি এখন নিজের ঘরের মতো। বলছিলেন, ‘প্রয়োজনীয় ভবনগুলো ছাড়া পুরো এলাকাটাই সবুজে ঢাকা। প্রবাসে এত সবুজের মধ্যে শিক্ষাজীবনের চ্যালেঞ্জের দিনগুলো কাটবে, কল্পনায় ছিল না। এখন এই সবুজই আসলে স্বপ্ন বোনার কঠিন দিনগুলোতে মন ভালো করে দেবে।’

নিয়মিত ক্লাস, পরীক্ষা, মেধাবী শিক্ষকদের কাছ থেকে তাঁদের অভিজ্ঞতার ভাগ নেওয়ার সুযোগ—এসবই কলেজটাকে আলাদা করেছে। দাবি করলেন জহুরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের বাংলাদেশি শিক্ষার্থী মাহির মুনতাছির ও ভারতের কাশ্মীরের ইশাদ ফারুক। চতুর্থ বর্ষে পড়ছেন দুজন।

বর্তমানে এখানে পড়ছেন ৫০২ জন শিক্ষার্থী। প্রতিবছর প্রতিষ্ঠানটিতে ভর্তির সুযোগ পায় ১০০ শিক্ষার্থী। এই সংখ্যার ৪৫ শতাংশ দেশের বাইরের। ভারতের কাশ্মীর ও নেপালের শিক্ষার্থীই বেশি। বাকিরা ভারতের আসাম, ত্রিপুরা, মিজোরাম রাজ্য থেকে আসা।

বর্তমানে এখানে পড়ছেন ৫০২ জন শিক্ষার্থী
ছবি: প্রথম আলো

যেভাবে যাত্রা শুরু

ঢাকা থেকে প্রায় ১১০ কিলোমিটার দূরের উপজেলা শহর কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর। এই বাজিতপুরেরই ভাগলপুর এলাকায় জন্মেছিলেন শিল্পপতি জহুরুল ইসলাম। তাঁর উদ্যোগেই ৩৫ বছর আগে ১৯৮৯ সালে শুরু হয় হাসপাতালটির আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম। তারও তিন বছর পর ১৯৯২ সালে শুরু হয় সেশন। প্রথম বছর শিক্ষার্থী ছিলেন মাত্র ৪০ জন। কলেজ পরিচালিত হয় প্রতিষ্ঠাতার বাবা ও মায়ের নামে গড়ে তোলা আফতাব-রহিমা ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের অধীনে। কলেজ প্রতিষ্ঠায় সরকারি-বেসরকারি কোনো অনুদান নেওয়া হয়নি, পরিচালনায়ও কখনো কোনো অনুদান গ্রহণ করা হয় না।

শতভাগ শিক্ষার্থীই আবাসিক সুবিধার আওতায় আছে
ছবি: প্রথম আলো

নির্মাণের সময় থেকেই প্রতিষ্ঠানটির যুক্ত আছেন হাসপাতাল পরিচালক অধ্যাপক বাহার উদ্দিন ভূঁইয়া। তিনি বললেন, ‘শিক্ষার মান ধরে রাখার বিষয়ে কোনো ছাড় এই কলেজে নেই। শতভাগ শিক্ষার্থীই আবাসিক সুবিধার আওতায় আছে। শিক্ষকদেরও বাইরে প্র্যাকটিসে বারণ আছে। সকাল ৮টা থেকে বেলা সাড়ে তিনটা আর সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত ক্লাস। এ সময়ের মধ্যে বাস্তব প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে দুই ঘণ্টার জন্য থাকতে হয় হাসপাতালে, রোগীদের সেবায়। আমাদের কলেজ থেকে পাস করা চিকিৎসকদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণ ও কর্মস্থলে সফল হওয়ার হার বেশ ভালো। বিশেষ করে বিদেশি শিক্ষার্থীরা দেশে ফিরে সুনামের সঙ্গে কাজ করছেন। এখানে নিরাপত্তা ভালো, পড়ালেখার মান ভালো, ক্যাম্পাসটাও মন ভালো করার মতো। মূলত এসব কারণে আমাদের কলেজের প্রতি বিদেশি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বেশি। এবার দেশের ৫৭টি কলেজে ৮৫৫টি আসন শূন্য থাকলেও আমাদের প্রতিষ্ঠানে মাত্র একটি আসন শূন্য আছে। সেটাও পূরণ হয়ে যাবে।’

আরও পড়ুন

বাহার উদ্দিন জানালেন, শিক্ষকেরাও এই কলেজ ছেড়ে যেতে চান না। কারণ, এখানকার কাজের পরিবেশ। তিনি বলেন, ‘প্রত্যেক কর্মী এই প্রতিষ্ঠানকে নিজের ভাবতে শিখেছে। অনেক সহকর্মীর এই কলেজে শুরু, শেষটাও এই কলেজ থেকেই হচ্ছে। আমাদের এখানে একটা কথা বেশ প্রচলিত। এই কলেজে আসা সহজ, ছেড়ে যাওয়া অনেক কঠিন। আমাদের অনেক শিক্ষক মৃত্যুর পর কলেজেই সমাহিত করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। প্রয়াত অধ্যক্ষ আজিজুর রহমান ও দেশের নামকরা সার্জন অধ্যাপক বখতিয়ার হোসেনসহ আরও অনেকের কবর এই কলেজে।’

কলেজের অধীনে নার্সিং ইনস্টিটিউট আছে। এর মাধ্যমে ডিপ্লোমা কোর্স পরিচালিত হচ্ছে। ২০০৫ থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে বাংলাদেশের নার্সিং ইনস্টিটিউটগুলো থেকে যাঁরা ডিপ্লোমা নার্সিংয়ে প্রথম স্থান অর্জন করেছেন, তাঁদের মধ্যে আটজনকে স্বর্ণপদক দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ৮ জনের মধ্যে ৬ জনই জহুরুল ইসলাম নার্সিং ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী।

পাঠাগারে অনেকটা সময় কাটে শিক্ষার্থীদের
ছবি: প্রথম আলো

সমৃদ্ধ পাঠাগার

জহুরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পাঠাগারে বইয়ের সংখ্যা ১০ হাজারের বেশি। সকাল ৮টা থেকে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত এখানে শিক্ষার্থীদের আনাগোনা থাকে। কেবল মেডিকেল শিক্ষাসংক্রান্ত বই নয়; আছে ইংরেজি সাহিত্য, দর্শন, ধর্ম, রাজনীতি, ইতিহাসসহ নানা বিষয়ের বহু বই। পাঠাগারে সংরক্ষণ করা আছে সাড়ে চার হাজার জার্নাল। জানা গেল, পাঠাগারটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সঙ্গে যুক্ত। এর ফলে শিক্ষার্থীরা অনলাইনের মাধ্যমে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা প্রকাশিত গবেষণা, নিবন্ধ বা বইতে চোখ রাখতে পারেন।

পাঠাগারেই এক শিক্ষার্থী সানজিদার সঙ্গে দেখা। জানালেন, তাঁদের শিক্ষাকে পূর্ণতা দিচ্ছে ভালো মানের এই পাঠাগার। অতিরিক্ত প্রধান গ্রন্থাগারিক এ এন এম আবদুল হক বললেন, ‘এই প্রতিষ্ঠানে লাইব্রেরি ওয়ার্ক ভালো হয়। পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, লাইব্রেরি ওয়ার্ক ভালো হওয়ায় ফলও ভালো হচ্ছে। দেখা গেছে যাঁরা লাইব্রেরিতে বেশি সময় দিচ্ছে, তাদের ফল বেশি ভালো হচ্ছে।’

বাস্তব প্রশিক্ষণের সুযোগ বেশি

খালেকুল ইসলাম, উপাধ্যক্ষ, জহুরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল

খালেকুল ইসলাম, উপাধ্যক্ষ, জহুরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল

চিকিৎসা শিক্ষাকে পূর্ণতা দেয় বাস্তব প্রশিক্ষণ। আমাদের এখানে এ সুযোগটি শতভাগ বিদ্যমান। বাস্তব প্রশিক্ষণ হলো একজন শিক্ষার্থীর বিপরীতে হাসপাতালে পাঁচটি শয্যা থাকা। এই কলেজে তা আছে। আমাদের শয্যা সংখ্যা ৫১৪। প্রতিদিন হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা গড় রোগী তিন হাজার। প্রচুর রোগী আসার কারণে শিক্ষার্থী সহজে বাস্তব প্রশিক্ষণের সুযোগ পাচ্ছে। বাইরের শিক্ষার্থীরা নিজ দেশে গিয়ে চিকিৎসা নিবন্ধন পরীক্ষায় অংশ নিয়ে প্রায় শতভাগ সফল হচ্ছে। আমাদের দেশের অন্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে এমন কৃতিত্ব কমই আছে। উচ্চশিক্ষায়ও আমাদের সাফল্য দারুণ। দেশ-বিদেশে আমাদের শিক্ষার্থীরা এখন সুনামের সঙ্গে টিকে আছে। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সম্পর্কের দূরত্ব আমরা কমিয়ে আনতে পেরেছি। ক্যাম্পাস সাজিয়েছি নানা ধরনের গাছ দিয়ে। সবুজের মধ্যে বিচরণ করে মনের পরিচর্যা হচ্ছে। দেহ-মন সুস্থ রাখার সহায়ক শিক্ষা হিসেবে ফুটবল ও ক্রিকেট খেলা, সাহিত্য সাংস্কৃতিক চর্চায় মনোযোগ বাড়ানোর নানা উদ্যোগ এখানে সক্রিয় আছে। খেলার জন্য আলাদা করে বড় মাঠ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এই মাঠে পঞ্চমবারের মতো আমরা আয়োজন করেছি আন্তমেডিকেল ফুটবল ও ক্রিকেট টুর্নামেন্ট। দ্যুতি নামে প্রতিবছর একটি সাংস্কৃতিক আয়োজন ও ম্যাগাজিন প্রকাশ হয়। এই আয়োজনের মধ্যে দিয়ে নিজ সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় ঘটিয়ে দিচ্ছে দেশ বিদেশের শিক্ষার্থীরা।