সৈয়দপুরের যে ব্র্যান্ডের হোম টেক্সটাইল যাচ্ছে আন্তর্জাতিক বাজারে

বিছানা-বালিশের আবার পোশাক! হ্যাঁ, ঠিকই শুনছেন। আপনি আমি যেটাকে বিছানার চাদর বা বালিশের কভার বলি, সেটা তো খাট বা বালিশের পোশাকই! আর এই পোশাকেরও রকমফের আছে। বিছানার চাদর একটা হলেই হলো, এমন ভাবনা যাঁদের, তাঁদের কথা আলাদা। কিন্তু যাঁরা নিজেদের অন্দরকেও দিতে চান লাক্সারি বা অভিজাত লুক, তাঁদের তো বাছাই করা অনুষঙ্গই চাই। আর দেশেই এখন তৈরি হচ্ছে এসব অনুষঙ্গ। তৈরি করছে লাক্সারি হোম টেক্সটাইল ব্র্যান্ড, ‘পাখি’। এটা ঢাকাভিত্তিক কোনো উদ্যোগ নয়, উত্তরবঙ্গের সৈয়দপুর উপজেলা থেকে পরিচালিত হয় পাখি।

বিছানা-বালিশের ওপর সুন্দর নকশা পুরো ঘরেই নিয়ে আসে ভিন্নতা।মডেল: সায়রা আকতার জাহান, কৃতজ্ঞতা: পাখি, স্থান কৃতজ্ঞতা: পাখি ওয়্যারহাউস (সৈয়দপুর)। ছবি: সুমন ইউসুফ

যেভাবে জন্ম নিল পাখি

পড়াশোনা ও চাকরির সুবাদে দীর্ঘদিন দেশের বাইরে ছিলেন সৈয়দপুরের মেয়ে রিপ্রিয়া রাজ পোদ্দার। স্কটল্যান্ড থেকে মাস্টার্স করার পর বাবার ব্যবসায় দুই বছর হাতে-কলমে শিখেছেন ই-কমার্স ও ডিজিটাল বিজ্ঞাপন। এরপর আবার নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডামের একটি কোম্পানিতে ডিজিটাল মার্কেটিং স্পেশালিস্ট হিসেবে চাকরিতে যোগ দেন।

করোনার সময় দেশে ফিরে আসেন, সৈয়দপুরে বসেই চলতে থাকে চাকরি। এ সময়ে নিজের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে দেশেই কিছু একটা করতে চাইছিলেন। দেশে এসে নিজের ঘরের জন্য মনমতো চাদর, পর্দার অভাব তাঁকে ভোগাচ্ছিল।

তখনই টের পান, টাকা থাকলেও অনেকে মনমতো বেডিং অনুষঙ্গ খুঁজে পান না। দেশের মানুষের সেই অভাব পূরণ করতেই ঠিক করলেন কাঁথা-বালিশের পোশাক বিক্রি করবেন! তবে তাঁর পণ্যগুলো হবে লাক্সারি।

লাক্সারি বেডিং ব্র্যান্ড পাখি আছে ম্যাট্রেস কভার (ফিটেড শিট), বালিশের কভার, কোলবালিশের কভার, কম্বলের কভার, কাঁথা, কমফোর্টার কভার, থ্রোস, শিশুদের কাঁথা, কুশন কভার, ফ্লোর ম্যাট, রাগস ইত্যাদি
ছবি: সুমন ইউসুফ

কিন্তু চাইলেই তো হবে না, দেশে দরকারি উপকরণ আর মনমতো কর্মী পাওয়া তো কঠিন। তখন এক জায়গার ফ্যাক্টরি কনসেপ্ট থেকে বেরিয়ে দেশে দেশে সেটা ছড়িয়ে দিলেন তিনি। চীনের হয়তো কাঁচামাল ভালো, রাজস্থানের ভালো নকশা, বাংলাদেশে হয়তো মার্কেটিং অভিজ্ঞ টিম ভালো, আবার অন্য কোনো দেশের ভালো ফটোগ্রাফি।

এভাবে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা সেরা জিনিসগুলোকে নিজের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত করে নেন রিপ্রিয়া। আর এভাবেই তৈরি হলো লাক্সারি বেডিং ব্র্যান্ড পাখি। ২০২১ সালে যাত্রা শুরু করে পাখি। এ সময়ে নিজের উদ্যোগ ও চাকরি—দুটোই সমানভাবে চালিয়ে যেতে থাকেন রিপ্রিয়া রাজ পোদ্দার। তবে সম্প্রতি চাকরি ছেড়ে পুরোপুরি নিজের ব্র্যান্ডের কাজই করছেন।

পাখির উদ্যোক্তা রিপ্রিয়া রাজ পোদ্দার বলেন, ‘খুব শিগগির আমরা অস্ট্রেলিয়ায় পাখি ব্র্যান্ডের পণ্য বিক্রি শুরু করছি। এভাবে দেশি ব্র্যান্ডটিকে গ্লোবাল ব্র্যান্ড হিসেবে পরিচিত করে তুলতে চাই।’

আরও পড়ুন

পাখির বাসা

পাখির কোনো ফিজিক্যাল স্টোর নেই। ব্র্যান্ডটির ওয়েবসাইট থেকেই সাধারণত ক্রেতারা পণ্য দেখে অর্ডার করেন। পরে সৈয়দপুরের ওয়্যারহাউস থেকে দেশের যেকোনো স্থানে পৌঁছে দেওয়া হয়।

সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে পাখির ফিজিক্যাল অফিস কাম ওয়্যারহাউস দেখতে সৈয়দপুর যায় নকশার একটি দল। সেখানে নকশার বিশেষ ফটোশুটের সময় কর্মীদের পণ্য ডেলিভারির ব্যস্ততা চোখে পড়ে। পূজার আগে অর্ডারের চাপও ছিল বেশ।

সৈয়দপুরের এই ওয়্যারহাউস থেকেই সারা দেশে সরবরাহ করা হয় পাখির পণ্য
ছবি: সুমন ইউসুফ

বাজারে বর্তমানে পাখির পাঁচ শতাধিক পণ্য আছে। নকশার ভিন্নতাও আছে নানা রকম। বিছানার চাদর ও বিভিন্ন রকম কভারের ৫০টির বেশি ইউনিক নকশা আছে। কোন ধরনের বিছানার চাদরগুলো বেশি চলে জানতে চাইলে রিপ্রিয়া রাজ পোদ্দার বলেন, ‘ট্রি অব লাইফ, ভেরোনা, তাসকানি পিঙ্ক সিরিজগুলোর চাহিদা বেশি।

তবে যেহেতু আমরা এটাকে অভিজাত রাখতে চেয়েছি, তাই প্রতিটি নকশার পণ্যও আনা হয় হিসাব করে।’ পাখির অন্যান্য পণ্যের মধ্যে আছে ম্যাট্রেস কভার (ফিটেড শিট), বালিশের কভার, কোলবালিশের কভার, কম্বলের কভার, কাঁথা, কমফোর্টার কভার, থ্রোস, শিশুদের কাঁথা, কুশন কভার, ফ্লোর ম্যাট, রাগস ইত্যাদি। এসব ছাড়াও নতুন ডাইনিং পণ্য হিসেবে বেশ কিছু কৌটা, লাঞ্চ বক্স ও ট্রে এনেছে তারা।

পাখির উদ্যোক্তা রিপ্রিয়া রাজ পোদ্দার
ছবি: সুমন ইউসুফ

প্রতিটি পণ্যই যাচাই–বাছাই করে ক্রেতাদের সরবরাহ করে তারা। ৩ হাজার টাকার বিছানার চাদর ও কভার থেকে শুরু করে প্রায় ২০ হাজার টাকার ফুল বেডিং সেটও আছে। প্রায় ৬ হাজার টাকা থেকে শুরু হয় তাদের কাঁথার দাম। ৭ হাজার থেকে ১ লাখ ৩৫ হাজার টাকায় মিলবে মেঝেতে বিছানোর রাগস।

আরও পড়ুন

কেন জরুরি পরিচ্ছন্ন ঘর

মার্কিন জনপ্রিয় ইউটিউবার ডিলান অ্যান্ডারসন করোনা মহামারির সময় ঠিক করেন নিজের ঘরটাকে নতুন করে সাজাবেন। তখন তাঁর চোখের সামনে আদর্শ পরিপাটি ঘরের যে চেহারা আসে, সেটা নব্বইয়ের দশকের বিখ্যাত সিরিজ ‘ফ্রেন্ডস’–এর মনিকা গেলারের ঘর। অনেকেরই মনের মধ্যে নিজের ঘরটিকে পরিপাটি করে সাজানোর ইচ্ছা থাকে।

ডিলানও সেই ভাবনা থেকে মনিকার ঘরটি রিক্রিয়েট (পুনর্নির্মাণ) করেন। যা আপলোড করার পর ভক্তরাও ফিরে যান ফ্রেন্ডসের দিনগুলোতে, বিশেষ করে মনিকার ঘরে। সেখানে পরিপাটি করে সাজানো বিছানা, তার সঙ্গে মিলিয়ে বালিশের কভার। জানালার পর্দা থেকে টেবিল ক্লথ—সবই যেন নিখুঁত।

বিছানার চাদর আপনার রুচিকে তুলে ধরে
ছবি: সুমন ইউসুফ

সাম্প্রতিক সময়ে নেটফ্লিক্সের একটি সিরিজেও এমন কেতাদুরস্ত ঘরের দেখা মেলে। সেটা এমিলি ইন প্যারিস-এর কেন্দ্রীয় চরিত্র এমিলির ঘর। চাকরির সুবাদে ফ্যাশনের শহর প্যারিসে যান মার্কিন এই তরুণী।

সেখানেই নিজের ফ্যাশনের পাশাপাশি ভাড়া বাড়িটাকেও মনমতো সাজানোর বাতিক দেখা যায়। বাতিক লিখছি এই কারণে যে পরিচিত অনেককেই দেখেছি কারও পরিপাটি বাসা দেখে মন্তব্য করেন, ‘ভাড়া বাসা এত সুন্দর করে সাজানোর কী আছে!’

আছে। আপনার ঘরবাড়ি, আসবাব থেকে বিছানার চাদর—সবই আপনার রুচিকে তুলে ধরে। একটি পরিচ্ছন্ন পরিবেশ মানসিকভাবেও সুস্থ থাকতে সাহায্য করে। এ বিষয়ে একাধিক গবেষণাও হয়েছে। পারসোনালিটি অ্যান্ড সোশ্যাল ফিজিওলজি বুলেটিনে প্রকাশিত একটি জরিপের তথ্য বলছে, যাঁরা নিজের ঘরবাড়িকে অগোছালো বলেছেন, তাঁদের বেশির ভাগই বিষণ্নতায় ভোগেন।

বিশেষ করে গবেষণায় অংশ নেওয়া নারীদের মধ্যে অপরিচ্ছন্ন ও এলোমেলো ঘরে বসবাসকারীদের স্ট্রেসের হরমোন কর্টিসল বেশি নির্গত হয়। যে কারণে তাঁরা বেশি বিষণ্নতায় ভোগেন, ক্লান্ত থাকেন।

বিছানার চাদর ও বিভিন্ন রকম কভারের ৫০টির বেশি ইউনিক নকশা আছে
ছবি: সুমন ইউসুফ

প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি নিউরোসায়েন্স ইনস্টিটিউটের এক গবেষণা বলছে, অগোছালো পরিবেশ, বিশেষ করে অগোছালো ঘরে বসবাস মানুষের মস্তিষ্কের তথ্য প্রক্রিয়াকরণ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। মানসিক চাপ বাড়ানোর পাশাপাশি মনোযোগের ঘাটতি তৈরি করে।

তাহলে বুঝুন নিজের ঘরবাড়িও কেন যত্নে রাখা জরুরি। তবে সব সময় যে দামি উপকরণেই বাড়িঘর সাজাতে হবে, তা নয়। তবে সবারই বাড়িঘর গুছিয়ে রাখার অভ্যাস থাকা জরুরি। আর নিজের বাড়িকে যাঁরা মনমতো সাজাতে চান, তাঁদের জন্য পাখি তো রইলই।

আরও পড়ুন