বিড়ালটিকে কেন ৮৪ দিন ইনজেকশন দিতে হলো

দিব্যি সুস্থ এক বিড়াল। খাচ্ছিল, খেলছিল, ছুটছিল। হঠাৎই বাধল এক বিপত্তি। যেনতেন ব্যাপার নয়, একটানা ৮৪ দিন ইনজেকশন নিতে হলো তাকে! আজ ৮ আগস্ট আন্তর্জাতিক বিড়াল দিবস। দিবসটিকে সামনে রেখে পড়ুন সেই বিড়ালের জীবনের গল্প।

বিড়ালটির নাম কেওকারাডংছবি: রাফিয়া আলম

এপ্রিলের ২৬ তারিখ। সকালে খেলার সময় বাসার নিরাপত্তাপ্রহরীর ধাওয়ায় ভুল পথে চলে গেল বিড়ালটি। বাসায় ফিরতে পারল না সারাটা দিন। ও ছোট থাকতেই নাম রেখেছিলাম কেওকারাডং। নামটা কি বিড়ালের জন্য কঠিন? মনে হয় না! এই নামেই দিব্যি সাড়া দেয়।

উদ্ধারের পর

২৬ এপ্রিল রাতেই অন্য বাড়ি থেকে ওকে উদ্ধার করে আনলেন আমার বাবা। কেওকারাডং প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গিয়েছিল। ফেরার পর খাবার কিংবা পানি কিছুই খাচ্ছিল না। পরদিন চিকিৎসকের কাছে নিলাম। চিকিৎসা চালানো হল আট দিন, কয়েক দফায় পরামর্শ নিলাম দুজন চিকিৎসকের। সুস্থতার লক্ষণ নেই। জ্বরও এল। বিস্ময়কর ব্যাপার, বাসার অন্যান্য বিড়াল শুরু থেকেই ওকে ভয় পেয়ে দূরে থাকছিল।

অবশেষে রোগ নির্ণয়

আশানুরূপ উন্নতি না হওয়ায় ছুটলাম আরেক চিকিৎসকের কাছে। তিনি চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড এনিম্যাল সায়েন্সেস ইউনিভার্সিটির অধীনে পূর্বাচলের টিচিং অ্যান্ড ট্রেনিং পেট হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টারের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. বায়েজীদ বোস্তামী। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় বিডি পেট কেয়ারে রোগী দেখেন।

মে মাসের পাঁচ তারিখ বিকেলে গেলাম সেখানে। সেদিন ওদিকটার পথ কী কারণে যেন আটকানো। সিএনজিচালিত অটোরিকশা থেকে নেমে প্রায় ২০ মিনিট অসুস্থ বিড়ালকে কোলে নিয়ে হেঁটে পৌঁছলাম গন্তব্যে।

ডা. মো. বায়েজীদ বোস্তামীর কোলে কেওকারাডং
ছবি: বিডি পেট কেয়ারের সৌজন‍্যে

দক্ষ চিকিৎসক হিসেবে ডা. মো. বায়েজীদ বোস্তামীর সুনাম আছে। তিনি ওকে দেখেই ধারণা করলেন, এফআইপি হয়েছে। আল্ট্রাসনোগ্রাম করলেন ঝটপট। দেখা গেল, পেটে পানি জমেছে। রক্তের নানান পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহ করলেন। পরদিন রিপোর্ট এল। তাঁর ধারণাই সত্যি প্রমাণ হলো।

মানসিকভাবে তখন আমি মহাবিপর্যস্ত। দ্রুত চিকিৎসা না করালে যে আছে ওর মৃত্যুর ভয়। এর আগে তো কেবল উপসর্গভিত্তিক চিকিৎসা দিয়েছিলেন অন্য চিকিৎসকেরা। এবার শুরু সত্যিকার চিকিৎসা।

শুরু হলো লড়াই

৮৪ দিনের হিসাব শুরু করে দিলাম সেদিন থেকেই। মূল চিকিৎসা জিএস নামের অ্যান্টিভাইরাল ইনজেকশন। একটি ভায়ালে প্রায় তিনদিন চলছিল, যার দাম পড়ল ২ হাজার ১০০ থেকে ২হাজার ২৫০ টাকার মতো। বুঝতেই পারছেন, ৮৪ দিনের চিকিৎসা মানে মোটা অঙ্কের ধাক্কা। অন্যান্য ওষুধও প্রয়োজন।

রোগনির্ণয়ের আগে প্রথম আট দিনেও খরচ হয়েছে অনেকটা। চাকরির বাইরে আমার রোজগারের উৎস ফ্রিল্যান্স লেখালেখি। মানসিকভাবে ভেঙে পড়লেও আর্থিক ভিত শক্ত রাখতে আমাকে চালিয়ে যেতে হলো দুটি কাজই। কারণ, বাস্তবতা বড় নির্মম।

ক্যালেন্ডারে হিসাবের চিহ্ন
ছবি: রাফিয়া আলম

নিয়ম করে ওষুধ খাওয়ানো আর ইনজেকশন দেওয়াটা খুব কষ্টের ছিল। বিড়ালটাকে কীসের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে ভাবুন তো! ৮৪ দিনের প্রথম আট দিনে ওষুধের সংখ্যাও ছিল বেশি। এরপর একটু একটু করে কমতে থাকে সংখ্যাটা। দিন গুনতাম তখন। দাগিয়ে রাখছিলাম ক্যালেন্ডারের পাতা।

একটু একটু করে ওর উন্নতি শুরু হলো। তবুও মনে শঙ্কা। সপ্তাহ তিনেকের মাথায় অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে এল সে। ধীরে ধীরে ভয়াল মেঘ সরে গেল আমার মনের আকাশ থেকে।

আরও পড়ুন

রোগটা সম্পর্কে জানতে

ডা. মো. বায়েজীদ বোস্তামীর কাছে জানতে চেয়েছিলাম এই রোগের আদ্যোপান্ত। এফআইপি হলো ফেলাইন ইনফেকশাস পেরিটোনাইটিস। এটি ফেলাইন করোনা ভাইরাসের সংক্রমণজনিত জটিলতা। ভাইরাসটি বিড়াল থেকে বিড়ালে ছড়াতে পারে, ছড়ায় খাবার আর পানির মাধ্যমেও। তবে মানুষের ক্ষতি হয় না।

কেওকারাডংকে দেওয়া ইনজেকশনের ভায়াল
ছবি: রাফিয়া আলম

এফআইপিতে উচ্চ মাত্রার জ্বর আসে-যায়, বিড়ালের স্বাভাবিক ছোটাছুটি কমে আসে ধীরে ধীরে। খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দিতে থাকে, নিস্তেজ হতে থাকে। বুকে বা পেটে পানি আসতে পারে, চোখ ঘোলাটে হয়ে যেতে পারে, স্নায়বিক সমস্যাও দেখা দিতে পারে।

একেক ধরনের এফআইপিতে একেক রকম উপসর্গ। ৮৪ দিনের চিকিৎসা সম্পন্ন না করলে রোগটা ফিরে আসার ঝুঁকি থাকে। আক্রান্ত অবস্থায় সুস্থ বিড়ালের থেকে আলাদা রাখতে হয়। সতর্ক না থাকলে আক্রান্ত বিড়ালের শুশ্রূষাকারীর মাধ্যমেও অন্য বিড়াল আক্রান্ত হতে পারে।

আরও পড়ুন

পাশে ছিলেন যাঁরা

আমি স্কয়ার হাসপাতাল লিমিটেডের একজন চিকিৎসক। ক্লিনিক্যাল স্টাফ হিসেবে কাজ করি নিউরোমেডিসিন বিভাগে। ফ্রিল্যান্সভিত্তিক কাজ করি দৈনিক প্রথম আলোয়। দুই প্রতিষ্ঠানের সহকর্মী, সিনিয়র, জুনিয়র—সবাই এই মহাবিপদে নিজের জায়গা থেকে সর্বোচ্চ সমর্থন দিয়েছেন আমাকে।

বাসায় ওষুধ দেওয়ার সময় বিড়ালটাকে ধরে রাখা, ওষুধপত্র বা সিরিঞ্জ এগিয়ে দেওয়ার মতো খুঁটিনাটি কাজগুলো প্রায় পুরোটা সময়ই করেছেন আমার মা। আমার বাবাও করেছেন প্রথম কয়েকটা দিন; পাঁচ মের আগে চিকিৎসা সরঞ্জাম কিনতে ছুটেছেন ব্যস্ত শহরের বুকে।

খালামণিরা দিয়েছেন আর্থিক সহায়তা। সবার প্রতিই কৃতজ্ঞতা জানাই। কেওকারাডং এখন সম্পূর্ণ সুস্থ।

আরও পড়ুন