যাঁদের সঙ্গে কাজ করতাম, তাঁরা সবাই প্রাণ হারালেন

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর বেশ কবছর ধরে বই আকারে প্রকাশ করছে স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের সংগৃহীত ‘মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী–ভাষ্য’। নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতেই তাদের এই উদ্যোগ। জাদুঘরের আহ্বানে সাড়া দিয়ে শিক্ষার্থীরা পরিচিতজনদের সঙ্গে আলাপ করে একাত্তরের স্মৃতি লিখিতভাবে পাঠায়। ফলে এই কর্মসূচি এক অর্থে বিনিময়। যেখানে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর বয়ে নিয়ে যাচ্ছে ইতিহাস এবং শিক্ষার্থীরা জোগান দিচ্ছে ইতিহাসের নতুন উপাদান। শিক্ষার্থীদের পাঠানো এসব ভাষ্য থেকে বাছাই ৩১টি কাহিনি বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে প্রকাশ করছে প্রথম আলো

সংগ্রহকারী: ইভা আক্তার, দশম শ্রেণি (স্মৃতিকথা সংগ্রহের সময়), হাজী নূরউদ্দিন আহম্মদ উচ্চবিদ্যালয়, বরপা, রূপসী, রূপগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ

বর্ণনাকারী: মো. আমিনুল ইসলাম, আড়িয়াব, রূপসী, রূপগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ

শেষবার বাকি একজন মুক্তিযোদ্ধাকে পার করে এপারে ফিরে এসে কোশাটা ডুবিয়ে দিতেই ভীষণ জোরে শব্দ এল
অলংকরণ: কাইয়ুম চৌধুরী

মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বয়স ১১-১২ বছর হবে। পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। দেশে তখন প্রচণ্ড অভাব। সে সময় আমি মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে থাকতাম এবং তাঁদের সঙ্গেই খাওয়াদাওয়া করতাম। তাঁদের গুরুত্বপূর্ণ খবর এনে দিতাম। মোটকথা, মুক্তিযোদ্ধারা আমাকে যা বলতেন, আমি তা–ই করতাম। পাঁচ মাস তাঁদের সঙ্গে কাজ করেছি।

এর মধ্যে একদিন মুক্তিযোদ্ধারা একটি খাল পার হবেন। ওই খালে কোনো সেতু ছিল না। আমার দায়িত্ব পড়ল, মুক্তিযোদ্ধাদের খাল পার করে দিতে হবে। একটি তালগাছ দিয়ে বানানো কোশা নৌকা দিয়ে দুজন দুজন করে পার করতে শুরু করলাম।

আরও পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন ১৪ জন। পরিকল্পনা ছিল, তাঁদের পার করে কোশাটা পানিতে ডুবিয়ে দিয়ে চলে আসব। একে একে ১৩ জনকে পার করলাম। শেষবার বাকি একজন মুক্তিযোদ্ধাকে পার করে এপারে ফিরে এসে কোশাটা ডুবিয়ে দিতেই ভীষণ জোরে শব্দ এল কানে।

লুকিয়ে দূরে গিয়ে দেখি, বোমা মেরে ১৩ জন মুক্তিযোদ্ধাকেই মেরে ফেলেছে। বাকি একজনকেও রেহাই দিল না, পানি থেকে ওঠার সময় তাঁকেও পিটিয়ে হত্যা করল।
ভয়ে অনেক দূরে চলে গেলাম।

খুব ইচ্ছা ছিল, মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে থাকব, তাঁদের জন্য কাজ করব। ইচ্ছা ছিল মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার, কিন্তু আমার সে আশা পূর্ণ হলো না। যাঁদের সঙ্গে কাজ করতাম, তাঁরা সবাই প্রাণ হারালেন।

আরও পড়ুন

অবশেষে পাঁচ মাস পর নিজ গ্রামে ফিরে এলাম। গ্রামে ফিরে যাওয়ার সময় আমাকে অনেক বিপদের মুখে পড়তে হয়েছে। আমার গ্রামে এসেও মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কাজ করতে চাইলাম, কিন্তু তাঁরা আমাকে সঙ্গে নেননি।

মন খারাপ করে বাড়িতে বসে আছি। এমন একদিন পাকিস্তানি বাহিনী আমাদের বাড়িতেও আক্রমণ চালাল। মা-বাবা ও ভাইবোনদের সঙ্গে দৌড়াতে দৌড়াতে এক গ্রাম ছেড়ে আরেক গ্রামে চলে গেলাম। একসময় দেশ স্বাধীন হলো, তবে আমার আফসোস থেকেই গেল।

আরও পড়ুন