চিকিৎসা শেষে বাসায় ফিরেছেন মাইলস্টোনের ‘সবুজা খালা’, সেদিনের বর্ণনা দিতে গিয়ে ফেললেন দীর্ঘশ্বাস
মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের যে ভবনে বিমান আছড়ে পড়ে, সেখানেই দায়িত্ব পালন করছিলেন সবুজা বেগম। ওই ঘটনায় দগ্ধ হয়ে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসা শেষে বাসায় ফিরেছেন। আয়া পদে কাজ করা মানুষটা স্কুলে সবার ‘সবুজা খালা’। তাঁর জীবনের গল্প শুনেছেন মো. জান্নাতুল নাঈম
উত্তরার দিয়াবাড়ির খালপাড় এলাকায় থাকেন সবুজা বেগম। টিনশেডের ভাড়া বাসা। প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকে বাসার সামনে উঠান। বৃষ্টির পানিতে ডুবে আছে। এক হাত পরপর বালুর বস্তা পাতা। সেগুলোয় সাবধানে পা ফেলে ফেলে তাঁর বাসায় ঢুকলাম। একটু পরই এলেন সবুজা বেগম।
মাইলস্টোন স্কুলে আয়াদের ‘খালা’ বলেই ডাকেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। স্কুলে সবুজা বেগমের পরিচয় তা–ই ‘সবুজা খালা’।
২১ জুলাই তাঁর স্বাভাবিক কাজ অর্থাৎ শ্রেণিকক্ষ, বারান্দা ও ওয়াশরুম পরিষ্কারের কাজেই ব্যস্ত ছিলেন সবুজা খালা। শিক্ষকদের এটা-সেটা এনে দেওয়া, ছুটির পর শিক্ষার্থীদের শৃঙ্খলা নিশ্চিত করাও তাঁর দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। বেলা ১টায় স্কুল ছুটি হয়। প্রতিদিনের মতো শিশুদের লাইন ধরিয়ে নিচে নামিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। শিক্ষক ও আয়াদের তত্ত্বাবধানে শিশুরা এরপর অভিভাবকের কাছে যায়। ওপরতলার খালা অন্য দায়িত্বে ছিলেন। সবুজা তাই দ্বিতীয় তলাতেই অবস্থান করছিলেন। হঠাৎ বিকট শব্দ, মেঝেতে পড়ে যান তিনি। সবার চিৎকারে শুনতে পান, ‘ভবনের ওপর বিমান পড়েছে।’
তিনি যা দেখেছেন
সেদিনের বর্ণনা দিতে গিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন সবুজা বেগম। একটু সময় নিয়ে বলেন, ‘দেখি, স্যার–ম্যাডাম–বাচ্চাগো দৌড়াদৌড়ি লাগছে। হ্যাগো দৌড় দেইখা আমিও ওগো পাছ পাছ দৌড় দিছি। যারা দৌড়াইয়া নামছে, নামছে; যারা বারিন্দার মাথায় দৌড় দিছে, দিছে। দুই একজন সিঁড়ি দিয়া নামছি, পরে দেখি থিরির রুমেরতে আগুন বার হইছে। আগুন আর ভয় করি নাই বাবা। আগুনের মাঝখানেই দৌড় দিছি।’
ভবন থেকে বের হওয়ার আগমুহূর্তে ছুটতে থাকা দুই শিশুকে নিয়েই তিনি আগুন পেরিয়ে যান। আগেই আঘাত লেগে একটি শিশুর মাথা দিয়ে তখন রক্ত ঝড়ছিল।
একজন অভিভাবক এ সময় ব্যাগ দিয়ে একটি শিশুর শরীরের আগুন নেভান। অন্য শিশুটিকে কোলে নিয়ে সবুজা খালা যান জুনিয়র স্কুল ভবনের পানির ট্যাংকের কাছে। শরীরে তখন প্রচণ্ড যন্ত্রণা। পানির কল ছেড়ে শিশুটিসহ সেখানে বসে যান। পাশে তাকিয়ে দেখেন, আরেকজন শিক্ষিকা পানির বালতিতে দাঁড়ানো। পুরো শাড়ি আগুনে পোড়া। ইতিমধ্যে ফায়ার সার্ভিস ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী চলে আসে। আঘাতপ্রাপ্ত শিশুটিকে নিয়ে যান উদ্ধারকর্মীরা।
দুর্ঘটনার খবর পেয়েই ঘটনাস্থলে যান সবুজা বেগমের বড় ছেলে। ১০-১৫ মিনিট পর মা-ছেলের দেখা হয়। উত্তরার ঢাকা স্পেশালাইজড হাসপাতাল ঘুরে তাঁকে নেওয়া হয় জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে। সেখানে আইসিইউতে ছিলেন তিন দিন। মুখ, পিঠ, হাত, পাসহ শরীরের প্রায় ১০ শতাংশ পুড়েছে।
২৭ জুলাই হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়ে এখন বাসায় বিশ্রাম নিচ্ছেন সবুজা বেগম।
তাঁর আয়েই চলে সংসার
সবুজা বেগমের স্বামীর নির্দিষ্ট কোনো কাজ ছিল না। যখন যে কাজ পেতেন, করতেন। দুই ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে টেনেটুনে চলত সংসার। ২০১৩ সালে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে আয়ার চাকরি পান সবুজা। তাঁর আয়ে অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়। মেয়েকে অল্প বয়সে বিয়ে দেন। প্রায় আট বছর আগে হঠাৎ মেয়ের স্বামী মারা যান। দুই সন্তানকে নিয়ে বাপের বাড়িতে ফিরে আসেন মেয়ে। তখন থেকে এখানেই আছেন তাঁরা। কিডনিসহ নানা শারীরিক জটিলতায় দীর্ঘদিন ভুগে গত জুনে মারা যান সবুজার স্বামী। ফলে সবুজার কাঁধেই এখন পুরো সংসারের ভার। বড় ছেলের চায়ের দোকানের আয়ও খুব বেশি নয়।
তিন হাজার টাকায় কাজ শুরু করেছিলেন সবুজা। এখন বেতন ১৫ হাজার। সবুজা জানালেন, টিনশেড ঘরের ভাড়া ১০ হাজার টাকা। এর বাইরে পানি ও বিদ্যুতের বিল দিয়ে হাতে যা থাকে, তা দিয়ে চাল কেনেন। বড় ছেলে কাঁচাবাজার করে আনেন।
‘চাকরি না করলে খামু কী বাবা? স্কুল থেকে বলছে, আপনি আগে সুস্থ হন। সুস্থ হইলে আমরাই আইতে বলমু,’ বলেন সবুজা।