যে বুদ্ধিতে পাবনা অস্ত্রাগারের দখল নিতে পারেনি পাকিস্তানি বাহিনী

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর বেশ কবছর ধরে বই আকারে প্রকাশ করছে স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের সংগৃহীত ‘মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী–ভাষ্য’। নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতেই তাদের এই উদ্যোগ। জাদুঘরের আহ্বানে সাড়া দিয়ে শিক্ষার্থীরা পরিচিতজনদের সঙ্গে আলাপ করে একাত্তরের স্মৃতি লিখিতভাবে পাঠায়। ফলে এই কর্মসূচি এক অর্থে বিনিময়। যেখানে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর বয়ে নিয়ে যাচ্ছে ইতিহাস এবং শিক্ষার্থীরা জোগান দিচ্ছে ইতিহাসের নতুন উপাদান। শিক্ষার্থীদের পাঠানো এসব ভাষ্য থেকে বাছাই ৩১টি কাহিনি বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে প্রকাশ করছে প্রথম আলো

সংগ্রহকারী: রাকিব জোয়াদ্দার, সপ্তম শ্রেণি (স্মৃতিকথা সংগ্রহের সময়), চুয়াডাঙ্গা একাডেমি, চুয়াডাঙ্গা

বর্ণনাকারী: মো. লুৎফর রহমান, চুয়াডাঙ্গা

সংগ্রহকারী ও বর্ণনাকারীর সম্পর্ক: নাতি–দাদা

পুলিশ লাইনের ভেতরে ঢুকলে রিজার্ভ ইন্সপেক্টর আবুল খায়ের অস্ত্রাগার খুলে দেন
অলংকরণ: এস এম রাকিবুর রহমান

পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পাবনা শহরে প্রবেশ করেই প্রথমে কারফিউ জারি করল। লিপ্ত হলো অত্যাচার ও হত্যাকাণ্ডে। শুরু হলো এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ।

পুলিশ লাইন অস্ত্রাগার দখল করে নেওয়ার জন্য অস্ত্রাগারের চাবি বুঝিয়ে দিতে তৎকালীন পুলিশ সুপারকে চাপ দিল পাকিস্তানি বাহিনী। পুলিশ সুপার অফিস ঘেরাও করে পুলিশ সুপারের ওপর কয়েক দফা চাপ সৃষ্টি করল। চাবি না পেয়ে পুলিশ সুপারের বাসভবন থেকে তার বড় ছেলেকে উঠিয়ে নিয়ে সার্কিট হাউসে আটকে পর্যন্ত রাখল।

পুলিশ সুপার ও ডিসি ছেলেকে ফেরত দেওয়ার জন্য পাকিস্তানি বাহিনীর মেজরকে বহু অনুরোধ করেন। দুই দিন কেটে যায়। ছেলে ফেরত না পাওয়ায় একপর্যায়ে অস্ত্রাগারের চাবি হস্তান্তরের শর্তে রাজি হন পুলিশ সুপার। তিন দিন পর ছেলেকে ফিরে পান তিনি।

আরও পড়ুন

অস্ত্রাগারের চাবি হস্তান্তরের বিষয়ে ডিসি, এসপি, পুলিশ সুপার, রিজার্ভ ইন্সপেক্টর (আরআই) ও অন্য কর্মকর্তাদের একটি সভা হয়। সভায় পুলিশ লাইন রিজার্ভ ইন্সপেক্টর অস্ত্রাগারের চাবি হস্তান্তর করা হবে না বলে জানান।

এদিকে পাকিস্তানি বাহিনীর মেজর ক্ষিপ্ত হয়ে পুলিশ সুপারকে অস্ত্রাগারের চাবি দেওয়ার জন্য বারবার তাগাদা দিতে থাকেন। সন্ধ্যা ছয়টায় অস্ত্রাগারের চাবি হস্তান্তর করা হবে—এমন বার্তা দেওয়া হয় পুলিশ সুপারের পক্ষ থেকে।

এদিকে পুলিশ লাইনের ভেতরে রিজার্ভ ইন্সপেক্টরের নেতৃত্বে খোঁড়া হয় গর্ত। তাঁর পরিকল্পনা ছিল, এসব গর্তে পুলিশ সদস্যরা অস্ত্র হাতে অবস্থান নেবেন। পাকিস্তানি বাহিনী এলেই শুরু হবে গুলি। এই কৌশল পাকিস্তানি বাহিনী জানত না।

চুক্তিমতো অস্ত্রাগারের চাবি নেওয়ার জন্য ঠিক সন্ধ্যা ছয়টায় পাকিস্তানি বাহিনী পুলিশ লাইন ঘেরাও করে বৃষ্টির মতো গোলাবর্ষণ করে।

পুলিশ লাইনের ভেতরে পুলিশ বাহিনী পাল্টা গুলি চালায়। এভাবে সেদিন সারা রাত উভয় পক্ষের মধ্যে গোলাগুলি চলে। ফজরের আজান হওয়ার পরপরই পদ্মার চর ও পাবনা শহরের আশপাশের জনসাধারণ ‘জয় বাংলা’ বলে লাঠিসোঁটা নিয়ে পুলিশ লাইনের দিকে এগিয়ে যায়। হানাদার বাহিনী মনে করে, সাধারণ মানুষ তাদের ঘিরে ফেলেছে। ভয়ে তারা পিছু হটে পাবনা সার্কিট হাউসে অবস্থান নেয়।

আরও পড়ুন

হানাদার বাহিনীর কিছু সদস্য পাবনার পুরোনো টেলিফোন এক্সচেঞ্জ অফিসে ঢুকে পড়ে। তৎকালীন সংসদ সদস্য ও কৃষ্ণপুরের আবু রেজা ও কোবাদ মিষ্টিওয়ালার ছেলে মো. হাবিব লোকজন নিয়ে পুলিশ লাইনের ভেতরে ঢুকলে রিজার্ভ ইন্সপেক্টর আবুল খায়ের অস্ত্রাগার খুলে দেন। রফিকুল ইসলাম বকুল, আবু রেজা, হাবিবসহ অনেকে অস্ত্রগুলো কাঁধে নিয়ে হানাদার বাহিনীর দিকে ধাওয়া করে।

পুরোনো টেলিফোন এক্সচেঞ্জ অফিসের ভেতরে থাকা পাকিস্তানি বাহিনীর প্রায় সব সদস্য নিহত হয়। হানাদার বাহিনী সে সময় সার্কিট হাউস, ওয়াপদায় চালায় হত্যাযজ্ঞ। বহু নারী-পুরুষকে হত্যা করে নৃশংসভাবে।

আরও পড়ুন