নানা অঞ্চলের রান্না

আঞ্চলিক খাবার মানে তো শিকড়ে ফিরে যাওয়া, ঐতিহ্যের স্বাদ পাওয়া। একই উপকরণ ব্যবহার করে একেক অঞ্চলের রান্নার কৌশলে বদলে যায় খাবারের স্বাদ। তেমনই কিছু অঞ্চলের খাবার থাকছে এখানে

রোকেয়া হক, রন্ধনশিল্পী
রোকেয়া হক, রন্ধনশিল্পী
চট্টগ্রাম
চট্টগ্রামের আঞ্চলিক রান্নায় ‘লইট্ট্যাহাচা’ একটি খাবার। উপকূলে যাঁদের বসবাস, তাঁরা বর্ষা এবং শীতকালে এই মাছগুলো বেশি খেয়ে থাকেন। চট্টগ্রামের এই আঞ্চলিক খাবারের রান্নাকৌশলও ভিন্ন প্রকৃতির। রেসিপি দিয়েছেন রোকেয়া হক
লইট্যামিশাল মাছ। ছবি: সৌরভ দাস
লইট্যামিশাল মাছ। ছবি: সৌরভ দাস



লইট্যামিশাল মাছ (লইট্যাহাচা)
উপকরণ: ছোট ও মাঝারি আকারের লইট্যা মাছ, ফাইস্যা, ওলুয়া, তপসে (স্থানীয় ভাষায় রিসসা), ছোট চিংড়ি ইত্যাদি পাঁচমিশালি মাছ মোট ১ কেজি, শুকনা মরিচবাটা দেড় টেবিল চামচ, পেঁয়াজ কুচি ১ কাপের তিন ভাগের ১ ভাগ, পেঁয়াজ-রসুনবাটা একত্রে ২ চা-চামচ, হলুদের গুঁড়া ২ চা-চামচ, লবণ প্রয়োজনমতো। বিলম্বী ফল ফালি করা ৫টি, আস্ত কাঁচা লঙ্কা চেরা ৩টি, সরিষার তেল ১ টেবিল চামচ, হলুদের ফুল ও ধনেপাতা প্রয়োজনমতো।
প্রণালি: লোহার কড়াই, ননস্টিক সসপ্যানে অথবা মাটির হাঁড়িতে সব উপকরণ একত্রে ভালো করে মেখে হাত ধোয়া পানি দিয়ে চুলায় দিয়ে হাঁড়ির মুখ বন্ধ করে প্রথমে চড়া আঁচে ২ মিনিট মৃদু আঁচে ৩-৪ মিনিট রান্না করে লবণ দেখে নামিয়ে নিতে হবে। রান্না করা মাছ কাঠি বা চামচ দিয়ে নাড়া যাবে না। শুধু দুবার ঝাঁকিয়ে দিতে হবে। গরম ভাত ও ভাপা পিঠার সঙ্গে লইট্যামিশাল (লইট্যাহাচা) খেতে খুবই সুস্বাদু।

ভাগ্যবতী সিনহা ও জ্যোতি সিনহা।
ভাগ্যবতী সিনহা ও জ্যোতি সিনহা।

মণিপুরি রান্না (মৌলভীবাজার)
মণিপুরি ঐতিহ্যবাহী খাবারের একটি হচ্ছে ‘ক্ষার’। উৎসব-পার্বণে নিরামিষ খাদ্য হিসেবে ‘ক্ষার’ পরিবেশন করা হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে। বিশেষ করে ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব ‘ক্ষার’ ছাড়া ভাবাই যায় না। বান্দারায় (মণ্ডপে যে ভোজ দেওয়া হয়) এটা থাকতেই হয়।
অন্য খাবারটি হচ্ছে ‘খুদ’। এতে উপাদান হিসেবে চিংড়ি মাছ থাকে। আমিষ হওয়ায় এটি ঘরোয়া সাধারণ খাবারের সঙ্গে পরিবেশন করা হয়। 
এ দুটি খাবারের রেসিপি ও রান্নার প্রণালি দিয়েছেন মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার ঘোড়ামারা গ্রামের ভাগ্যবতী সিনহা। সহযোগিতা করেছেন তাঁর মেয়ে অভিনেত্রী জ্যোতি সিনহা।

ক্ষার
ক্ষার


ক্ষার
ক্ষার তৈরিতে লাগে চাল, ছোলা, মরিচ, হলুদ, লবণ, তেজপাতা, পাঁচফোড়ন, তেল, খাবার সোডা ও ঋতুভিত্তিক সবজি। যেমন কাঁঠালবিচি, কচুমুখী বা পেঁপের যেকোনো একটি।

উপকরণ (চারজনের জন্য)
চাল দেড় কাপ, ভিজিয়ে রাখা ছোলা ৩০০ গ্রাম, কাঁঠালবিচি (যে মৌসুমে যে সবজি পাওয়া যায়) ২০০ গ্রাম, হলুদ ১ চা-চামচ, গুঁড়া মরিচ ২ চা-চামচ, পরিমাণমতো লবণ, খাবার সোডা দেড় চা-চামচ, জিরাগুঁড়া দেড় চা-চামচ, তেজপাতা ৪-৫টি, লেবুপাতা ৪-৫টি, তেল ও পাঁচফোড়ন পরিমাণমতো, নেন্নামপাতা (মণিপুরিদের উৎপাদিত মসলাপাতা। এটা না দিলেও সমস্যা নেই) এবং পানি আট কাপ।

প্রণালি
পানিতে প্রথমে ছোলা ও কাঁঠালবিচি সেদ্ধ করতে হবে। কিছুক্ষণ সেদ্ধ করে নেওয়ার পর চাল, হলুদ, মরিচ, লবণ, জিরা, খাবার সোডা ৫ থেকে ৭ মিনিট পানিতে ফোটাতে হবে। চাল ফুটে গেলে পাত্রটি চুলা থেকে নামিয়ে নিতে হবে। আলাদা পাত্রে তেল গরম করতে হবে। তেল গরম হয়ে গেলে তাতে পাঁচফোড়ন, তেজপাতা দিয়ে সম্বরা (বাগার) দিতে হবে। এরপর আগের তৈরি সামগ্রী বাগার দেওয়া পাত্রে ঢেলে দিতে হবে। সব মাখামাখি হয়ে গেলে নামিয়ে নিন। এরপর মোটামুটি ঠান্ডা হয়ে গেলে পরিবেশন করতে পারেন। ‘ক্ষার’ ভাতের সঙ্গে খাওয়া হয়। সঙ্গে লাল মরিচের সিঁদলের ভর্তা থাকলে স্বাদ বেড়ে যায়। ভাত ছাড়াও গাঢ় স্যুপের মতো খাওয়া যায়। খাদ্য হিসেবে ক্ষারের একটি উপকারী দিক আছে। এটি রক্ত পরিষ্কার করে।

খুদ
খুদ

খুদ
খুদ তৈরিতে লাগে চালের গুঁড়া, টক (আমড়া বা জলপাই ইত্যাদি), ছোট চিংড়ি মাছ, সিঁদল, তেল, হলুদ, মরিচ, জিরাগুঁড়া, পাঁচফোড়ন, নেন্নামপাতা (এটি না দিলেও সমস্যা নেই), মেথি ও তেজপাতা।

উপাদান (চারজনের জন্য)
পানি ৮ কাপ, চাল দেড় কাপ (যা ব্লেন্ড শেষে পানিমিশ্রিত অবস্থায় ৩ কাপ হবে), মরিচ ২ চা-চামচ, হলুদ ১ চা-চামচ, তেজপাতা ৪টি, সিঁদল ছোট ৩-৪টি (বড় হলে ১-২টি), চিংড়ি ২০০ গ্রাম, আমড়া বা জলপাই ৪টি, জিরার গুঁড়া দেড় চা-চামচ, মেথি পরিমাণমতো এবং পাঁচফোড়ন পরিমাণমতো।

রন্ধনপ্রণালি
প্রথমে ভেজা চাল পিষে অথবা ব্লেন্ডারে গুঁড়া করে নিতে হবে। চালের গুঁড়া পানি মিশিয়ে তরল করতে হবে। অল্প তেলে জিরা, মেথি, তেজপাতা, সিঁদল শুঁটকি ভাজতে হবে। শুঁটকি অন্যান্য উপাদানের সঙ্গে মিশে গেলে আলাদাভাবে ভাজা চিংড়ি দিয়ে পানি ঢালতে হবে। পানি ফুটে গেলে হলুদ, মরিচ, লবণ, জিরার গুঁড়া এবং আমড়া বা জলপাই দিতে হবে। আমড়া বা জলপাইয়ের রস পানিতে মিশে গেলে তরল চালের গুঁড়া কড়াইয়ের এক পাশ থেকে আস্তে আস্তে ছাড়তে হবে। সঙ্গে সঙ্গে চামচ দিয়ে নাড়তে হবে, যাতে জমে না যায়। ৫ থেকে ১০ মিনিটের মধ্যে তরল অবস্থা ঘন হয়ে গেলে নামিয়ে গরম-গরম পরিবেশন করা যায়। এটির সঙ্গেও লাল মরিচের সিঁদলের ভর্তা থাকলে স্বাদ বেড়ে যায়। এটা ভাতের সঙ্গে খাওয়া হয়। এমনিতেও খাওয়া যায়।
ছবি: আকমল হোসেন