স্নাতকে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় তিন তরুণ প্রাণকে এক বিন্দুতে মিলিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ

আজ আগস্ট মাসের প্রথম রোববার—বন্ধু দিবস। পড়ুন বন্ধুত্বের একটি অন্যরকম গল্প।

সিলভিয়া নাজনীন, উচ্ছ্বাস শিকদার ও সুস্মিতা বড়ুয়া—স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই যেন তিন তরুণ প্রাণকে এক বিন্দুতে মিলিয়েছেন
ছবি: তিন বন্ধুর সৌজন্যে

সিলভিয়া নাজনীন, উচ্ছ্বাস শিকদার ও সুস্মিতা বড়ুয়া—স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই যেন তিন তরুণ প্রাণকে এক বিন্দুতে মিলিয়েছেন। ছোটবেলা থেকে তাঁরা রবীন্দ্রসংগীতের ভক্ত। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর তাঁদের আড্ডায় জায়গা করে নেন কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা থেকে শুরু করে জয়তী চক্রবর্তীর মতো শিল্পীরা। কোন পটভূমিতে কবিগুরু কোন গান লিখেছিলেন, কার কণ্ঠে আবেগ বেশি—এসব নিয়ে আলাপ চলত ঘণ্টার পর ঘণ্টা। গানের আড্ডা থেকে জন্ম নেয় এক গাঢ় বন্ধুত্ব।

সিলভিয়া, উচ্ছ্বাস ও সুস্মিতা—তিনজনই জিন প্রকৌশল ও জীবপ্রযুক্তি বিভাগের শিক্ষার্থী। স্নাতকে যথাক্রমে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় হয়েছিলেন। সিলভিয়া পেয়েছেন সিজিপিএ ৪-এর মধ্যে ৩ দশমিক ৯৮, উচ্ছ্বাস ও সুস্মিতা পেয়েছেন ৩ দশমিক ৯৬। ভালো ফলের সুবাদে বেশ কিছু শিক্ষাবৃত্তি ও সম্মাননাও পেয়েছেন তাঁরা। এখন তাঁরা স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী।

আরও পড়ুন

ক্যাম্পাসের দিনগুলি

শহর থেকে প্রায় ২২ কিলোমিটার দূরত্বে পাহাড়–টিলাঘেরা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। চারদিকে গাছ, ফাঁকে ফাঁকে সুবিশাল সব অনুষদ ভবন ও অন্যান্য স্থাপনা। শুরুর দিন থেকেই ক্যাম্পাসের প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন তিন বন্ধু। ক্যাম্পাসের ঝুপড়িতেই কাটে তাঁদের বেশির ভাগ সময়। এখনো বৃষ্টির দিনে পাহাড়ে ছুটে যান তাঁরা। পাহাড়ের রাস্তায় রাস্তায় কাটে শীতের সন্ধ্যা। নিয়ন আলোয় সুস্মিতা ও সিলভিয়া গেয়ে ওঠেন ‘পুরোনো সেই দিনের কথা’। গিটারে সুর তোলেন উচ্ছ্বাস। একসঙ্গে রান্না করে খাওয়া, ঘুরে বেড়ানো, ঝুপড়িতে টেবিল চাপড়ে গান গাওয়া; এসব তাঁদের নিত্যদিনের স্মৃতি।

স্নাতকে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় হয়েছেন তিন বন্ধু
ছবি: তিন বন্ধুর সৌজন্যে

গবেষণার টেবিলে

ক্লাসে গবেষণা নিয়ে তাঁরা টুকটাক আলোচনা করতেন। এমন বিষয় নিয়েই কাজ করতে চাইছিলেন, যেটি জনগুরুত্বপূর্ণ। অবশেষে বছর দু-এক আগে সিদ্ধান্ত নেন, চট্টগ্রামে ডেঙ্গুর প্রকোপ নিয়ে কাজ করবেন। সেই ভাবনা থেকেই বেরিয়ে পড়েন, সংগ্রহ করেন নানা তথ্য। দিনরাত এক করে গবেষণাগারে সময় দিয়েছেন তিন বন্ধু। ইউরোপিয়ান জার্নাল অব মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড ইমিউনোলজি–তে প্রকাশিত হয়েছে তাঁদের গবেষণা প্রবন্ধ। তিন বন্ধু জানালেন, চট্টগ্রামে ডেঙ্গুর কোন ধরন বেশি ছড়িয়ে পড়ছিল, উপসর্গ কী কী দেখা যাচ্ছিল, কোন বয়সের মানুষ বেশি আক্রান্ত হচ্ছিলেন—এসবই উঠে এসেছে গবেষণায়। পাঁচটি হাসপাতালের চিকিৎসকদের সঙ্গে যৌথভাবে কাজটা করেছিলেন তাঁরা। শিখেছেন গবেষণার খুঁটিনাটি।

ল্যাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে গিয়ে অনেক সময় ব্যর্থ হয়েছেন, তবে হাল ছাড়েননি। তিনজনের যৌথ প্রচেষ্টায় ঠিকই সমাধান বের হয়েছে। হতাশার দিনগুলোতে একে অন্যের পাশে থেকেছেন। যখনই দুশ্চিন্তা ভর করেছে, বন্ধুত্বই ছিল ভরসা।

আরও পড়ুন

বিপদের বন্ধু

শুধু গবেষণাই নয়, বিভিন্ন কর্মশালা ও প্রতিযোগিতায়ও একসঙ্গে অংশ নেন সিলভিয়া, উচ্ছ্বাস ও সুস্মিতা। গত বছর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত উদ্ভাবন প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয় তিনজনের দল। মৎস্য ক্ষেত্রে উদ্যোক্তাদের জন্য টিকা উদ্ভাবনের ধারণা দিয়ে পুরস্কার জেতেন তাঁরা।

বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সঙ্গেও যুক্ত তিন বন্ধু। সুস্মিতা বলছিলেন, ‘দুর্গম গ্রামের স্কুলগুলোতে গিয়ে আমরা শিশুদের সঙ্গে সময় কাটাই, তাদের বিজ্ঞানের বিভিন্ন প্রকল্প দেখাই। মহাকাশ সম্পর্কে যখন মজার মজার তথ্য দিই, শিশুদের উচ্ছ্বাস হয় দেখার মতো। ওদের কৌতূহলোদ্দীপক প্রশ্ন আমাদেরও উৎসাহ বাড়িয়ে দেয়।’

একসঙ্গে ঘুরতে যাওয়ার রঙিন স্মৃতিও আছে অনেক। কাপ্তাই থেকে কক্সবাজার, সুন্দরবন থেকে সেন্ট মার্টিন—অনেক জায়গাই চষে বেড়িয়েছেন তাঁরা। সুস্মিতা বলেন, ‘পেছনে ফেলে আসা এসব ছবি দেখে পরের ভ্রমণের তারিখ ঠিক করি। আবার বেরিয়ে পড়ি। পরিবারের সদস্যরাও কোনো প্রশ্ন তোলেন না। কারণ, তাঁরা আমাদের বন্ধুত্ব সম্পর্কে জানেন। আমাদের তিন পরিবারের মধ্যেও যোগাযোগ আছে।’

তিন বন্ধু জানালেন, তাঁদের পছন্দ-অপছন্দে মিল যেমন আছে, তেমনি অমিলও আছে। সিলভিয়া ধীরস্থির ও চিন্তাশীল। উচ্ছ্বাস প্রাণবন্ত ও রসবোধে ভরপুর। আর সুস্মিতা আবেগপ্রবণ, গভীর পর্যবেক্ষণক্ষম। এই বৈচিত্র্যই তাঁদের বন্ধুত্বকে ভারসাম্যপূর্ণ করেছে।

উচ্ছ্বাস জানালেন, দীর্ঘদিন ধরে ক্যানসারে আক্রান্ত তাঁর বাবা। এমনও হয়েছে, মাসের পর মাস হাসপাতালের বারান্দায় পড়ে থাকতে হয়েছে। পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়াটাও কঠিন হয়ে পড়েছে। কিন্তু সব সময় পাশে থেকে প্রেরণা জুগিয়ে গেছেন সিলভিয়া ও সুস্মিতা। তাঁরা দুজন নোট তৈরি করে দিতেন। ক্লাসের পড়া গুছিয়ে দিতেন। বিপদে পাশে থাকাই তাঁদের বন্ধুত্বের বড় শক্তি।

আরও পড়ুন