মা-বাবা হিসেবে যে ৮টি বদভ্যাস এড়িয়ে চলা জরুরি

নিজের অজান্তে হয়ে যাওয়া কিছু আচরণ মাঝেমধ্যে মা–বাবা ও সন্তানের মাঝখানে দেয়াল তুলে দেয়
ছবি: প্রথম আলো

মা–বাবা মানে শুধু একটি সামাজিক পরিচয় নয়, এটি একটি দায়িত্ব, একটি সম্পর্ক, জীবনভর চলতে শেখার যাত্রা। সন্তানের চোখে মা–বাবা মানে নির্ভরতা, শক্তি আর ভালোবাসার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উৎস।

কিন্তু সব মা–বাবা কি সেই ভূমিকা ঠিকভাবে পালন করতে পারেন? ব্যস্ততা, ক্লান্তি বা নিজের অজান্তে হয়ে যাওয়া কিছু আচরণ মাঝেমধ্যে মা–বাবা ও সন্তানের মাঝখানে দেয়াল তুলে দেয়। কিছু অভ্যাস, যেসব হয়তো আমাদের চোখেই পড়ে না, ধীরে ধীরে সন্তানের মনে তৈরি করে হতাশা, ভয় বা দূরত্ব। চলুন জেনে নিই মা–বাবা হিসেবে যে ৮ টি অভ্যাস এড়িয়ে চলা জরুরি।

আরও পড়ুন
সন্তানের সঙ্গে চিৎকার–চেঁচামেচি করলে তার মনে মনে ভীতি ও দূরত্ব সৃষ্টি করে।
ছবি: প্রথম আলো

১. সন্তানের প্রয়োজনের প্রতি উদাসীনতা

সন্তান স্কুল থেকে এসেই উত্তেজনায় সারা দিন কী কী হলো বলার চেষ্টা করছে, অথচ আপনি ফোনে স্ক্রল করছেন বা টিভিতে মগ্ন। মুখে শুধু ‘হুম’ বলে আবার আগের কাজেই ডুবে যান। এটাই হলো অবহেলা বা উদাসীনতা। সন্তানদের স্বাভাবিকভাবেই ভালোবাসা, যত্ন আর মনোযোগের প্রয়োজন হয়। তারা চায় আপনি শুধু শারীরিকভাবে নয়, তার আবেগের অংশ হন।

যা করবেন

সন্তান কথা বলতে চাইলে ফোন বা রিমোটটা নামিয়ে রেখে পুরো মনোযোগ দিন। ওদের পছন্দের কাজগুলোয় সময় দিন, হোক সেটা ভিডিও গেম খেলা বা প্রিয় গল্পটা পড়ে শোনানো।

২. অতিরিক্ত উদ্বিগ্নতা ও ধৈর্যহীনতা

ধরুন, আপনি সন্তানকে সাইকেল চালানো শেখাচ্ছেন। ও বারবার পড়ে যাচ্ছে, আবার উঠে দাঁড়াচ্ছে। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আপনি অস্থির হয়ে বলছেন, ‘এখনো শিখতে পারলে না?’এ ধরনের আচরণে সন্তান শেখে না, বরং ভয়ে সংকুচিত হয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে সে ভাবতে শুরু করে আমি পারি না। তাই কিছু শেখার সময় চাপ নয়, প্রয়োজন সহানুভূতি।

যা করবেন

শেখার বেলায় সন্তানের ছোট অগ্রগতিতে উৎসাহ দিন। ভুল হলে বলুন, ‘ভুল হতেই পারে, শেখাটাই আসল।’ এই সহানুভূতিশীল মনোভাব ওদের আত্মবিশ্বাস বাড়ায়।

সন্তানের সঙ্গে বন্ধুর মতো সম্পর্ক রাখুন
ছবি: প্রথম আলো

৩. এক সন্তানের প্রতি পক্ষপাত

মা–বাবা চান সন্তানেরা যেন তাকে ভালোবাসে, বিশ্বাস করে এবং তাঁদের নির্ভরতার প্রতীক হিসেবে দেখে। কিন্তু যদি একজন সন্তানের প্রতি বেশি ঝুঁকে পড়েন, তাহলে অন্যজনের মনে তৈরি হতে পারে অবহেলার গভীর ক্ষত। প্রতিটি সন্তানের সঙ্গে মা–বাবার সম্পর্ক ভিন্ন হতে পারে। কারণ, সন্তানদের গুণাগুণ, চাহিদা, স্বভাব তো এক নয়। তবু যখন আপনি একজনকে বারবার প্রশংসা করেন, সময় দেন, ভালোবাসা দেখান আর অন্যজনকে বঞ্চিত করেন, তখন ওর মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, ‘মা–বাবা কি তাহলে আমাকে ততটা ভালোবাসে না?’

যা করবেন

কারও কোনো ভালো দিকের প্রশংসা করুন, কিন্তু অন্যজনকে অবহেলা করবেন না। সন্তানেরা যেন বুঝতে পারে, তাদের সবাইকেই আপনি সমান ভালোবাসেন।

৪. শাস্তি দিতে গিয়ে অতিরিক্ত কড়াকড়ি

সন্তান হয়তো বিছানায় পানি ফেলে দিয়েছে বা হোমওয়ার্ক করতে ভুলে গেছে, তখন আপনি চিৎকার–চেঁচামেচি করলেন। রাগ করে চড়থাপ্পড় দিলেন। আবার দিন সাতেকের জন‌্য কথা বলা বন্ধ করে বা দীর্ঘ সময়ের জন‌্য খেলাধুলা বন্ধ করে দিলেন। এই অতিকঠোর শাস্তি উল্টো ফল দিতে পারে। এটা সন্তানের মনে ভীতি ও দূরত্ব সৃষ্টি করে।

যা করবেন

ভুল হলে শান্তভাবে বোঝান, কেন এটা ঠিক নয় এবং কীভাবে ওটা ঠিক করা যায়। শাস্তির বদলে শেখার সুযোগ তৈরি করুন। তবেই গড়ে উঠবে বিশ্বাস ও জবাবদিহির সম্পর্ক।

আরও পড়ুন
সন্তানকে সময় না দিলে সে একরোখা হয়ে উঠবে
ছবি: প্রথম আলো

৫. সন্তানের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ রাখা

আপনার সন্তান হয়তো কিছু বলার জন্য মুখ খুলেছে, কিন্তু আপনি বলে উঠলেন, ‘এখন না, পরে কথা বলব।’ এই ‘পরে’ আর কখনো আসে না। এভাবে চললে সন্তান মনে করতে শুরু করে, তার অনুভূতি বা চিন্তা আপনার কাছে গুরুত্বহীন।

যা করবেন

ব্যাপারটা ছোট হলেও সন্তান যখন কথা বলতে চায়, সময় দিন। ও যেন নিশ্চিন্তে কথা বলতে পারে, এমন এক নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করুন। এটাই গড়ে তোলে গভীর আত্মিক সম্পর্ক।

৬. সন্তানের অনুভূতিকে অবহেলা করা

সন্তান কষ্ট নিয়ে কিছু বলল, আর আপনি বললেন, ‘ওসব নিয়ে ভেবো না।’ এটাই হলো অনুভূতির অগ্রাহ্য। এভাবে ওর অনুভূতিকে হালকাভাবে নিলে ও ভাবতে শুরু করে নিজের আবেগ লুকিয়ে রাখাই ভালো।

যা করবেন

শিশুর কথা মন দিয়ে শুনুন। ওকে জিজ্ঞাসা করুন, ‘কী হয়েছে? কষ্ট লাগছে কেন?’ এমনভাবে শুনুন, যাতে ওর মনে হয়, ওর কথা আপনি সত্যিই গুরুত্ব দিয়ে শুনছেন। এটাই ওর ভেতরে গড়ে তোলে নিরাপত্তা ও আবেগ বোঝার ক্ষমতা।

সন্তানের সুস্থ মানসিক জীবন গঠনের দায়িত্ব মা–বাবা দুজনকেই নিতে হয়
ছবি: প্রথম আলো

৭. সব সময় খুঁত ধরা ও সমালোচনা করা

সন্তান আনন্দ নিয়ে ছবি দেখাতে এল, আর আপনি শুরু করলেন ভুল ধরতে—‘এটা ঠিক হয়নি, ওটা আরও ভালো করা যেত।’ এ রকম বারবার সমালোচনা ওর আত্মবিশ্বাস নষ্ট করে।

যা করবেন

প্রথমে প্রশংসা করুন—‘চমৎকার চেষ্টা করেছ!’ তারপর হালকা করে বলুন, কীভাবে আরও ভালো হতে পারে। ও যেন বুঝতে পারে, আপনি সাহায্য করতে চান, হতাশ করতে নয়।

৮. নিজের আচরণ দিয়ে খারাপ উদাহরণ তৈরি করা

আপনি চাইছেন সন্তান দয়ালু, সৎ হোক; অথচ নিজে অসৎ বা নিষ্ঠুর আচরণ করছেন। তাহলে কী হবে? আর সন্তানেরা যা দেখে, তা–ই শেখে। আপনি যা করেন, সেটাই ওদের চোখে সত্যি।

যা করবেন

নিজে আদর্শ হয়ে উঠুন। সম্মান, সহানুভূতি, সততা—যেটাই শেখাতে চান, আগে নিজে সেই গুণগুলো অনুসরণ করার চেষ্টা করুন।

সবশেষে

একটু ভাবুন তো, এই ৮টি বদভ্যাসের কোনোটা কি আপনার মধ্যেও আছে? থেকে থাকলে পরিবর্তন করুন। পরিবর্তন রাতারাতি আসবে না, কিন্তু ছোট ছোট পদক্ষেপই বড় রূপ নেয়। আজ থেকেই শুরু করুন। সন্তানের পাশে থাকুন, তাদের কথা শুনুন, ভালোবাসুন, সন্তানকে বুঝুন আর বাস্তবসম্মত প্রত্যাশা রাখুন।

সূত্র: পিওর লাভ

আরও পড়ুন