স্কুলজীবন শেষ? পরের ধাপে পা রাখার আগে আয়মান সাদিকের ৫ পরামর্শ
কদিন আগেই বেরিয়েছে এসএসসি পরীক্ষার ফল। কলেজজীবনে পা রাখার অপেক্ষায় দেশের লাখো শিক্ষার্থী। স্কুল আর বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ‘সেতু’ হিসেবে কাজ করে কলেজ। যদিও সময়টা খুব কম, মাত্র দুই বছর। কীভাবে এই দুইটা বছর কাজে লাগানো উচিত? কেন সময়টা গুরুত্বপূর্ণ? লিখেছেন টেন মিনিট স্কুলের সহপ্রতিষ্ঠাতা আয়মান সাদিক
এসএসসির রেজাল্ট হাতে পেয়ে গেছ। কারও রেজাল্ট মনের মতো হয়েছে, কারও হয়নি। কিন্তু এখন এটা নিয়ে আদতে মন খারাপ করার সময় নেই। জীবনের অনেক বড় একটা অধ্যায়, ১০ বছরের স্কুলজীবন তোমরা পেরিয়ে এসেছ—অভিনন্দন!
এবার নতুন একটা শুরুর পালা। হ্যাঁ, রেজাল্টের কারণে অনেকেই হয়তো মনমতো কলেজে পড়তে পারবে না। যেটা তোমার হাতে নেই, সেটা নিয়ে আফসোস না করে সামনে যেন রেজাল্ট ভালো হয়, সে জন্য বুদ্ধিদীপ্ত পরিকল্পনা করে এগোতে হবে।
কলেজজীবন—ছোট্ট একটা সময়। শুরু করতে না করতেই শেষ হয়ে যাবে। তাই শুরু করার আগে তোমাদের জন্য ছোট্ট কয়েকটা পরামর্শ।
১. কলেজ বাছাই কীভাবে করব?
আমাদের দেশের স্বনামধন্য তিনটি কলেজে এখনো ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থী বাছাই করা হয়—নটর ডেম কলেজ, হলি ক্রস কলেজ ও সেন্ট যোসেফ উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়। তুমি যদি এই তিন কলেজের কোনোটায় পড়তে চাও, তাহলে ভালোভাবে প্রস্তুতি নিয়ে তারপর ভর্তি পরীক্ষা দিয়ো। প্রস্তুতি না নিয়ে এ ধরনের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় বসাটা বোকামি।
আর এই তিন কলেজের বাইরে অন্য কলেজ বাছাই করার সময় তোমার বাসা থেকে কলেজের দূরত্ব মাথায় রেখো। যানজটে পড়ে যদি যাওয়া-আসাতেই দিনের অনেকটা সময় চলে যায়, তাহলে সেটার চাপ শরীরের ওপর তো পড়বেই, সেই সঙ্গে বাসায় পড়ার জন্যও সময় কম পাবে। যে সময়টা রাস্তায় যানজটে নষ্ট হয়, সেটুকু বাসায় পড়লে প্রস্তুতি এগোয় অনেক। মনে রেখো, কলেজজীবনে সময় অনেক কম, পড়া অনেক বেশি।
এই একটা কারণে আমার ছোট ভাইকে আমি আমাদের বাসা থেকে ৫ মিনিট দূরত্বের একটি কলেজে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলাম। ওর কিন্তু দিন শেষে রেজাল্ট বেশ ভালো হয়েছিল। কারণ, কলেজে যাওয়া–আসার পেছনে ওর অনেক কম সময় লাগত। তাই ও বাসায় পড়ার জন্য অনেকখানি সময় পেত।
তাই যে কলেজগুলোই তোমার পছন্দের তালিকায় রাখছ, খোঁজ নিয়ে দেখো সেগুলো তোমার বাসা থেকে কতটুকু দূরে, যেতে-আসতে সময় কতখানি লাগে? কম সময় ও খরচে যাতায়াতের উপায় কী?
২. চতুর্থ বিষয় কী নেব?
এইচএসসিতে চতুর্থ বিষয় বাছাই করতে গিয়েও অনেকে ভাবনায় পড়ে। তুমি কি মেডিকেলে পড়তে চাও? তোমার কি জীববিজ্ঞান পড়তে ভালো লাগে?
এসএসসিতে যে বিষয়গুলো একটা করে পেপার পড়েছ, সেগুলো কিন্তু দুইটা করে পড়া লাগবে। সিলেবাসও বেশ বড়। যদি মেডিকেলে পড়ার পরিকল্পনা না থাকে আর জীববিজ্ঞান পড়তে ভালো না লাগে, তাহলে শুধু বন্ধুরা নিচ্ছে বলে তুমিও নিয়ে নিয়ো না।
আমার মেডিকেলে পড়ার কোনো পরিকল্পনা ছিল না, জীববিজ্ঞান পড়তেও খুব একটা ভালো লাগত না। পুরো কলেজজীবন আফসোস করেছিলাম জীববিজ্ঞান নিয়ে।
দেখো আর কী কী বিষয় আছে? কোনটায় সিলেবাস কতটুকু? ব্যবহারিকে কত নম্বর থাকে? এই কৌশলগত সিদ্ধান্তগুলো কলেজ শুরুর আগে নেওয়া থাকলে পরের সময়টা অনেক সহজ হয়। আমার ভাই শুরু থেকেই ঠিক করেছিল, এইচএসসির পরে ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় অথবা আইবিএতে (ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউট) পড়বে।
এই দুটি ক্ষেত্রের সঙ্গে জীববিজ্ঞানের যোগাযোগ নেই। এইচএসসিতে আমি ওকে তাই জীববিজ্ঞান না নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলাম। তা ছাড়া ওর কলেজে চতুর্থ বিষয় হিসেবে ‘ইঞ্জিনিয়ারিং ড্রয়িং’ নেওয়া যেত, যেখানে ব্যবহারিকেই ১৬০ নম্বর। শুধু ব্যবহারিক দিয়েই খুব সহজে ‘এ প্লাস’ তুলে ফেলা যেত। এই পরামর্শের জন্য আমার ভাই আমাকে এখনো ধন্যবাদ দেয়!
৩. এইচএসসির পরে কোথায় পড়ব?
অনেকে ভাবে এইচএসসির পরের পরিকল্পনা পরেই করতে হয়। ভুল! এইচএসসির পরে কোথায় পড়তে চাও—সেটা কলেজ শুরুর আগেই ঠিক করে রাখো। কারণ, এইচএসসি পরীক্ষার পরের চার মাস কোনোভাবেই ভর্তি প্রস্তুতির জন্য যথেষ্ট নয়।
যদি তোমার পরিকল্পনাই না থাকে যে তুমি কিসের জন্য প্রস্তুতি নেবে—তাহলে তো আরও না! পরিকল্পনা গোছাতে গোছাতেই দেখবে তিন মাসের অর্ধেক শেষ। তাই তুমি প্রকৌশলে পড়তে চাও, নাকি মেডিকেল, দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে নাকি দেশের বাইরে—আগে থেকে ঠিক করো। যেখানেই পড়তে যাও না কেন, ভর্তি পরীক্ষার সিলেবাস কিন্তু অনেকটা উচ্চমাধ্যমিকের সিলেবাসের মতো।
তাই কলেজ শুরুর আগেই পরিকল্পনা ঠিক করে একসঙ্গে বোর্ড পরীক্ষা আর ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়াটা সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ।
কীভাবে পরিকল্পনা করবে, সেটারও একটা সহজ উপায় বলি। বিগত বছরের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নগুলো দেখো, দেখো কোন ক্ষেত্রে কেমন প্রশ্ন হয়। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্ন কেমন? মেডিকেলের প্রশ্ন কেমন? পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশ্ন কেমন? কোনগুলোর প্রস্তুতি নেওয়া তোমার জন্য তুলনামূলক সহজ?
কোন প্রশ্নগুলো দেখে তুমি আগ্রহ পাচ্ছ? এসব ভেবে সিদ্ধান্ত নাও। দেশের বাইরে পড়তে যেতে চাইলে আইইএলটিএস, জিআরই বা অন্য যেটাই দরকার—প্রস্তুতি নাও। বৃত্তি, বিশ্ববিদ্যালয়, বিষয় আর কোর্সগুলো নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করো। এইচএসসির পর যখন প্রস্তুতি শুরু করবে, দেখবে তোমার জন্য অনেক কিছুই সহজ হয়ে যাবে।
৪. কোন বিষয়ে কতটুকু গুরুত্ব দেব?
এইচএসসিতে তোমাদের চতুর্থ বিষয়সহ মোট ৭টি করে বিষয় থাকে। আইসিটি অর্থাৎ তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বাদ দিয়ে বাকি বিষয়গুলোতে ২টি করে পেপার থাকে।
মোট ১৩টা বিষয় পড়তে হয়। বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষার বিভাগভিত্তিক বিষয়গুলো বাদ দিয়ে সবার জন্য কমন থাকে ৩টি বিষয়—বাংলা, ইংরেজি ও আইসিটি—মোট ৫টি পেপার। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই বিষয়গুলোকেই কলেজজীবনে শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে কম গুরুত্ব দেয় এবং শেষমেশ এই বিষয়গুলোতেই এ প্লাস মিস করে।
এই সংকট থেকে বাঁচার বুদ্ধি হলো—কলেজজীবনের শুরুর দিকে যখন অন্য বিষয়গুলো পড়ার চাপ কম থাকে, তখনই এই বিষয়গুলো পড়ে শেষ করে ফেলা। হ্যাঁ, অনেকে বোর্ড পরীক্ষার একদম কাছাকাছি পৌঁছে এই বিষয়গুলোয় মন দেয়।
কিন্তু তখন আদতে বাকি সব বিষয়েরও সমান চাপ থাকে। তাই আগেভাগেই বাংলা, ইংরেজি, আইসিটির প্রস্তুতিটা এগিয়ে রাখলে এইচএসসি পরীক্ষার আগে চাপটা কম পড়ে। মনে রেখো, কলেজজীবনে প্রস্তুতির সময় খুব সীমিত।
খুব মেপে মেপে এই সময় কাজে না লাগালেই রেজাল্টে এর প্রভাব পড়ে। টেনেটুনে মাত্র ১৮ মাস সময়, ওই দিকে সিলেবাস প্রায় ৩ গুণ! তাই বুঝেশুনে পরিকল্পনা করা খুব জরুরি।
৫. কারা আমার বন্ধু
এখন যে পরামর্শটা দেব, সেটা ঠিক এইচএসসি বা ভর্তি প্রস্তুতির সঙ্গে সম্পৃক্ত না। তবে এটা তোমার সারা জীবন কাজে লাগবে।
আমার একটা খুব প্রিয় উক্তি আছে, ‘ইউ আর দ্য এভারেজ অব ফাইভ পিপল ইউ স্পেন্ড মোস্ট টাইম উইথ’। অর্থাৎ তুমি আদতে সেই পাঁচজনের গড়, যাঁদের সঙ্গে তুমি সবচেয়ে বেশি সময় কাটাও।
কথাটা আমি আমার কাছের সবাইকে বলি। নিজেও মেনে চলার খুব চেষ্টা করি। তোমার জীবনে, তোমার অভ্যাসে, তোমার চিন্তাভাবনায়, তোমার মতামতে, তোমার সিদ্ধান্তের ওপর তোমার আশপাশের মানুষের প্রভাব অনেক বেশি।
তুমি যাদের সঙ্গে মিশবে, তোমার কাজে তাদের প্রভাব থাকবেই। তুমি যদি সারাক্ষণ ঘুরে বেড়ানো, গল্প করা, গসিপে ব্যস্ত বন্ধুদের সঙ্গে থাকো, তাহলে তোমার মাথায় নেতিবাচকতা ছাড়া কিছুই আসবে না। আবার তুমি যদি অনেক স্বপ্নবাজ, দক্ষ, অনুপ্রেরণাদায়ী, সব সময় নতুন কিছু না কিছু করছে-শিখছে—এমন বন্ধুদের সঙ্গে থাকো, তাহলে দেখবে তুমিও তাঁদের মতোই হয়ে যাচ্ছ।
কলেজজীবনটা একটা রূপান্তরের সময়। টানা ১০ বছরের অভ্যাস বদলায় কলেজে এসে। এই সময় সবাই ঠিকঠাক সামাল দিতে পারে না। স্কুলের অনেক বন্ধু তোমার সঙ্গে একই কলেজে থাকবে না। কলেজে এসে তাদের সঙ্গেই নতুন করে বন্ধুত্ব হবে, যাদের সঙ্গে প্রথম দুই-তিন দিন বা সপ্তাহখানেক দেখাসাক্ষাৎ বা ঘোরাফেরা হবে।
সব সময় এভাবে বন্ধু বাছাই করাটা ঠিক না-ও হতে পারে। তাই কাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করছ, বুঝেশুনে সিদ্ধান্ত নিয়ো। কারণ, পরে অনেক সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রেই এই বন্ধুদের থেকে প্রভাবিত হওয়ার সম্ভাবনা (কিংবা আশঙ্কা) অনেক।
মজার ব্যাপার হলো, আমার চেয়ে তিন বছরের ছোট ভাই সাদমানকে আমি এই পরামর্শগুলোই দিয়েছিলাম একদম ওর কলেজ শুরুর আগেই। এই পরামর্শগুলোর স্রেফ মনগড়া ছিল, তা নয়। সব কটিই নিজের আর আশপাশের বন্ধুদের অভিজ্ঞতা থেকে দেওয়া। আশা করি, তোমাদেরও কাজে লাগবে। জীবনের নতুন এই অধ্যায় শুরুর আগে তোমাদের সবার জন্য অনেক শুভকামনা। মনে রাখার মতো একটা চমৎকার কলেজজীবন কাটুক তোমার।