দাদুভাইয়ের লাল টালিখাতা যেভাবে নতুন করে আমায় ভাবতে শেখাল
আমার দাদুভাইয়ের একটি টালিখাতা ছিল। টালিখাতা বোঝেন তো? ওই যে লম্বা চিকন খাতা, লাল কাপড়ে মোড়ানো। আগের দিন ব্যবসায়ীরা যাতে হিসাব রাখতেন। কেউ আবার লিখে রাখতেন সংসারের জমা–খরচ। আর আমার দাদুভাই শেখ হোসেন আলী মুনশি ওই টালিখাতায় লিখে রাখতেন তাঁর পরিবারে জন্ম নেওয়া নতুন সদস্যদের জন্মের খুঁটিনাটি। যেখানে লেখা থাকত শিশুটির জন্মের ক্ষণ; বাংলা, ইংরেজি ও আরবি তারিখ আর কার সন্তান হিসেবে তার জন্ম। আরও লেখা আছে আমাদের পূর্বপুরুষদের নাম।
সেদিন ঝটিকা সফরে এক দিনের জন্য গিয়েছিলাম আমার বাড়ি যশোর জেলার শার্শা থানার নাভারনে। ঢাকা থেকেই ভেবেছিলাম, দাদুভাইয়ের লাল খাতাটা নিয়ে আসব। যেহেতু আমার বাবা-চাচাদের বয়স হয়েছে, পরিবারের বড় মেয়ে হিসেবে ওটা আমার জিম্মাতেই থাকা উচিত বলে মনে হচ্ছিল। বাড়িতে গিয়েই নোয়া কাকার (৪ নম্বর চাচা) কাছে খাতাটার খোঁজ করলাম। কাকা বললেন, খাতার কাগজগুলো পুরোনো হয়ে লেখাগুলো বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছিল। তখন কয়েক বছর আগে আমার ছোট দাদুভাই মানে দাদুভাইয়ের ছোট ভাই সেই লেখাগুলো আবারও লেখেন এবং পুরান খাতার পাতাগুলো খুলে লেমিনেট করে আনেন।
আমাকে সেই লেমিনেট করা পাতাগুলোই দিলেন কাকা। পাতাগুলো হাতে নিয়ে আমার কেমন যেন অনুভূতি হচ্ছিল। সেই ছোট দাদুভাই, যিনি জন্মেছেন ১৯৩৭ সালে, তাঁর জন্মের খুঁটিনাটি লেখা রয়েছে তাতে। ভাবতেই গায়ের লোম খাড়া হয়ে যাচ্ছিল, ৮৮ বছর আগের কোনো এক দিন আমার দাদুভাইয়ের লেখা কিছু তথ্য–সংবলিত একটি কাগজ আমি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছি!
আরেকটি পাতায় লেখা রয়েছে, ‘সন ১৩৫৭, সাল ইং ১৯৫০, ৯ই পৌষ ২৫ ডিসেম্বর, সোমবার রাত অনুমান ৪-সাড়ে ৪টায় জন্ম শেখ মো. আব্দুল মাবুদ মিয়ার।’
এই শেখ আব্দুল মাবুদ আমার বাবা। মনে মনে কনকনে ঠান্ডা সেই ভোররাতের কথা ভাবতে বসে যাই। যখন তীব্র প্রসবযন্ত্রণার পর তাঁর দ্বিতীয় পুত্রসন্তানকে জন্ম দিচ্ছেন দাদিমা। মনে হচ্ছিল যেন, সেই রাতটি অনুভব করতে পারছি। দেখতে পাচ্ছি, নাভারনের উত্তর বুরুজবাগানের এক গৃহস্থ পরিবারে সন্তান জন্মের উত্তেজনা ও আনন্দ। টালিখাতার একেকটি পাতা আমার ভেতরে যে অনুভূতির জন্ম দিয়েছে, আমাকে যে শান্তি দিয়েছে, কখনোই তা টাকা দিয়ে কেনা যায় না, পাওয়া যায় না।
পুরোনো–মলিন হয়ে যাওয়া খাতার পাতাগুলো নিয়ে পূর্বপুরুষদের প্রতি কৃতজ্ঞতায় মনটা ভরে ওঠে। আমার দাদুভাই, যিনি বিশেষ কোনো লেখাপড়ায় শিক্ষিত ছিলেন না; কিন্তু তার অসম্ভব দূরদর্শী মন ছিল। যার কারণে এখন আমি জানি, আমার বাংলা জন্মতারিখ ৪ ভাদ্র আর আরবি ২৩ জিলকদ।
২০২৫ সালে, যখন আমরা এতটাই ডিজিটাল হয়ে গেছি যে ছবির অ্যালবামও ডিজিটাল। আজকাল ছবি প্রিন্ট না করে জমিয়ে রাখছি হার্ডডিস্কে কিংবা প্রকাশ করছি ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে। তারপর কোনো দিন হার্ডডিস্ক ক্রাশ করলে সব স্মৃতি হারিয়ে হায় হায় করছি কিংবা ফেসবুক হ্যাক হলে স্মৃতিগুলোর জন্য কাতর হয়ে উঠছি; কিন্তু তখন আর কিছুই করার থাকছে না।
কিছুদিন আগে আমার পরিচিত একজনের মুঠোফোনটি ছিনতাই হয়। সেই সঙ্গে হারিয়ে গেছে ওর পুরোনো ফেসবুক অ্যাকাউন্ট।
সেই পরিচিতজন বলছিল ‘ফোন হারানোর চেয়ে কষ্ট লাগে ওই ফেসবুক অ্যাকাউন্টের জন্য। ওখানে আমার মেয়ের বিভিন্ন বয়সের নানা স্মৃতি রেখে দিয়েছিলাম। ওই অ্যাকাউন্টটা আর ফিরে পাইনি, তাই ছবিগুলোও হারিয়ে গেছে। মেয়েটা বড় হয়ে এসব স্মৃতি আর দেখতে পাবে না—এটা ভেবে খুব মন খারাপ হয়।’
ভেবে দেখলাম, আমিও তো গত আট বছরে আমার ছেলের তেমন কোনো ছবি প্রিন্ট করিনি। যেহেতু সব ছবি হার্ডড্রাইভ বা ফেসবুকে আছেই, তাই প্রিন্ট করার তেমন আগ্রহ হয়নি। এমনকি অ্যালবাম কিনেও কেবল প্রিন্ট করার আলসেমিতে সেটি ভরা হয়নি।
অথচ এই আমারই এমন একটি অ্যালবাম আছে, যেখানে আমার জন্মের পর থেকে প্রতি মাসের একটি ছবি পরপর সাজিয়ে রাখা আছে। প্রতিটি ছবির পেছনে দেওয়া আছে তারিখ। সে সময় আমাদের ক্যামেরা ছিল না। প্রতি মাসে স্টুডিও থেকে লোক ডাকিয়ে এনে ছবি তোলাতেন আম্মু। তারপর তো আমার ছবি তোলার জন্য বহু আয়োজন করে একটি ক্যামেরাই কেনা হলো। আমার মুখেভাত অনুষ্ঠান, প্রথম স্কুলে যাওয়া, প্রথম সাগরে নামা, প্রতিটি জন্মদিন, প্রতিটি অর্জনের ছবি আছে আম্মুর ভান্ডারে।
আমিও ছেলের সব মুহূর্তের ছবি তুলেছি; কিন্তু সেগুলো রয়ে গেছে ক্যামেরা বা মুঠোফোনের মেমোরিতে। প্রিন্ট করে আর হাতে ওঠেনি! মাঝেমধে৵ই ভয় হয়, যদি হার্ডডিস্কটা হারিয়ে যায় বা নষ্ট হয়ে যায়? আমার ছেলের সব স্মৃতি তো তাহলে শেষ হয়ে যাবে!
আমার বোনের সঙ্গী নাঈম রহমানের যেমনটা হয়েছিল। ওর বাবার শেষ জীবনের প্রায় সব ছবিই ছিল ল্যাপটপে। হুট করে একদিন সেই ল্যাপটপ চুরি হয়ে যায়। ফলে বাবার সব স্মৃতি চলে যায়। এখনো সেসব কথা বলে আবেগপ্রবণ হয় নাঈম, বাবার ছবিগুলো হারানোর কষ্ট কোনোভাবেই সে ভুলতে পারে না।
আমাদের আগের প্রজন্মের মানুষ প্রচুর ডায়েরি আর চিঠি লিখতেন। এভাবে তাঁদের আবেগগুলো সহজেই পৌঁছে যেত পরের প্রজন্মের কাছে, প্রিয়জনের কাছে; কিন্তু আমরা এখন ইমেইল করি, মেসেঞ্জারে টেক্সট করি। তবে চিঠির যে আবেগ, যে ভালোবাসা, তার ছিটেফোঁটাও কি সেখানে থাকে?
আমার মায়ের কাছে তার মায়ের অর্থাৎ আমার নানির লেখা রান্নার খাতা আছে। যেখানে আমার নানি বিভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহ করা রেসিপি লিখে রাখতেন। সেগুলো লিখে দিতেন তাঁর বড় মেয়েকে। নববিবাহিত মেয়ে যেন সেসব দেখে নতুন নতুন রান্না শিখতে পারে। কী চমৎকার সেই রেসিপি, কী চমৎকার তার বর্ণনা! অথচ আমার কাছে সেই রান্নার খাতারও প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়েছে। আমি এখন এতই ব্যস্ত যে খাতা খুলে রেসিপি খোঁজার সময় কই? ইউটিউবে একটা কি-ওয়ার্ড লিখে সার্চ দিলেই চলে আসবে হাজার হাজার রেসিপি!
দাদুভাইয়ের লাল টালিখাতার পাতাগুলো হাতে পাওয়ার পর থেকে সেই রেসিপি খাতার জন্যও আমার মনটা আনচান করছে। মনে মনে ভাবছি সেই মুহূর্তের কথা, যখন একজন মা তাঁর মেয়ের নতুন সংসারের জন্য সযত্নে লিখছেন রেসিপি। লিখে দিচ্ছেন নানা টিপস আর ট্রিকস। সেই খুলনায় বসে একজন মা সংসারের ফাঁকে সময় বের করে টুকে রাখছেন নানা পদের আচার, মাংস, মাছ, পরোটা, মিষ্টি কিংবা নোনতা খাবারের রেসিপি। যেন চট্টগ্রামে অবস্থান করা তাঁর বড় মেয়ে সেসব দেখে নিত্যনতুন পদ রাঁধতে পারে, তার জীবনটা যেন একটু সহজ হয়।
এই যে অনুভূতি, আবেগ ও ভালোবাসার সহজ প্রকাশ আর যত্ন; এগুলো কি হারিয়ে ফেলছি আমরা? আজকাল প্রায়ই ভাবতে বসি। তাহলে কি সত্যিই বিজ্ঞান বেগ দিয়েছে, আবেগ কেড়ে নিয়েছে? কিন্তু কোনো না কোনো সময় কি আমাদের ফিরতে হয় না শিকড়ের কাছে? যেখানে মেলে দুদণ্ড শান্তি, মেলে স্বস্তি। তাহলে এখন থেকেই নাহয় যত্ন নিতে শুরু করি সেই শিকড়ের, যার রস-সুধা পান করে আজকের এই আমি বা আমরা হয়ে উঠেছি।