চোখের সামনে সঙ্গীদের মেরে আমাদের ভয় দেখাত

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর বেশ কবছর ধরে বই আকারে প্রকাশ করছে স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের সংগৃহীত ‘মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী–ভাষ্য’। নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতেই তাদের এই উদ্যোগ। জাদুঘরের আহ্বানে সাড়া দিয়ে শিক্ষার্থীরা পরিচিতজনদের সঙ্গে আলাপ করে একাত্তরের স্মৃতি লিখিতভাবে পাঠায়। ফলে এই কর্মসূচি এক অর্থে বিনিময়। যেখানে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর বয়ে নিয়ে যাচ্ছে ইতিহাস এবং শিক্ষার্থীরা জোগান দিচ্ছে ইতিহাসের নতুন উপাদান। শিক্ষার্থীদের পাঠানো এসব ভাষ্য থেকে বাছাই ৩১টি কাহিনি বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে প্রকাশ করছে প্রথম আলো

সংগ্রহকারী: সুমাইয়া রহমান, অষ্টম শ্রেণি (স্মৃতিকথা সংগ্রহের সময়), কাউখালী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়, রাঙামাটি

বর্ণনাকারী: আবুল কালাম আজাদ, মুসলিমপাড়া, কাউখালী, রাঙামাটি

সংগ্রহকারী ও বর্ণনাকারীর সম্পর্ক: নাতনি–নানা

চোখের সামনে সঙ্গীদের মেরে আমাদের ভয় দেখাত, ভয় দেখিয়ে আমাদের কাছ থেকে কথা আদায় করাই ছিল মূল লক্ষ্য
অলংকরণ: আরাফাত করিম

১৯৭১ সালের কথা। তারিখটা ঠিক মনে নেই, তবে মাস ছিল সেপ্টেম্বর। তখন সারা দেশে যুদ্ধ। মা–বাবাকে বললাম, ‘আমি যুদ্ধে যাব।’

আমার সঙ্গে ছোট ভাই আবুল কাশেমও যেতে চাইল। কিন্তু বাড়ির কেউ আমাদের যেতে দিতে চাইল না। আমরা জেদ করে বেরিয়ে পড়লাম।

বাড়ি থেকে বেরিয়ে সোজা যোগ দিই মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ক্যাম্পে। ক্যাম্পটি ছিল আমাদের বাড়ি থেকে অনেক দূরে। ওই ক্যাম্পে আমরা মোট ২৪ জন যোদ্ধা ছিলাম।

আরও পড়ুন

ক্যাম্পে যাওয়ার পর পুরো এক মাস ক্যাম্প কমান্ডারের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিলাম। এর পরপরই যোগ দিলাম মূল যুদ্ধে। বাড়ির কেউ জানে না, আমরা যুদ্ধে যোগ দিয়েছি। অনেক দিন আমাদের কেনো খোঁজ না পেয়ে সবাই ভাবল, আমরা হয়তো মরেই গেছি।

যাহোক, এভাবে জানা-অজানার মধ্য দিয়ে কেটে গেল আরও একটি মাস। এরপর একদিন আমরা যুদ্ধে যাব বলে বের হলাম। হঠাৎ পাকিস্তানি বাহিনী এসে আমাদের আটক করে নিয়ে গেল। পরে জানতে পারি, রাজাকাররা আমাদের খোঁজ দিয়েছিল।

পাকিস্তানি বাহিনী আমাদের যেখানে নিয়ে গেল, সেখানকার অবস্থা জেলখানার মতো। আমাদের মতো অনেক যোদ্ধাকে ধরে নিয়ে আটকে রেখেছে। এদের মধ্যে অনেককে আমাদের সামনে নিমর্মভাবে মেরে ফেলে তারা।

কাউকে গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে ফাঁসি দেয়। কাউকে গাছে হাত বেঁধে গুলি করে মারে। চোখের সামনে সঙ্গীদের মেরে আমাদের ভয় দেখাত। ভয় দেখিয়ে আমাদের কাছ থেকে কথা আদায় করাই ছিল মূল লক্ষ্য। কথা আদায় করতে আরও অনেক অত্যাচার চালিয়েছিল।

আরও পড়ুন

আমাদের মধ্যে অনেক যোদ্ধাকে পাকিস্তানি বাহিনী হত্যা করলেও ভাগ্যবশত আমরা চারজন বেঁচে যাই। প্রতিমুহূর্তে মৃত্যু এসে হানা দিয়ে যেত জেলখানার দরজায়। প্রতিদিন কাউকে না কাউকে মরতে হতো পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে।

শুধু ফাঁসি দিয়ে বা গুলি করেই নয়, গাড়ির পেছনে হাত বেঁধে টেনে নিয়ে যেত। অনেকের ক্ষতস্থানে লবণ ছিটিয়ে দিত। যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে প্রাণ দিতেন মুক্তিযোদ্ধারা।

চোখের সামনে এসব দেখে কষ্টে, ক্ষোভে, রাগে বুক ফেটে যেত। মৃত্যুর আগপর্যন্ত এসব দৃশ্য কোনো দিন ভুলতে পারব না। আজও আমার মন কাঁদে সহযোদ্ধাদের জন্য।

আরও পড়ুন