অবশেষে নরসিংদীর রায়হান মিয়ার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন পূরণ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন। ২০১০ সালের সেই স্বপ্ন চাকরি, সংসার-সন্তান সামলাতে গিয়ে অধরাই থেকে যাচ্ছিল। অবশেষে পূরণ হলো। সাবরেজিস্ট্রারের চাকরি থেকে শিক্ষা ছুটি নিয়ে এ মাসেই বৃত্তি নিয়ে হার্ভার্ডে মাস্টার্স করতে গেছেন নরসিংদীর রায়হান মিয়া। হোয়াটসঅ্যাপে তাঁর কাছ থেকে এই যাত্রার গল্প শুনলেন মনজুরুল আলম
মেঘনাপারের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে রায়হান মিয়ার বেড়ে ওঠা। এসএসসিতে ভালো ফল করার পর সবাই যখন নরসিংদীর রায়পুরাতেই নিজেদের কোনো কলেজে ভর্তি হওয়ার কথা বলছিল, রায়হান তখন খুঁজছিলেন দেশসেরা কোনো কলেজে পড়ার পথ। এভাবে নিজেই খোঁজ নিয়ে নটর ডেম কলেজে ভর্তির সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু ঢাকায় এসে কলেজের ভর্তি ফরম তুলে দেওয়ার মতো কেউ তাঁর ছিল না। রায়হান নিজেই একদিন ট্রেনে চেপে বসেন। একা রাজধানীতে পা রাখার সেই সফর ছিল ভয়, উত্তেজনা আর স্বপ্নে ভরা। যে যাত্রাই আজ তাঁকে নিয়ে গেছে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটসে। সেখানে হার্ভার্ড কেনেডি স্কুলে পাবলিক পলিসি বিষয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছেন তিনি। এ মাসেই শুরু হবে ক্লাস।
রায়হানের স্বপ্নের সিঁড়ি
নটর ডেম কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগে ভর্তি হন রায়হান মিয়া। একদিন ক্লাসে কোনো এক শিক্ষক ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিষয়ে বিদেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগের কথা বলেছিলেন। তখন থেকেই বাইরের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করেন রায়হান। একদিন হার্ভার্ড কেনেডি স্কুল সম্পর্কে জেনে মনে মনে ঠিক করেন, পড়লে এই স্কুলেই পড়বেন।
রায়হান বলেন, ‘এই স্কুল ভর্তির সুযোগ পেতে যা যা করতে হবে, তখন থেকেই আমি তা করা শুরু করি। কোয়ান্টিটেটিভ কোর্সগুলোতে ভালো গ্রেডকে তারা বেশি মূল্যায়ন করে। সেই থেকে অনার্সে আমার চার বছরের সব কোর্স থেকে কোয়ান্টিটেটিভ কোর্সগুলোকে আলাদা করি। এই কোর্সগুলোতে বেশি গুরুত্ব দিই। সব কটি কোর্সেই পরে এ-প্লাস পাই। পাশাপাশি কলেজ থেকে করে আসা স্বেচ্ছাসেবী কাজেও জড়িয়ে থাকি। কারণ, এসবও তারা গুরুত্ব দেয়।’
কিন্তু এত সব প্রস্তুতির মধ্যেই জীবনের সবচেয়ে কঠিন বাস্তবতাটার মুখোমুখি হন রায়হান। ২০১০ সালে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের শুরুতেই বাবাকে হারান। পরিবারের বড় ছেলে রায়হানের কাঁধে আসে পড়ে অনেক দায়িত্ব। বাধ্য হয়ে একটি মোবাইল কোম্পানির কল সেন্টারে কাজ নেন। দিনে ক্লাস করে রাতে এই খণ্ডকালীন চাকরি করতেন। এই কাজ করতে গিয়ে পড়াশোনার ওপর প্রভাব পড়ে। রেজাল্ট খারাপ হয়। চাকরি ছেড়ে বিকল্প আয়ের পথ খুঁজতে থাকেন। সে সময় একটি বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং সেন্টারে ক্লাস নেওয়া শুরু করলেন। মাস্টার্স শেষ করার আগপর্যন্ত সেই কাজই চালিয়ে গেছেন। এসবের মধ্যেই চলতে থাকে সরকারি চাকরির প্রস্তুতি।
দিনগুলোর কথা মনে করেন রায়হান, ‘মাস্টার্সে পড়ার সময় বিভাগীয় ও চাকরির পড়ার সময় ভাগ করে নিই। সকাল থেকে বেলা একটা পর্যন্ত বিভাগের পড়া আর একটার পর বিসিএসের পড়া। ফলে আমার বিভাগের ফলও ভালো হতে থাকে, সেই সঙ্গে প্রথমবার অংশ নিয়েই বিসিএসের লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হই। তখন আমার কাছে মনে হতো স্বপ্নটা কাছে।’
পড়াশোনা শেষ করে কিছুদিন শুধু বিসিএসের পড়া মনোযোগ দিয়ে চালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন রায়হান। কিন্তু পারিবারিক ও আর্থিক সংকটের কারণে সেটা সম্ভব হয়নি। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপে (সিইডি) গবেষণা সহযোগী হিসেবে যোগ দেন। এই চাকরির পাশাপাশি বিসিএস প্রস্তুতিও নেন।
২০১৬ সালে ৩৪তম বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়ে নন-ক্যাডার পদ সাবরেজিস্ট্রার হিসেবে যোগ দেন রায়হান। এসবের মধ্যেও আবার বিসিএস দিয়ে প্রশাসন ক্যাডারে যোগ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। কারণ, এই ক্যাডারের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে তাঁর স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ। ৩৪ থেকে ৪০তম পর্যন্ত বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু প্রতিবারই তাঁকে নন ক্যাডার পদ নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়।
আর হয়তো পড়া হবে না
২০২০ সালে বিয়ে করেন রায়হান। সংসার আর চাকরির চাপে দিনে দিনে ফিকে হয়ে আসতে থাকে রায়হানের হার্ভার্ডে পড়ার স্বপ্ন। এক দশকের স্টাডি গ্যাপ নিয়ে কি হার্ভার্ডে ভর্তি হতে পারবেন? এসব ভাবনা থেকেই অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদনের প্রস্তুতি নেন। আবেদনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ১০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা তৈরি করেন রায়হান। কিন্তু তাঁর স্ত্রী ও এক বন্ধু তাঁকে উৎসাহ দেন। তিনি বলেন, ‘স্ত্রী ও বন্ধু আমাকে বলে, হার্ভার্ডে আবেদন করে আমি যেন ভুলে যাই যে আবেদন করেছি। আমিও হবে না ধরে নিয়েই হার্ভার্ডে আবেদন করি!’
আবেদনের দুই সপ্তাহ যেতেই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অফার লেটার আসতে শুরু করে। ১০টিতে আবেদন করে যখন ৮টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেলেন, তখন রায়হানের স্বপ্ন আবার ডানা মেলল। তাহলে কি হার্ভার্ডে সুযোগ পাবেন? এমন দোলাচলের মধ্যেই গত ১৫ মার্চ পেলেন স্বপ্নের সেই ই-মেইল। মাস্টার ইন পাবলিক পলিসি বিষয়ে ভর্তির অফার লেটার পাঠিয়েছে তাঁকে হার্ভার্ড কেনেডি স্কুল।
দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন পূরণ করতে এ মাসেই শিক্ষা ছুটি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে গেছেন রায়হান মিয়া।