হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজের মাঈনুল নিজে নিজে কোডিং শিখে এখন চাকরি করছেন পর্তুগালে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার প্রবল ইচ্ছা ছিল। স্কুল-কলেজেও মেধাবী ছাত্র হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ভর্তি পরীক্ষার সময় দিনে অন্তত ১০ ঘণ্টা করে পড়াশোনা করতেন। কিন্তু ভর্তিপরীক্ষায় কাঙ্ক্ষিত ফল না পাওয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তো বটেই, অন্য কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও সুযোগ পেলেন না মাঈনুল ইসলাম। শেষ পর্যন্ত হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজে ভর্তি হলেন, ইংরেজি সাহিত্য বিভাগে। পাশাপাশি চালিয়ে যেতে থাকেন চেষ্টা।
২০১৮ সালের শেষ দিকে ইউটিউবে সার্চ করতে গিয়ে কিছু চ্যানেলের খোঁজ পান মাঈনুল। সেখান থেকেই জানতে পারেন, কম্পিউটার বিজ্ঞানে না পড়েও প্রোগ্রামার হওয়া সম্ভব। ছোটবেলায় কম্পিউটার প্রকৌশলে পড়ার ইচ্ছে ছিল। সেই সুযোগ হয়নি। ইউটিউব থেকে এই তথ্য জেনে নতুন করে আশাবাদী হয়ে উঠেন মাঈনুল। মুঠোফোনে বলছিলেন, ‘যখন জানতে পারলাম, নিজে নিজে শিখেও প্রোগ্রামার হওয়া যায়, তখন নিজেই নিজেকে চ্যালেঞ্জ করি। দেখিই না, পারি কি না। পরিকল্পনা করে এগোতে থাকি। অনার্স প্রথম বর্ষের পরীক্ষা শেষে ২০১৯ সালের শুরুতে এইচটিএমএল শেখা শুরু করি। এক–দুই সপ্তাহের মধ্যেই বেসিকটা শিখে ফেলি। তখনই মূলত আত্মবিশ্বাস বাড়ে। তারপর সিএসএস, পাইথন, ডিজ্যাঙ্গোসহ একের পর এক প্রোগ্রামিং ভাষা শিখতে থাকি।’
২০২০ সালের মাঝামাঝি অনলাইন লার্নিং প্ল্যাটফর্ম প্রোগ্রামিং হিরোর ‘কমপ্লিট ওয়েব ডেভেলপমেন্ট’ কোর্সে ভর্তি হন মাঈনুল। কোর্স শেষ করার পর তাঁর আত্মবিশ্বাস আরও বেড়ে যায়। ফাইনাল প্রজেক্ট জমা দেওয়ার সময় বুঝতে পারছিলেন, শুধু শেখাই যথেষ্ট নয়, নিয়মিত চর্চা করলে, লেগে থাকলে তবেই ভালো কাজ পাওয়া সম্ভব। সেই বিশ্বাস সত্যি হয় পরের বছর।
২০২১ সালের জানুয়ারি মাস। লিংকড-ইন ঘাঁটাঘাঁটি করতে করতে হঠাৎ চোখে পড়ে একটি চাকরির বিজ্ঞপ্তি। পর্তুগালের প্রতিষ্ঠান টেম্বাস ক্যাপিটালে সফটওয়্যার ডেভেলপার নেওয়া হবে। মাঈনুল আবেদন করেন। তাঁকে পরীক্ষামূলকভাবে একটা কাজ দেয় কোম্পানি। কিন্তু তখনই একটি পারিবারিক কারণে কুমিল্লা থেকে ঢাকায় চলে আসতে হয়। ফলে নির্ধারিত সময়ে কাজটি শেষ করতে পারেননি।
চাকরির আশা একদম ছেড়েই দিয়েছিলেন। এসময়ই অপ্রত্যাশিত ফোন। প্রোগ্রামিং হিরোর জব প্লেসমেন্ট টিমের পক্ষ থেকে জানানো হয়, পর্তুগালের কোম্পানিটি এখনও দুজনকে নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু ঢাকায় তখন মাঈনুলের কোনো ব্যক্তিগত কম্পিউটার ছিল না। কুমিল্লায় ডেস্কটপে কাজ করতেন, ঢাকায় এসেছিলেন খালি হাতে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর বোনের এক বান্ধবীর বাসায় ৪–৫ ঘণ্টার জন্য ল্যাপটপ ব্যবহারের সুযোগ পান।
তারপর? ‘এই কয়েক ঘণ্টায় কি আদৌ কিছু করা সম্ভব?’ ভাবছিলেন মাঈনুল। কাজটা বেশ জটিল, ব্লকচেইন ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে সম্পর্কিত, আগে কখনও করেননি। অসম্পূর্ণ অবস্থাতেই কাজটা জমা দেন তিনি। কিন্তু ভাগ্য যেন বারবার তাঁকে সুযোগ দিয়ে যাচ্ছিল। পরে জানতে পারেন, ‘টাস্ক’ জমা দেওয়ার সময় বাড়ানো হয়েছে। কুমিল্লায় ফিরে এবার নিজ ডেস্কটপে বসেন তিনি, সফলভাবে ‘টাস্ক’ সম্পন্ন করেন। কাজ দেখে সন্তুষ্ট হয় কোম্পানি।
প্রথমে ভিন্ন একটি প্ল্যাটফর্মে কাজ করার প্রস্তাব পান। কিন্তু ততদিনে ‘রিঅ্যাক্ট’–এর প্রেমে পড়ে গেছেন মাঈনুল। জানিয়ে রাখি, রিঅ্যাক্ট হলো ইউজার ইন্টারফেস তৈরির একটি ওপেন সোর্স প্ল্যাটফর্ম। সেই দিনগুলোর কথা স্মরণ করে মাঈনুল বলেন, ‘কোম্পানি আমাকে ছয় সপ্তাহের জন্য পেইড প্রবেশনারি পিরিয়ডে সুযোগ দেয়। সেই সময় এমনভাবে কাজ করি, আমার বস দেখে খুব খুশি হয়ে যায়। অসুস্থ অবস্থাতেও বাড়তি ডকুমেন্টেশন পড়ে ব্লকচেইন প্রজেক্টে নতুন ফিচার তৈরি করেছিলাম। সেই কাজের মেয়াদ তো বেড়েছেই, তিন মাসের মাথায় বেতনও বাড়ে। পরে আমি ফুলটাইম পজিশন পাই।’
২০২২ সালে অফিসের বসের কাছ থেকেই আসে প্রস্তাব—‘পর্তুগাল চলে আসো।’ দেশে বসে ফ্রিল্যান্সিং করা একজন তরুণের কাছে ইউরোপে কাজ করার প্রস্তাব তো স্বপ্নের মতো। মাঈনুল বলেন ‘আমি আসলে বিদেশেই যেতে চাচ্ছিলাম। কানাডা নিয়ে রিসার্চও করছিলাম। কিন্তু হঠাৎ পর্তুগাল থেকে উল্টো অফার পাব, ভাবতেই পারিনি। কোম্পানি শুধু আমাকে কাজের ভিসাই দেয়নি, থাকার জায়গা, টিকিট, এমনকি পুরো খরচটাই স্পনসর করেছে। আমার জন্য এটা ছিল সেরা পাওয়া।’
বর্তমানে লিসবনে আছেন মাঈনুল। নিয়মিত কাজের পাশাপাশি আপওয়ার্কে ফ্রিল্যান্সিং করছেন। তাঁর প্রোফাইলে রয়েছে ‘টপ রেটেড’ ব্যাজ, আর ক্লায়েন্টদের কাছ থেকেও মিলছে প্রশংসা। বাংলাদেশের তরুণদের উদ্দেশে মাঈনুল বলেন, ‘ধৈর্য্য, পরিশ্রম, ধারাবাহিকতার কোনো বিকল্প নেই। শুধু স্কিল নয়, সমস্যার সমাধান করার মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। ছোট ছোট কাজ থেকেই বড় স্বপ্নের শুরু হয়। তাই সবার উচিত নিজের প্যাশনের জায়গায় ধৈর্য্য ধরে লেগে থাকা।’