তুষারপাত থেমে বৃষ্টি শুরু হলো, বৃষ্টির সঙ্গে ঝরল বরফকুচি

নেপালের পোখারা থেকে অন্নপূর্ণা বেজক্যাম্প—সব মিলিয়ে ১০ দিনের ট্রেক। পথটা দুর্গম, তবে অপার্থিব সৌন্দর্যে ভরা। হিমালয়ের প্রকৃতির এই সৌন্দর্য ভুলিয়ে রাখে গন্তব্যে পৌঁছার কষ্ট। যেতে যেতে আরও কত কি যে চাক্ষুষ হয়! মে মাসে পার্বত্য এই পথেই হেঁটে এসেছেন ইফতেখারুল ইসলাম। সেই অভিজ্ঞতা ধারাবাহিক লিখছেন তিনি। আজ পড়ুন সপ্তম পর্ব

অন্নপূর্ণা বেজক্যাম্পে লেখক
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

অন্নপূর্ণা বেজক্যাম্প বেশ কিছুদিন ধরে আমার আগ্রহের তালিকায় ছিল। উচ্চতার দিক থেকে এটা আমার জন্য এখন খুব বড় চ্যালেঞ্জ নয়। এভারেস্ট বেজক্যাম্প (ইবিসি) বা আমার আগের কয়েকটি গন্তব্যের তুলনায় এর উচ্চতা যথেষ্ট কম। ইবিসিতে অনেক বেশি উঁচুতে বেশ কয়েকটা দিন কাটাতে হয়, ট্রেক করতে হয়। কিন্তু অন্নপূর্ণার পথ ইবিসির পথের তুলনায় বেশি খাড়া। অনবরত চড়াই ধরে ওঠা খুব কষ্টকর। তবে এখানে পৌঁছানোর আগেই চারদিকের দৃশ্য দেখে মন ভরে যায়। ধীরে ধীরে পাহাড়ের কোলে পৌঁছে যাই।

এ পথে অন্য যে ট্রেকারদের দেখেছি, তাঁদের অনেকেই ইবিসিতে যাননি। কারণ, সেটা এর চেয়ে দীর্ঘ ও কষ্টসাধ্য। মালয়েশীয় ট্রেকারদের কয়েকটা দল দেখলাম। আলাদা আলাদা কয়েকজন পরিণত বয়সের পুরুষ দেখলাম। কেউই অবশ্য বয়সে আমার চেয়ে বড় নন। তবু আমার ব্যাপারে তাঁদের কৌতূহল আছে। একজন তো সরাসরি জিজ্ঞেস করে ফেললেন, ‘হাউ ওল্ড আর ইউ।’ আমি বয়স বলার পর তাঁর মুখে বিস্ময় ফুটে ওঠে। পরক্ষণেই তিনি একটু সামলিয়ে উঠে বললেন, ‘গড হ্যাজ ব্লেসড ইউ।’ দুদিন ধরে এই ব্যক্তির সঙ্গে বারবার দেখা হচ্ছে ট্রেকের পথে, কফি ও লাঞ্চের বিরতিতে, সন্ধ্যায় লজের লাউঞ্জে। শেষ পর্যন্ত বেজক্যাম্পেও তাঁর দেখা পাই।

লক্ষ্যে পৌঁছানোর পর অন্নপূর্ণা বেজক্যাম্পের নাম ফলকের সামনে
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

এ জায়গায় প্রচণ্ড শীত। তাপমাত্রা মাইনাস ৬-৭ ডিগ্রি, কিন্তু মনে হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি ঠান্ডা। রাতে কত ঠান্ডা হবে—কে জানে। সাড়ে চারটায় অন্নপূর্ণা বেজক্যাম্প (এবিসি) লজে পৌঁছে প্রথমেই আমার থাকার জায়গাটা বুঝে নিই। কারণ, সেই ঘরে রাখতে হবে আমার বড় ব্যাগটা। দু–তিনটি রুমে জায়গা আছে। তবে আমার বেশি পছন্দ হয় মূল লজের বাইরে একটা ছোট টিনশেড। সত্যিকারের বেজক্যাম্পসুলভ পরিবেশ। তার চারদিকে বরফের স্তূপ জমে আছে। ওই রুমের ভেতরেও এখন প্রচণ্ড ঠান্ডা।

তাই ওখানে ব্যাগ রেখে ডাইনিং রুম বা লাউঞ্জে চলে আসি। ব্যাকপ্যাক নামিয়ে হাত পা ছড়িয়ে বসে থাকি এ ঘরের একটা খালি জায়গায়। পায়ের একটু বিশ্রাম প্রয়োজন। এখানে ফায়ার প্লেস অথবা অন্য কোনো রকম হিটিংয়ের ব্যবস্থা নেই। ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞার কারণে কাঠকুটো বা কয়লা দিয়ে আগুন জ্বালানো যায় না। সবাই এই ডাইনিংরুমে যে যার মতো জায়গা নিয়ে গুটিসুটি মেরে বসে আছেন।

তুষারপাত থেমে বৃষ্টি শুরু হলো। বৃষ্টির সঙ্গে বরফকুচি ঝরছে। একবার বারান্দায় গিয়ে দেখে আসি, চারদিক ধূসর মেঘে ঢাকা। একটু পর সেই বৃষ্টিও থেমে যায়। আবার শুরু হলো তুষার, অবিশ্রান্ত তুষারপাত। চারদিকে বরফের পুরোনো স্তূপের ওপর জমতে থাকে সাদা তুষারের নতুন স্তর। বেজক্যাম্পে যে কয়েকটা লজ আছে, তাদের সব কটি উজ্জ্বল সাদা চাদরে ঢেকে যায়। তুষারঢাকা প্রান্তরের সঙ্গে মিশে যায় দূরের শুভ্র পর্বতশিখর।

অন্নপূর্ণার অপরূপ ভোর
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

এরই মধ্যে আমি গায়ে তিন স্তরের জামা আর সবার ওপর ডাউন জ্যাকেট পরে নিয়েছি। রাতে এর সবকিছু পরেই ঘুমাতে যেতে হবে। এখানে কাউকে আলাদা রুমে থাকার নিশ্চয়তা দেওয়া হয় না। আজ ট্রেকারদের ভিড় আছে। তাই সবাইকে রুম শেয়ার করে থাকতে হবে। ছোট ছোট রুমে তিন–চারজন করে। আর ডাইনিংরুমে ১০-১২ জন। এ ঘরের মাঝখানে খাবার টেবিল। চারপাশে বসার জায়গাগুলো যে রাতে অতিথি ও গাইডদের ঘুমানোর জন্য ব্যবহৃত হবে, তা একটু পরেই বুঝতে পারলাম। সোলার পাওয়ার দিয়ে কিছু বিদ্যুতের ব্যবস্থা হয়েছে। সন্ধ্যার একটু পর আলো জ্বলল। একে একে সবাই খাওয়া শেষ করে যার যার ঘরে চলে গেলেন।

ঘরের ভেতরে আলো কমে এসেছে। বাইরে ঘন অন্ধকার। সেই অন্ধকারে দু-একজন মুঠোফোনের টর্চ জ্বেলে নিজের ঘর খুঁজছেন। এতগুলো মানুষ এখানে রয়েছেন, তবু চারদিক নিস্তব্ধ। বেজক্যাম্পের রোমাঞ্চকর পরিবেশ। এখানে এই বড় ঘরে যাঁরা থাকবেন, তাঁরা এখন যাঁর যাঁর জায়গা ঠিক করে নিচ্ছেন। এক কোণে তেজ ও অন্য কয়েকজন গাইড খেলাধুলা করছিল। তাস অথবা অন্য কিছু। তারাও খেলা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। অন্যরা এখনই শুয়ে পড়বেন। তার প্রস্তুতি চলছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আকাশ পরিষ্কার হয়ে যাবে। ভোরে দেখা যাবে অন্নপূর্ণার অপরূপ সূর্যোদয়। তেজ আমাকে বুঝিয়ে দেয়, ভোরে উঠে সূর্যোদয়ের আগে কয়েক মিনিট হেঁটে ঠিক কোন জায়গায় গিয়ে দাঁড়াতে হবে।

বেশির ভাগ ট্রেকার এখন ঘরে। রাতে কোনো কারণে ঘর থেকে বাইরে যেতে হলে হেডল্যাম্প জ্বালিয়ে বের হতে হবে। আমিও মূল লজ থেকে বেরিয়ে হেডল্যাম্পের আলোয় পথ দেখে হাঁটতে শুরু করি। ওই পথে আরও মানুষ হেঁটেছেন বলে তুষার গলে পিচ্ছিল বরফ হয়ে আছে। সাবধানে পা ফেলে তুষারের পাহাড় ডিঙিয়ে আমার ঘর খুঁজে নিই। আগেই আবহাওয়ার পূর্বাভাসে দেখেছিলাম, রাতে মাইনাস ১০ ডিগ্রি পর্যন্ত হবে। বাইরের তাপমাত্রা এখন কত, তা জানার উপায় নেই। রুমে অন্য একজন নিঃশব্দে ঘুমাচ্ছেন। সারা দিনের ক্লান্তি নিয়ে আমি শুয়ে পড়ি আমার ছোট্ট বিছানায়।

অন্নপূর্ণা বেজক্যাম্প থেকে ভোরের আলোয় মচ্ছপুছারে
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

সাধারণত হিমালয়ে ট্রেকিংয়ের পর ক্লান্ত শরীরে ঘুম ভালো হয়। কিন্তু এ রাতে ঘুম ভালো হয়নি, সম্ভবত এই উচ্চতায় শরীর ঠিকমতো মানিয়ে নিতে পারেনি। ভোর না হতেই আমার ঘুম ভেঙে যায়। অ্যালার্ম বাজেনি তখনো। সোয়া পাঁচটায় অ্যালার্ম দেওয়া ছিল। তেজ যখন আমাকে ডাক দেয়, তখন বিছানা ছেড়ে উঠতে এবং জুতা পরে ঘর ছেড়ে বাইরে যেতে সময় লাগে মাত্র কয়েক মিনিট। ৫টা ২৫ মিনিটের দিকে সূর্যোদয় হওয়ার কথা। তার আগেই আমরা সন্তর্পণে বরফের ওপর দিয়ে পাঁচ–সাত মিনিটের পথ হেঁটে সূর্যোদয় দেখার নির্দিষ্ট স্থানটিতে গিয়ে দাঁড়াই। কয়েক মিনিটের মধ্যে বেজক্যাম্পে রাত কাটানো আরও অনেক নারী-পুরুষ এসে জমায়েত করতে থাকেন এখানে। অল্প একটু জায়গার মধ্যে অনেক মানুষ। কিন্তু এই বিশালতার পটভূমিতে মানুষগুলোকে ছোট ছোট দেখায়।

হিউঞ্চুলি, অন্নপূর্ণা সাউথ, অন্নপূর্ণা–১, মচ্ছপুছারে—সব কটি পর্বতশিখর প্রভাতের প্রথম আলোয় ঝলমল করে ওঠে। বিশেষ করে অন্নপূর্ণার শিখরগুলোকে অনেক কাছে মনে হয়। মনে হয়, এই উঁচু জায়গা ছেড়ে একটু নেমে একছুটে চলে যেতে পারব অন্নপূর্ণা–১-এর শিখরের দিকে। এ কথা শুনে তেজ ভাবে, আমি সত্যিই ওদিকে যেতে চাইছি। সে আমাকে সাবধান করে। যে জায়গায় দাঁড়িয়েছি, সেখানে পা স্থির রাখতে হবে, যেন পায়ের নিচ থেকে বরফ বা মাটি ধসে না পড়ে। বেশি নড়াচড়া করা যাবে না। এখান থেকে ওই পাহাড়ের দিকে যেতে চাওয়াটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।

১০-১৫ মিনিট দাঁড়িয়ে আমি অন্নপূর্ণার অপরূপ ভোর আর চারদিকের অসাধারণ দৃশ্য দেখি। বেশ কিছু ছবি তোলা হলো। দেখা পেলাম গত কয়েক দিনে পরিচয় হওয়া বেশ কজন ট্রেকসঙ্গীর। গত কদিনে পথে যত মালয়েশীয় ট্রেকার দেখেছি, তাঁদের প্রায় সবাই এখানে আছেন। জাতি হিসেবে এখানে তাঁরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। এই সূর্যোদয় পয়েন্টে আবার দেখা হলো মালিনের সঙ্গে। আমরা একে অন্যকে সুপ্রভাত জানাই। অভিনন্দন জানাই এবিসিতে পৌঁছানোর লক্ষ্য অর্জন করার জন্য। তারপর ধীর পায়ে নেমে আসি।