দাস কেনাবেচার কেন্দ্রবিন্দু ছিল এই শহর

মাদাগাস্কারে গিয়েছিলেন বাংলাদেশি চার সাইক্লিস্ট। আফ্রিকার দ্বীপরাষ্ট্রটিতে সাইকেলে ঘুরে দারুণ দারুণ সব অভিজ্ঞতা তাঁদের হয়েছে। সেই অভিজ্ঞতাই সবার সঙ্গে ভাগ করে নিচ্ছেন মুনতাসির মামুন। আজ পড়ুন একাদশ পর্ব

সড়কের পাশেই সমুদ্র, মাদাগাস্কারের এই সড়ককে মেরিন ড্রাইভ বলা শ্রেয়ছবি: লেখক

বন্দরনগরী তমাসিনা থেকে আমাদের আজকের গন্তব্য মাহাভেলনা। দেশটির পর্যটন এলাকা এটি। মাহাভেলনা নামটি মালাগাছি। তবে ম্যাপে পরিচিতি ফউলপয়েন্ট নামে। ইতিহাস বলছে, এই ফউলপয়েন্ট এসেছে ‘ফুল’ নামের এক ব্রিটিশ জাহাজের নামানুসারে। এই জাহাজ মাহাভেলনার সুচালো যে অংশে অবতরণ করে, তার নাম কালাতিক্রমে ফউলপয়েন্ট হয়ে যায়।

আঠারো শতকের মাঝামাঝি থেকে শেষ পর্যন্ত সময়কালে ভারত মহাসাগরের দক্ষিণ-পশ্চিমের এই শহর দাস কেনাবেচার কেন্দ্রবিন্দু ছিল। সে সময় শত্রুর আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য এখানে একটি দুর্গ তৈরি করা হয়েছিল। এ ছাড়া মাহাভেলনার উপকূল বিরল প্রজাতির প্রবালপ্রাচীর দিয়ে প্রাকৃতিকভাবে সুরক্ষিত ছিল। এই দুয়ের কারণে বর্তমানে এই শহরে পর্যটন ভীষণ জনপ্রিয়।

৬০ কিলোমিটার রাস্তা আজ। চারজন একসঙ্গে আমরা। রাস্তা একেবারে বাংলাদেশের মতো। পাকা রাস্তা মাঝেমধ্যে ভেঙে গেছে। দুই পাশে চাষের জমি। মাঝেমধ্যে দু-একটা ঘর। ঘরগুলো মলিন, যত্নহীন। বেড়া, চাল—সব টিনের। দেয়ালে বিজ্ঞাপন আঁকা। বেশির ভাগে কোকাকোলা কিংবা স্থানীয় বিয়ার কোম্পানির। রিকশা-সাইকেল কদাচিৎ অতিক্রম করে যাচ্ছে আমাদের।

রাস্তার ধারে দোকানগুলো একেবারে বাংলাদেশের মতো
ছবি: লেখক

আগের দিনগুলোতে রাস্তার দুই ধারে গাছ ছিল। আজ একেবারে জংলা। আরএন-৫ নামের এই একটাই মহাসড়ক চলে গেছে উত্তরে। এখন পর্যন্ত আমরা পাকা রাস্তায় আছি। কিন্তু একটা ব্যাপার লক্ষণীয়,Ñতমাসিনা পার হয়ে কতই আর আসা হলো, বড়জোর ১৫ কিলোমিটার? এর মধ্যেই রাস্তার অবস্থা খারাপ হতে শুরু করেছে। খানাখন্দের পরিমাণ আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। চালানোর সময় বাড়তি সতর্কতা মানতে হচ্ছে। তবে এদিকে চড়াই নেই। থাকলে ঢালগুলো মারাত্মক হয়ে যেত। নামার সময় সাইকেলের গতিবেগ এমনিতেই বেড়ে যায়, তার ওপর যদি এমন খানাখন্দ থাকে, তবে আর রক্ষা নেই।

ঝমঝম করে বৃষ্টি শুরু হলো। সকালে একপশলা হয়ে মাঝে বিরতি দিয়ে আবার এই শুরু হলো। চঞ্চলদের সঙ্গেই আমরা। একে তো সকাল, তবুও যে বৃষ্টির মধ্যে কারও সাইকেল নষ্ট হলে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া কিছু করার থাকবে না। তাই একসঙ্গে চলছি। গতি কম হলেও ভালোই এগোচ্ছি। ঘণ্টায় ১৫ কিলোমিটার।

একটা সময় রাস্তা ডানে বাঁক নিল। পাড়ে স্রোত বা জলরাশি আছড়ে পড়ার শব্দ ধীরে ধীরে জোরালো হচ্ছিল। ডানে বাঁক নিতেই সামনে সমুদ্র। ভড়কালাম। এই আরএন-৫ রাস্তাটা মহীসোপানের কোলজুড়ে থাকবে, তা ম্যাপ দেখে বুঝতে পেরেছিলাম। কিন্তু এই রূপান্তরটা এতটাই আকস্মিক যে ধাতস্থ হতে সময় নিল। একদম আমাদের মেরিন ড্রাইভের মতো।

দুটো রিসোর্টের সাইনবোর্ড অদূরেই। রাস্তা থেকে বাঁয়ে একটা খাবারের হোটেল। পৌনে নয়টা বাজে। হয়তো এই জন্য খদ্দের নেই। পাশে আরও কিছু দোকান আছে। রাস্তার ডানে সাগরের শুরু। সামান্য মহীসোপান, তাতে অবিরত ঘাই মেরে যাচ্ছে সাগরের পানি। চওড়ায় রাস্তাটা ২০ ফুট হবে। মহাসড়ক হিসেবে মোটেই কেতাদুরস্ত নয়। তাই সাগরের পানি ছিটকে একেবারে রাস্তা পার হয়ে অপর পারে চলে আসতে পারে।

হোটেলে ঢুকে গেলাম। সামনের অংশ পুরো ফাঁকা কিন্তু বেশ বড়। বৃষ্টি বলে সাইকেলগুলো ভেতরে নিয়ে এলাম। দোকানি নারী নিষেধ করলেন না। তাঁরা বেশ নিচু স্বরে কথা বলেন। জ্যাকেট খুলে যতটা সম্ভব, পরিষ্কার হওয়া গেল। স্যুপ নুডলস বলে একটা খাবারের অর্ডার দেওয়া হলো। দুই বাটি। সঙ্গে দুটি করে ডিমের অমলেট। ঝাল বেশি করে। একে তো ঠান্ডা, তার ওপর বৃষ্টিতে হাতের চামড়া কুঁকড়ে গেছে। গরম-ঝাল কিছু খেতে ভালো লাগবে।

তমাসিনার হোটেল থেকে এই হোটেল পর্যন্ত ২৬ কিলোমিটার পথ। এখানে আমরা থাকব কিছুক্ষণ। বৃষ্টি থামার জন্য বাড়তি সময় দিতে হলেও রাজি। পথে স্যাঁতসেঁতে ব্যাপারটা ভালো লাগছে না।

একটা সাইকেল এগিয়ে আসতে দেখলাম। কালো বর্ষাতি পরা পঞ্চাশোর্ধ্ব এক ভদ্রলোক সাইকেল নিয়ে আমাদের দেখছিলেন। তাঁর সাইকেলে প্যানিয়ার দেখে বুঝতে পারলাম, তিনিও হয়তো মাদাগাস্কার ঘুরতে বেরিয়েছেন। এ তো রিটো! এ পর্যন্ত সাবলীল ইংরেজিতে কথা বলতে পারা মানুষ দু-একজনকে পেয়েছি। তিনি তাঁদেরই একজন। রিটো সুইজারল্যান্ডের মানুষ। প্রায় সাত বছর ধরে এখানেই থাকেন। পুরো আফ্রিকায় সাইকেল চালিয়েছেন দুই বছর ধরে। সর্বশেষ মাদাগাস্কারে এসে স্থিত হয়েছেন।

একটা টেবিলে আমরা পাঁচজন বসে গেলাম। খাবার চলে এল এরই মধ্যে। স্যুপের বাটিগুলো বেশ বড়। এক থালা নুডলসের সঙ্গে সবুজ সবজি আর দুটো করে ডিমের অমলেট ভেসে আছে। কুসুমগুলো আস্ত। এমন এক বাটি স্যুপ একা খাওয়া শক্ত। আলাদা বাটি নিয়ে পাঁচজনে ভাগাভাগি করে নিলাম। রিটো নিজে থাকার জন্য বাড়ি বানিয়েছেন এখানেই। ১০ মিনিটের হাঁটাপথ। বাজারসদাই সবকিছু তমাসিনা থেকে করতে হয়। ছোটখাটো কিছু দরকার পড়লে এখানে যে দোকান আছে, তা-ই ভরসা। ঠিক হলো ফেরার পথে তাঁর বাড়িতে ঢুঁ মারব।

বৃষ্টি থেমেছে। ভেজা কাপড় থেকে পানি ঝরে গেছে। রিটো আমাদের সঙ্গেই এগোলেন তাঁর বাড়ি পর্যন্ত। দ্বিতল কাঠের দারুণ চকচকে বাংলো। ঘন গাছগাছালিতে ঘেরা মনোরম পরিবেশ।

মান্দা বিচ হোটেল
ছবি: মাদাগাস্কার হোটেলস অনলাইন ডটকম

সৈকতঘেরা মান্দা বিচ হোটেল

মাদাগাস্কারের এই সড়ককে মেরিন ড্রাইভ বলা শ্রেয়। এখানে উন্নয়নের জোয়ার আসেনি। জোয়ার যা আছড়ে পড়ছে, তা ভারত মহাসাগরের। তাই এই রাস্তায় প্রকৃতি অকৃপণ, নিষ্কলুষ। খানিক বাদে বাদে রাস্তার ছালবাকল উঠে গেছে। আমাদের তাতে সাইকেল চালাতে অসুবিধা হচ্ছে না, বরং ভালো লাগছে। কারণ, রাস্তার খানাখন্দগুলো প্রকৃতির সঙ্গে একাকার হয়ে মিশে আছে।

একটা দোকানে একবার থামা হয়েছিল পানি পানের বিরতিতে। এই দোকানগুলোও বাঁশ ও কাঠ দিয়ে তৈরি। রাস্তার দুই পাশে মাটির বদলে বালু। মাচা করা দোকানের মেঝে। জোয়ারের পানি কি এই অবধি উঠতে পারে? ভরা কোটালে নাকি সাগরের পানি অনেক বাড়ে। রাস্তা ছাপিয়ে পানি এ পর্যন্ত এলেও অবাক হওয়ার নয়।

বেলা একটার দিকে আমরা ফউলপয়েন্ট লেখা সাইনবোর্ডগুলো দেখতে শুরু করলাম। চলে এসেছি তাহলে। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে অনেক হোটেলের সাইনবোর্ড। তবে সেভাবে দোকানপাট নেই। মনে হচ্ছে, যাঁরা এখানে আসেন, তাঁরা এসে সোজা হোটেলে চলে যান। তা না হলে আরও কিছু দোকান দেখা যেত হয়তো। স্থানীয় বাসিন্দারা কোন দিকে থাকেন, তা বোঝা যাচ্ছে না গাছগাছালি আর ঝোপজঙ্গলের জন্য।

হোটেলের ভাড়া খুবই কম। দুই থেকে চার হাজার টাকার মধ্যে হোটেল যে পাওয়া যাবে, বিশ্বাস করা কঠিন। মান্দা বিচ হোটেল একেবারে সৈকতঘেরা। ভারি মনোরম স্থাপনা। কটেজগুলো বাঁশ-কাঠ-শণের চালা দিয়ে তৈরি। এগুলোও কোমর পর্যন্ত উঁচু মাচার ওপরে। জোয়ারই হবে। জোয়ারের জন্যই সবকিছু মাচার ওপরে হবে হয়তো।