হাঙরের সঙ্গে সমুদ্রস্নান

মালদ্বীপের মাফুশি দ্বীপসংলগ্ন সমুদ্র
ছবি: সাদি ইসলাম

ধুর, তা–ই হয় নাকি! হাজারো দ্বীপ নিয়ে একটা দেশ হয় কী করে!

ছাত্রজীবনে মালদ্বীপ নিয়ে জানার পর মনে মনে এমন অবিশ্বাসই জন্মেছিল। অবিশ্বাসটা সপ্তাহ দুয়েক আগে পর্যন্তও ছিল।

আমাদের উড়োজাহাজ মালদ্বীপের আকাশসীমায় পৌঁছানোর পর থেকে ধীরে ধীরে অবিশ্বাসটা কাটতে থাকে।

উড়োজাহাজটি যতই মালদ্বীপের ভেলেনা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল, ততই সাগরের বুকে থাকা ছোট ছোট দ্বীপ দৃশ্যমান হচ্ছিল। পাখির চোখে নীল সমুদ্রের মাঝখানে দ্বীপগুলো দেখে মনে হচ্ছিল যেন কোনো শিল্পীর নিখুঁত শিল্পকর্ম।

এই শিল্পকর্ম দেখতে চোখ এদিক-ওদিক করতে করতে হুট করেই উড়োজাহাজটি নেমে পড়ে সাগরলাগোয়া ছিমছাম ছোটখাটো বিমানবন্দরটিতে।

মনে একটা আক্ষেপ জেগে ওঠে। ইশ্, উড়োজাহাজটি আর কিছুক্ষণ আকাশে থাকলে কী ক্ষতি হতো। ওপর থেকে আরেকটু সময় নীল জলের সাগর ও দ্বীপ দেখে মন জুড়ানো যেত।

আমরা চারজনের পারিবারিক পর্যটক দল। আমি, সাদি ইসলাম, মুনুরী মোজাহেদ ও মাশরুর মোজাহেদ। পাঁচ দিনের ভ্রমণ পরিকল্পনা নিয়ে গত ২৫ আগস্ট সকাল ৯টার দিকে ঢাকা থেকে ভারত মহাসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপের উদ্দেশে রওনা দিই।

আরও পড়ুন
হুলহুমালে দ্বীপের আকাশে সি প্লেন
ছবি: মুনুরী মোজাহেদ

উড়োজাহাজে থাকা যাত্রীদের মোটাদাগে দুই দলে ফেলা যায়। একটা দল আমাদের মতো, পর্যটক। আরেক দল বাংলাদেশি কর্মী। তাঁরা মালদ্বীপে কাজ করেন। দেশে এসেছিলেন। এখন আবার কর্মক্ষেত্রে ফিরছেন। তাঁদের অধিকাংশের হাতেই লাগেজ-ব্যাগের পাশাপাশি বাংলাদেশি জনপ্রিয় সব মিষ্টির প্যাকেট। বোঝাই যাচ্ছে, সহকর্মীদের জন্য বাংলাদেশ থেকে উপহার নিয়ে যাচ্ছেন।

ভেবেছিলাম, মালদ্বীপ বুঝি খুব কাছেই হবে। উড়োজাহাজে উঠতে না উঠতেই গন্তব্যে নামার ঘোষণা চলে আসবে। কোথায় কী! চার ঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে মনে হলো, মালদ্বীপ তো ভালোই দূরের দেশ।

আমি কৃত্রিম পা ব্যবহার করি, প্রয়োজন অনুযায়ী হুইলচেয়ার। বিমানবন্দরে নামতেই দেখি, আমার জন্য হুইলচেয়ারসহ প্রস্তুত এক কর্মী। মনে মনে ভাবি, নিশ্চয়ই এই সেবার জন্য বাড়তি অর্থ গুনতে হবে!

আমার ধারণা ছিল, বিমানবন্দর মানেই আনুষ্ঠানিকতা সারতে অনেক সময় লেগে যাওয়া, লাগেজ আসতে দেরি হওয়া, লাগেজ হারিয়ে যাওয়া, তল্লাশির নামে হয়রানি—এসব ভীতিকর বিষয়।

মালদ্বীপে এই ভুলও ভাঙল। আনুষ্ঠানিকতা সারতে লাগল মোটে মিনিট কয়েক। আনুষ্ঠানিকতা সেরে দেখি লাগেজ হাজির।

লাউঞ্জে শত শত বিদেশি পর্যটক। বেশির ভাগই অ–এশীয়। ইউরোপ, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্যের পর্যটক।

সব কাজ শেষে আমরা বিমানবন্দরের বাইরে যাই।

আরও পড়ুন
ফুলিডো দ্বীপে স্টিংরের সঙ্গে লেখক
ছবি: মুনুরী মোজাহেদ

নীল আকাশের কাছে

বিমানবন্দরের ফটকলাগোয়া ঝকঝকে সড়ক। সড়কের ওধারে সারি ধরে ট্যাক্সি দাঁড়ানো। দেখে মনে হয়, একদম নতুন। এই পাশে সড়কলাগোয়া লম্বা জেটি। এখান থেকে নৌপথে রাজধানী মালেসহ বিভিন্ন গন্তব্যে যাওয়ার ব্যবস্থা আছে। আমরা যাব হুলহুমালে। দ্বীপটা বিমানবন্দরের কাছেই। আমাকে ট্যাক্সিতে উঠিয়ে বিদায় চাইলেন বিমানবন্দরকর্মী। কোনো অর্থ দাবি করলেন না!

নির্ধারিত গতিতে আমাদের ট্যাক্সি চলতে শুরু করে। সড়কের এক দিকে বিমানবন্দর, অপর দিকে সমুদ্র। কিছুক্ষণ ডানের দৃশ্য দেখি, কিছুক্ষণ বাঁ। সড়কে হাতে গোনা গাড়ি। গাড়ি বলতে ট্যাক্সি।

১৫-২০ মিনিটের মধ্যে হোটেলে পৌঁছে যাই। দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর একটু বিশ্রাম নিয়েই বেরিয়ে পড়ি।

পরিচ্ছন্ন সৈকতের জায়গায় জায়গায় চেয়ার, বেঞ্চ, দোলনা পাতা। লম্বা একটা বেঞ্চে বসে পড়লাম। ওপরে ছাউনি দেওয়া। কিন্তু বেঞ্চের ভাড়া নেওয়ার লোক কই। পরে বুঝতে পারি, এগুলো পর্যটকদের ব্যবহারের জন্য সাজিয়ে রাখা হয়েছে। এখানে টাকাপয়সার ব্যাপার নেই।

আরও পড়ুন
সমুদ্রে দেখা গেল ডলফিন
ছবি: মুনুরী মোজাহেদ

রৌদ্রোজ্জ্বল সমুদ্রের যত দূর চোখ যায়, নীল আর নীল। আকাশ আর সমুদ্রের নীল একাকার। তার মধ্যে দিয়ে কিছুক্ষণ পরপর উড়ে যায় সি-প্লেন।

সন্ধ্যা পর্যন্ত সমুদ্রের বিশালতা, ঢেউ আর নীলে ডুবে থাকি। সন্ধ্যার পর শহরে ঘুরতে বের হই। সড়কে অনেক ভেসপা। নারী-পুরুষ সবাই সমানতালে ভেসপা চালান। ট্রাফিক পুলিশ নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও আছে শৃঙ্খলা। কোনো গাড়ি জোরে চলে না, গাড়িতে গাড়িতে নেই প্রতিযোগিতা, কোনো গাড়ি হর্ন দেয় না, পথচারীরা জেব্রা ক্রসিং ছাড়া সড়ক পার হন না। রাতে শহর ঘুরে মুগ্ধতা আরও বাড়ে। সাজানো-গোছানো শহর। কোথাও ময়লা–আবর্জনা নেই। মানুষজন ফুটপাত ছাড়া হাঁটে না। কোথাও হইহুল্লোড়, চিৎকার-চেঁচামেচি নেই।

আমরা চড়া দামে স্থানীয় স্ন্যাকস–জাতীয় খাবার ও জুস খেয়ে আবার সৈকতে ফিরি। দোলনায় দোল খেতে খেতে চাঁদের আলোয় সমুদ্র দেখি। সমুদ্রের ঢেউ পাড়ে আছড়ে পড়ার শব্দ উপভোগ করি।

এক সময় ঘুম এসে যায়। আমরা সৈকতে থাকা সুতা দিয়ে বোনা চেয়ারে গিয়ে বসি। আমাদের চোখে-মুখে এসে লাগে ঠান্ডা হাওয়া। কখন যেন ঘুমের দেশে হারিয়ে যাই। ঘুম ভাঙার পর দেখি, মধ্যরাত পেরিয়ে গেছে। আমরা হোটেলে ফিরি।

আরও পড়ুন
নার্স হাঙরের সঙ্গে গভীর সমুদ্রের নীল জলে
ছবি: সংগৃহীত

হাঙরের সঙ্গে সমুদ্রস্নান

সকালে উঠে হোটেলে নাশতা সেরে সোজা সৈকত। রোদ যতই বাড়ে, তত গাঢ় নীল হয়ে ওঠে পানির রং। সমুদ্রে গোসল সেরে দুপুর নাগাদ হোটেলে ফিরি। এবার আমাদের গন্তব্য মাফুশি দ্বীপ। দুপুরের পর হুলহুমালে থেকে ট্যাক্সি নিয়ে মালেতে যাই। সেখানকার ফেরিঘাটে গিয়ে সরকারি ফেরির টিকিট কাটি। বেলা তিনটায় ফেরিতে করে মাফুশি দ্বীপের উদ্দেশে রওনা দিই। নীল জলরাশি ও দ্বীপের পর দ্বীপ পেরিয়ে সন্ধ্যার কাছাকাছি সময় আমরা মাফুশি পৌঁছাই।

লাগেজ রেখে দ্রুত আমাদের হোটেলের ছাদে চলে যাই। সৈকতের পাশেই আমাদের হোটেল। ছাদে আছে সুইমিংপুল। এই সুইমিংপুলে নেমে সমুদ্রমুখী হয়ে আমরা সূর্যাস্ত দেখি। মনে হচ্ছিল, রক্তিম সূর্যটা যেন ধীরে ধীরে সমুদ্রে নেমে যাচ্ছে।

সৈকতে রাতে ডিজে পার্টির আয়োজন করে হোটেল কর্তৃপক্ষ। নানা দেশ থেকে আসা শত শত পর্যটক গানের সঙ্গে নেচে-গেয়ে জমিয়ে তোলে পার্টি। রাত গভীর হয়, তবু থামে না গান, নাচ আর রঙিন আলোর ঝলকানি। পার্টি শেষ করার চূড়ান্ত ঘোষণা এলে পর্যটকেরা সমস্বরে বলে ওঠেন, ‘ওয়ান মোর, ওয়ান মোর।’

পার্টি সাঙ্গ হলে ক্লান্ত হয়ে আমরা কক্ষে ফিরি। কখন যে ঘুমিয়ে পড়ি, নিজেরাও জানি না। পরদিন সাতসকালে উঠে নাশতা সেরে আমরা সৈকতে যাই। অন্যদের মতো আমরাও সূর্যস্নান করি। পরে সমুদ্রে নেমে সাঁতার কাটি।

আরও পড়ুন

বিকেলে দ্বীপ ঘুরে দেখতে বের হই। মধ্যরাত পর্যন্ত ঘোরাঘুরি করি। এর মধ্যে চলে রেস্তোরাঁয় লাইভ গান শোনা ও খাওয়াদাওয়া। তাজা টুনা মাছের গ্রিল ও রেড স্ন্যাপারের বারবিকিউ খেতে খেতে আমরা স্থানীয় ফলের জুসে চুমুক দিই। পরদিন সকালেই প্রমোদভ্রমণ আছে তাই তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ি।

সকালে স্পিডবোটে ওঠার আগে আমাদের সবাইকে লাইফ জ্যাকেটসহ অন্যান্য সরঞ্জাম দেওয়া হলো। সঙ্গে দিকনির্দেশনা। সাড়ে ৯টায় শুরু হলো আমাদের যাত্রা। সমুদ্রের বুক চিরে দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলে স্পিডবোট।

ঘণ্টা দেড়েকের মাথায় সমুদ্রের একটা শান্ত-শীতল জায়গায় থামে স্পিডবোট। কিছুক্ষণ পরই শুরু হয় ডলফিনের আনাগোনা। দল বেঁধে তারা ঘুরে বেড়াতে থাকে। কোনো কোনোটি আবার লাফ দিয়ে পানির ওপরে উঠে আসছে। আমরা ছবি তুলতে, ভিডিও ধারণ করতে ব্যস্ত হয়ে উঠি।

আবার চলতে শুরু করে স্পিডবোট। কিছুক্ষণ পর ফুলিডো দ্বীপের জেটিতে গিয়ে ভেড়ে স্পিডবোট। এখানে আমরা স্টিংরে (পাতা মাছ) দেখব। আমরা এক–এক করে জেটির কাছে সমুদ্রে নেমে বসি। আমাদের চারপাশে মাছের টুকরা ছিটিয়ে দিতেই দল বেঁধে চলে আসে স্টিংরে। আমরা চুপচাপ থাকি। আমাদের চারপাশে ঘোরাঘুরি করে স্টিংরে। স্টিংরের গায়ে হাত দেওয়া নিষেধ। হাত দিলে লেজ দিয়ে আঘাত করতে পারে। তখন বিপদ হতে পারে।

ভারত মহাসাগরের বুকে বিখ্যাত স্যান্ড ব্যাংকে
ছবি: সাদি ইসলাম

এবার ‘নার্স হাঙর’ দেখার পালা, তাদের সঙ্গে নীল জলে ভাসার পালা। তাই আবার ছুটে চলে আমাদের স্পিডবোট। আধঘণ্টার মতো চলার পর অতল সমুদ্রের একটা জায়গায় থামে বোট। খাবার ছিটিয়ে দিতেই বোটের চারপাশে দল বেঁধে জড়ো হয় ছোট-বড় নার্স হাঙর। এখানেও একই নিয়ম। নার্স হাঙরকে স্পর্শ করা যাবে না। তাকে তার মতো থাকতে দিতে হবে।

লাইফ জ্যাকেট, মাস্ক, পানির তলে নিশ্বাস নেওয়ার নল ও বিশেষ চশমা পরে স্পিডবোট থেকে সমুদ্রে নামতে থাকেন পর্যটকেরা। আমিও এসব পরে পুরোপুরি প্রস্তুত। কিন্তু প্রমোদভ্রমণের নির্দেশক কিছুটা দ্বিধান্বিত। ২০০৮ সালে সংবাদ সংগ্রহের কাজে গিয়ে আমি ট্রেন দুর্ঘটনার শিকার হয়েছিলাম। দুর্ঘটনায় আমার দুই পা কোমরের কিছুটা নিচ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। নির্দেশক ভাবছিলেন, যার দুই পা নেই, সে কীভাবে গভীর সমুদ্রে নামবে, সাঁতার কাটবে! তাঁকে আশ্বস্ত করি, আমি ভালো সাঁতার জানি। গত বছরও কক্সবাজার সৈকতে সাঁতার কেটেছি। তিনি কিছুটা আশ্বস্ত হন। স্পিডবোট থেকে সমুদ্রে ঝাঁপ দিই। পানির নিচে তাকাতেই দেখি, চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে নার্স হাঙরসহ অসংখ্য মাছ। ফটোগ্রাফার চটপট ছবি তুলে ফেললেন।

এবারের গন্তব্য স্যান্ড ব্যাংক বিচ। ভারত মহাসাগরের বুকে জেগে ওঠা এই সৈকতে গিয়ে দেখা গেল বিরল এক দৃশ্য। ঢেউয়ের পানিতে বিচের বালু ভিজে যায়। ঢেউ নেমে যেতেই শুকিয়ে যায়।

তপ্ত রোদে হু হু করে বয়ে যাওয়া শীতল হাওয়া গায়ে লাগিয়ে আমরা স্যান্ড ব্যাংক বিচে বসে দুপুরের আহার সারি। আহার শেষে ডলফিন, স্টিংরে, হাঙরের সঙ্গে কাটানো রোমাঞ্চকর সব স্মৃতি নিয়ে আমরা যে যার হোটেলে ফিরি।