শিশুপার্ক থেকে বেরিয়ে রিকশায় ছোট্ট শহর ভোলা দেখতে দেখতে চলে যেতে পারেন হোটেলে। থাকার জন্য ক্রিস্টাল-ইন, প্যাপিলন, কর্ণফুলীর মতো বেশ কিছু ভালো মানের হোটেল গড়ে উঠেছে। অনলাইনে আগেভাগেই বুকিং দেওয়া যায়। সিঙ্গেল কেবিন ২ হাজার ও ডাবল কেবিন ৩ হাজার টাকার মধ্যে পাওয়া যাবে।

আর যদি ইলিশা লঞ্চঘাটে নামেন, তাহলে ঘাটের পাশে মেঘনার তীরে আছে গাজীপুর হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট। যেখান থেকে সাগরের মতো উত্তাল মেঘনা নদীর অপরূপ দৃশ্য উপভোগ করতে পারবেন। ডাবল কেবিনের ভাড়া দেড় হাজার এবং সিঙ্গেল এক হাজার টাকা। খাবারের জন্য আলাদা বিল দিতে হবে। এখানে ভোলার ঐতিহ্য মহিষের কাঁচা দধি, শতভাগ খাঁটি ঘি ও উন্নত মানের মিষ্টি পাওয়া যায়, যা আপনি নিয়ে যেতেও পারবেন।

হোটেলে ব্যাগ রেখে চলে যেতে পারেন মেঘনার তীরে। তুলাতুলির ইলিশ বাড়ি, শাহবাজপুর পর্যটন এলাকায়। ব্লক ফেলা মেঘনার তীর ধরে ধুলামাখা পথে হাঁটতে পারেন। সবজিখেত আর ঝাউবনের ছায়ায় কাটাতে পারেন কিছু সময়। ‘ইলিশ বাড়ি’ রেস্টুরেন্টে ইলিশের বারবিকিউসহ মানসম্পন্ন খাবার পাওয়া যায়।

তুলাতুলি থেকে ইচ্ছা করলে নৌকায় চড়ে মেঘনায় জেগে ওঠা মদনপুর চরে ঘুরে আসতে পারেন। শব্দহীন, ছিমছাম পরিবেশ। কলাগাছে ঘেরা ইউনিয়নটি মোটরসাইকেলে কয়েক মিনিটে ঘুরে দেখতে পারেন। মেঘনা পার হতে হতে দেখবেন জেলেদের মাছ ধরার দৃশ্য। একটু দাঁড়িয়ে ইলিশের ছোটাছুটিও দেখতে পারেন। এই মদনপুরের চরে আছে মহিষের বাথান। এখানকার ঘন দুধের চা, সঙ্গে মোতা ধানের মুড়ি আর গাছপাকা বাংলা কলায় মিটবে নাশতার চাহিদা।

বিকেলটা অনায়াসে কাটিয়ে আসতে পারেন তেঁতুলিয়া নদীতীরের বঙ্গবন্ধু পার্কে। ধাপে ধাপে সিঁড়ি নেমে গেছে তেঁতুলিয়া নদীর নীল জল পর্যন্ত। ঘাটে গেলে চোখে পড়ে চারদিকের অপরূপ নয়নাভিরাম দৃশ্য। ভোলার সদর উপজেলার দক্ষিণ দিঘলদী ইউনিয়নের কোড়ালিয়া গ্রামে বঙ্গবন্ধু পার্ক।

সেখানে যাওয়ার সময় পথে দেখতে পারেন বাংলাবাজার উপশহরে স্বাধীনতা জাদুঘর, আরও এগিয়ে ৭০০ বছরের পুরোনো মসজিদ। বঙ্গবন্ধু পার্কে ভোলা শহর থেকে যেতে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, মাইক্রোবাস নিতে পারেন। রিকশায় ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা নেবে। দর করে উঠতে হবে। তবে ভেঙে ভেঙে গেলে খরচ কম পড়বে। সে ক্ষেত্রে ভোলা শহর থেকে মোস্তফা কামাল বাসস্ট্যান্ড গিয়ে বাসে বাংলাবাজার, বাংলাবাজার থেকে কোড়ালিয়া গাড়িঘাটা। যেতে-আসতে জনপ্রতি সর্বোচ্চ এক–দেড় শ টাকা খরচ হবে।

ভোলা শহর ও অন্যান্য উপজেলার হোটেল-রেস্টুরেন্টে মেঘনা-তেঁতুলিয়া নদীর টাটকা ইলিশ, পোয়া, কোরাল, চিংড়ি, পাঙাশসহ নানা রকম মাছের স্বাদ নিতে পারেন।

মনপুরা

ঢাকা থেকে ভোলার সাতটি উপজেলাতেই লঞ্চে যাতায়াত করা যায়। মনপুরা উপজেলায় যেতে লঞ্চের সিঙ্গেল কেবিনের ভাড়া ১ হাজার ২০০ টাকা। ডাবল কেবিন ২ হাজার ৪০০ টাকা। ৬০০-৭০০ টাকায় ডেকেও আসা যায়। আড়াই হাজার টাকার মধ্যে ভিআইপি ও ফ্যামিলি কেবিন আছে। লঞ্চ খুব ভোরে নোঙর করে উপজেলার রামনেওয়াজ লঞ্চঘাটে। আধো অন্ধকারে অটোরিকশায় আপনাকে যেতে হবে উপজেলা শহর হাজিরহাট। ভাড়া ২০০-৩০০ টাকা নেবে। ইচ্ছা করলে ঘাটের কাছের কোনো হোটেলেও উঠতে পারেন। মনপুরার আশপাশসহ এক দিনে ঢালচর ও কলাতলী ঘুরে দেখতে পারেন।

হাজিরহাটে আছে জেলা পরিষদের ডাকবাংলো। ফাঁকা থাকা সাপেক্ষে এখানে ফ্যামিলি কেবিন এক হাজার টাকা। এ ছাড়া হাজিরহাটে অহি, হানিফসহ একাধিক আবাসিক হোটেল আছে, ভাড়া ২০০ থেকে ৫০০ টাকা। হাজিরহাট থেকে আরও দক্ষিণে সিরাজগঞ্জ বাজার, সেখানে আছে হোটেল সমুদ্র বিলাস। ভাড়া ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা। দরদাম করে উঠলে আরও কমে থাকা যায়।

মনপুরার দক্ষিণে দখিনা হাওয়া সি বিচ। আর পুরো মনপুরায় বন আর বন, পাখি আর নীলাকাশ। এখানে মেঘনার পূর্ব-পশ্চিমে উদয়াস্ত দেখা যায়।

চরফ্যাশন

ভোলা-চরফ্যাশন সড়কের দূরত্ব ১১০ কিলোমিটার। ভোলায় নেমে সড়কপথে চরফ্যাশন যাওয়া যায়। সরাসরি লঞ্চে চরফ্যাশন যেতে ঢাকা-বেতুয়া ও ঢাকা-ঘোষেরহাট নৌপথের লঞ্চে উঠতে হবে।

ভোরে লঞ্চ থেকে নেমে সকালের নাশতা সেরে বেতুয়ার আশপাশে ঘন ম্যানগ্রোভ বনায়ন ঘুরতে পারবেন। উত্তাল, বিস্তৃত মেঘনার দিকে তাকালে মন ভরে যাবে।

চরফ্যাশন শহরে আছে জ্যাকব টাওয়ার, শেখ রাসেল শিশুপার্ক। সরকারি-বেসরকারি রেস্টহাউস ছাড়াও আছে বেশ কিছু ভালো হোটেল। ভাড়া ২৫০ টাকা থেকে আড়াই হাজার টাকা। থাকতে পারেন খামারবাড়ি রিসোর্ট সেন্টারে। এখানে প্রতি রাতে কেবিনের ভাড়া ৮-১৬ হাজার টাকা।

চরফ্যাশন উপজেলার মূল ভূখণ্ডের শেষ থেকে মেঘনা নদীর মাঝ দিয়ে সাগরমোহনার ভাসানচর পর্যন্ত থেকে থেকে চর। সাগর মোহনায় আছে চর কুকরিমুকরি ও ঢালচর। এসব চরে শীতে আসে পরিযায়ী পাখি। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে হাওরাঞ্চলের পরে বেশি পাখি আসে ভোলার চরাঞ্চলে। এসব পাখি দেখতে প্রতিবছরের জানুয়ারিতে দেশ-বিদেশের পর্যবেক্ষক ও পর্যটকেরা আসেন। আসে পাখিশুমারি দল। নদীর চরে নানা প্রজাতির পরিযায়ী জলচর পাখি খাবার খুঁটে খায়। আবার সারা বছরই আছে দেশীয় জলচর পাখি।

চর কুকরিমুকরিতে আছে বার্ড ওয়াচ টাওয়ার। চরফ্যাশন থেকে বাস, মাইক্রো কিংবা মোটরসাইকেলে আপনাকে যেতে হবে কচ্ছপিয়া ঘাট। সেখান থেকে ট্রলার, স্পিডবোট কিংবা লাইনের লঞ্চে আপনি চর কুকরিমুকরির শ্বাসমূলীয় বনে যেতে পারেন। এই বনে হরিণ ছাড়াও নানা রকম বন্য প্রাণী এবং নদীতে ভোঁদড় দেখতে পাবেন। তবে সবচেয়ে ভালো হয়, ডিঙি ভাড়া নিয়ে জোয়ারের সময় বনের ভেতরের খাল পরিদর্শন করা। সেই যাত্রায় সুন্দরবন ভ্রমণের আবহটা পেয়ে যাবেন।

চর কুকরিমুকরিতে আছে বন বিভাগের রেস্টহাউস। ভাড়া পড়বে ফ্যামিলি কেবিন ২ হাজার আর ভিআইপি কেবিন ৫ হাজার টাকা। আর আছে হোম স্টে সেবা, যেখানে সিঙ্গেল বেড ৩০০ টাকা।

চর কুকরিমুকরি থেকেই আপনি আরও দক্ষিণের ঢালচর যেতে পারেন। ঢালচরেই আছে তাড়ুয়া সি-বিচ। নদীপথে, সবুজ বনের খালের দুই পাশে আপনার সঙ্গী হবে নানা রকম হাঁস, বক, পানকৌড়ি, হটটিটি আর মাছরাঙা।

শীতে সাগর মোহনা আর মেঘনা-তেঁতুলিয়ার পানি শান্ত, স্বচ্ছ। হাত ডোবালে হাতের রেখা দেখা যায়। এই নীল জলের বুকে পড়ে ঝিলিক মারে রাতের চাঁদ, দিনের সূর্য। কিছু দূর যেতে না যেতে সবুজ দ্বীপ। দক্ষিণে ভোলাকে ঘিরে আছে এসব সবুজের দ্বীপ।