হিমালয় আছে বলেই পৃথিবী এত সুন্দর

নেপালের পোখারা থেকে অন্নপূর্ণা বেজক্যাম্প—সব মিলিয়ে ১০ দিনের ট্রেক। পথটা দুর্গম, তবে অপার্থিব সৌন্দর্যে ভরা। হিমালয়ের প্রকৃতির এই সৌন্দর্য ভুলিয়ে রাখে গন্তব্যে পৌঁছার কষ্ট। যেতে যেতে আরও কত কি যে চাক্ষুষ হয়! মে মাসে পার্বত্য এই পথেই হেঁটে এসেছেন ইফতেখারুল ইসলাম। সেই অভিজ্ঞতা ধারাবাহিক লিখছেন তিনি। আজ পড়ুন নবম ও শেষ পর্ব

অন্নপূর্ণার অপরূপ ভোরছবি: লেখক

আজ যেভাবেই হোক লোয়ার সিনুওয়া পৌঁছাব বলে জেদ করাটা ঠিক হয়নি। এ রকম কাজ আর করব না। এরপর আবার হিমালয়ে এলে প্রতিদিন আর একটু ছোট ট্রেক করব। বেঁচে থাকলে আবার নিশ্চয়ই আসব। তখন আমার বয়স আরও একটু বাড়বে। তবু এটুকু কষ্ট করতে পারব আশা করি। এসব কথা ভাবতে ভাবতে বিকেল পর্যন্ত অনেক দূর নেমে আসি। হাঁটতে হাঁটতে আমরা আবার ট্রি-লাইনের অনেকটা নিচে অরণ্যের ভেতরে এসেছি। পাখির কলকাকলিতে নিস্তব্ধতা ভেঙে যায়। নানারকম পাখির ডাক শুনতে শুনতে হাঁটি। হিমালয়ে কত রকম পাখি আছে? কী কী গাছ, কত রকম ফুল? এ নিয়ে কোনো বই নিশ্চয়ই আছে। কত যে পড়া বাকি রয়ে গেল।

সূর্যাস্তের পরেও এখানে কিছুক্ষণ আলো থাকে। শেষ দেড় ঘণ্টা ঘন অন্ধকারে পাথরের অসমান সিঁড়ি বেয়ে নামতে হয়। এবার ট্রেক শুরুর আগে যে হেড ল্যাম্পটা কিনেছি, তাতে একটু বেশি আলো পাওয়া যাচ্ছে। সেটি বেশ কার্যকর।

শেষ পর্যন্ত রাত আটটায় আমাদের নির্দিষ্ট লজে পৌঁছালাম। লক্ষ করলাম, অনেক ক্লান্ত লাগলেও শরীর স্বাভাবিক আছে, সবই ঠিক মনে হচ্ছে, কিন্তু আমি বসতে পারছি না। দাঁড়িয়ে থাকতেই ভালো লাগছে। তেজ, ভরত আর লজের ম্যানেজার—সবাই আমাকে বলে, হ্যাভ আ সিট, রিল্যাক্স। কিন্তু আমি আমার হাঁটু ভাঁজ করে বসতে পারি না। কাঁধে, পিঠে ও কোমরে অসহনীয় ব্যথা।

অন্নপূর্ণা বেজক্যাম্প ছেড়ে আসার আগে গাইড তেজের সঙ্গে লেখক
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

একটু সময় নিয়ে ধীরে ধীরে ব্যাকপ্যাক সরিয়ে, জ্যাকেট খুলে একটু চেষ্টা করে ওদের লাউঞ্জে বসলাম। রাতের খাবারের অর্ডার দেওয়া হলো। মাথাটা ঝিমঝিম করছিল, সেটা একটু কমেছে। কিন্তু আমি সহজে হাত পা নাড়াতে পারছি না। অনেক কষ্টে জুতা ও মোজা খুলে দেখলাম, পায়ের দুই বুড়ো আঙুলের সামনে, নখের নিচে রক্ত জমাট বেঁধে আছে। এই পা নিয়ে কী করে সারা দিন হেঁটে এলাম, সেটিই অবাক কাণ্ড। নখের এই ক্ষতি আমার চেনা। পরিষ্কার বুঝতে পারছি, দুপাশের বুড়ো আঙুলের নখের নিচে রক্ত জমাট বেঁধেছে। পানি জমেছে। ওখানে হয়তো ইনফেকশন হবে। এখন কীভাবে চলবে, কেমন করে সামনের দুটি দিন বাকি পথ পাড়ি দেব, কাল ভোরে ভেবে দেখব। আপাতত বিশ্রাম চাই।

স্ট্রাভা ও ফিটবিট অ্যাপ থেকে বুঝতে চেষ্টা করি, আজ সারা দিনে কতটা হেঁটেছি। পাহাড়ে বারবার ওঠা ও নামার মধ্য দিয়ে পথ চলতে হয় বলে দূরত্ব অনেক সময় নির্ভুলভাবে মাপা যায় না। ফিটবিট যে স্টেপস গুনে রাখে, সেটি সাধারণত নির্ভুল হয়। সেখান থেকেই জানতে পারলাম, আজ হেঁটেছি ৫০ হাজার ৯৩ স্টেপস, মানে ৩৭ দশমিক ০২ কিলোমিটার।

ভোরের আলোয় শুরু হলো তুষারাবৃত অন্নপূর্ণা থেকে ফিরে আসার ট্রেক
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

২০২০ সালের মার্চ মাসে এভারেস্ট বেজক্যাম্পে যাওয়া থেকে শুরু করে হিমালয়ের যেসব পথে ট্রেক করেছি, গোকিও রি, থোরাং লা পাস ও অন্নপূর্ণা বেজক্যাম্পসহ যেসব লক্ষ্যে পৌঁছেছি, তা সারা জীবন মনে রাখার মতো। তবে ফিরতি ট্রেকে বিরতিসহ প্রায় ১৪ ঘণ্টা ট্রেক করে নির্দিষ্ট গন্তব্যে ফিরে আসার এই দিনটির কথাও কোনো দিন ভুলব না। আগে কোনো দিন এতটা হাঁটিনি। থোরাং লা পাস পার হওয়ার দিন অথবা ইবিসির (এভারেস্ট বেজক্যাম্প) কোনো কোনো দিন ২৭ থেকে ২৮ হাজার স্টেপস হেঁটেছি। সম্ভবত এর আগে সেটিই ছিল আমার সর্বোচ্চ।

পরদিন ভোরে কিন্তু পায়ের ব্যথা অনেক কমে গেল। বুড়ো আঙুল দুটোতে ব্যথা ও ক্ষত আছে। কিন্তু সেদিন তেমন কোনো সমস্যা হলো না। প্রায় স্বাভাবিক গতিতে ট্রেক করে সিনুওয়া থেকে ঝিনুতে পৌঁছে যাই। আগের দিন বেশি পথ পাড়ি দিয়েছিলাম বলে এ দিনের ট্রেকটা হয়েছে ছোট। ঝিনুতে অনেক লজ। একটি নতুন হোটেল হয়েছে যা পার্বত্য অঞ্চলের তুলনায় খুবই উন্নত। সেখানে সকাল সকাল পৌঁছে শাওয়ার নিই। আমার সঙ্গে ছোট ছোট সাবান আছে। বেশ কিছু জামা, ছোট কাপড়, গামছা ইত্যাদি ধুয়ে দিই।

দুপুরের পর ঝিনুর হোটেলে খোলা ছাদের টেরেসে চায়ের কাপ আর একখানা বই হাতে নিয়ে বসি। বইয়ে মন বসে না। পরের দিন আরও একটি দীর্ঘ পদযাত্রা সেরে পোখারা পৌঁছে যাব। পা দুটি পুরো সুস্থ থাকলে ফিরতি ট্রেকে ধীরে ধীরে নিচের দিকে নেমে যাওয়াটা কত সহজ হতো। এখন পথ চলা কষ্টকর হবে। দুদিন পর পাহাড় ছেড়ে চলে যাব, ভাবলে মনটা একটু মেঘাচ্ছন্ন হয়। শুভ্র হিমবাহ, পর্বতশিখর আর সবুজ অরণ্য ছেড়ে ফিরতে হবে জনপদের মলিনতার মধ্যে। উঁচু পাহাড় থেকে নামতে হবে নিচে, বিশালতর জগৎ ছেড়ে ফিরতে হবে আমাদের চেনা জনাকীর্ণ রাস্তায়, সংকীর্ণ আবাসে।

এবারের এবিসি (অন্নপূর্ণা বেজক্যাম্প) ট্রেকের সার্টিফিকেট নিয়ে আমার পাঁচটা ট্রেকের সার্টিফিকেট হবে। কিন্তু কী হবে এসব কাগজ জমা করে? একসময় আমার ঢাকা ইউনিভার্সিটির এম ফার্ম ও আইবিএর এমবিএ সার্টিফিকেট ও মার্কশিট কত যত্ন করে রাখতাম। এখন এই বয়সে পৌঁছে ওসবের আর কোনো দাম নেই। এখন যে হিমালয়ে ট্রেকিংয়ের এত কাগজ আর মানচিত্র জমা হয়ে চলেছে, এগুলোরই-বা কী প্রয়োজন। জানি, কিছু সংগীত থেমে আসছে। তবু নিজেই নিজেকে বলি, এখনই অন্ধ বন্ধ কোরো না পাখা।

চারপাশের ঝিম ধরানো নীরবতা ভেঙে মানুষের কথোপকথন শুনতে পাই। বেশ কজন নতুন ট্রেকার এলেন। কয়েকজন ইউরোপীয় নারী। আর অন্য একটি দলে সাত-আট জন ভারতীয় নারী-পুরুষ। তাঁরা ট্রেক শুরু করছেন আজ। তাঁদের চোখেমুখে ও চলাফেরায় প্রথম দিনের সজীব উন্মুখতার চিহ্ন। তাঁরা বেশিক্ষণ থাকবেন না, এখানে দুপুরের খাবারের অর্ডার দিলেন।

নিস্তব্ধ দুপুরে চারদিকের পাহাড়ের মাঝখানে এ জায়গাটা স্বর্গের একটি টুকরোর মতো ছিল এতক্ষণ। অনেক মানুষের পদচারণায় কথাবার্তায় হাসি-গল্পে ও ছবি তোলার কোলাহলে পুরো পরিবেশটা বাস্তব ও প্রাণবন্ত হয়ে জেগে ওঠে। পাহাড়কে মুখর করে তোলে মানুষ। আমার হাতে অন্য একটি বই। কিন্তু মনজুড়ে থাকেন রবীন্দ্রনাথ:

‘চারিদিকে তার কত আসা-যাওয়া,

কত গীত, কত কথা—

মাঝখানে শুধু ধ্যানের মতন

নিশ্চল নীরবতা।

দূরে গেলে তবু, একা

সে শিখর যায় দেখা—

চিত্তগগনে আঁকা থাকে তার

নিত্য-নীহার-রেখা।’

আমি একা বসে থাকি। বাইরের পাহাড় ও সবুজ অরণ্যের দিকে তাকিয়ে মনে হয়, হিমালয় আছে বলেই পৃথিবী এখনো এত সুন্দর।