সবাই বলেছিল, ‘কোথাও চাকরি পাবে না,’ ছয়বারের চেষ্টায় সহকারী জজ হয়েছেন তিনি

১৬তম সহকারী জজ নিয়োগ পরীক্ষায় সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন শেখ ফারহান
ছবি: সংগৃহীত

শেখ ফারহান ভালো ছাত্র ছিলেন না কখনোই। স্কুলে প্রথম শ্রেণি থেকেই রোল নম্বর থাকত শেষ দিকে। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় এমন ফল হলো যে অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষাই দিতে পারলেন না। বাধ্য হয়ে ভর্তি হন ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানেও ব্যাকবেঞ্চার তকমা পেতে দেরি হয়নি। কোনোমতে স্নাতক শেষ করেছেন। বন্ধু ও শিক্ষকদের অনেকে বলতে শুরু করেছিলেন, ‘তোমার তো ভবিষ্যৎ অন্ধকার।’ সবাইকে ভুল প্রমাণ করে ১৬তম সহকারী জজ নিয়োগ পরীক্ষায় সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন এই তরুণ।

আট বিষয়ের ছয়টিতেই ফেল

‘যে বয়সে শিশুরা ১০০–তে ৯৯ পেয়ে কান্নাকাটি করে, সে বয়সে ১২ পাওয়ার রেকর্ডও আমার আছে। অষ্টম শ্রেণির প্রথম সাময়িক পরীক্ষায় একবার আট বিষয়ের ছয়টাতেই ফেল করেছিলাম,’ পুরোনো সেসব কথা এখন হাসিমুখেই বলেন ফারহান। উচ্চমাধ্যমিকে জিপিএ–৩.৫ নিয়েই খুশি ছিলেন তিনি।

উচ্চমাধ্যমিকের পর ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগে ভর্তি হন ফারহান। সেখানেও খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি। সিজিপিএ ছিল ৩.৩১। শেখ ফারহানের বক্তব্য, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় অনেকবার শুনতে হয়েছে, আমি নাকি কোথাও চাকরি পাব না। ভাবতাম চাকরিই যদি না হয়, খামাখা কষ্ট করে পড়াশোনা করে কী লাভ।’

আরও পড়ুন

শিশুদের সঙ্গে অ আ লিখতাম

২০১৫ সালে স্নাতক সম্পন্ন করেন শেখ ফারহান। ২০১৭ সাল থেকে বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিসের (বিজেএস) পরীক্ষায় অংশ নেওয়া শুরু করেন। তবে সফলতার দেখা পান শেষ বিজেএসে, অর্থাৎ পাঁচবার ব্যর্থ হওয়ার পর। ষষ্ঠবারে ৭০তম মেধাক্রম নিয়ে সহকারী জজ হিসেবে সুপারিশপ্রাপ্ত হন তিনি। বহুল আকাঙ্ক্ষিত এই ফলের পর শেখ ফারহান বলেন, ‘প্রচুর পড়াশোনা করতে হয়েছে। মানুষের নেতিবাচক মন্তব্যের পাহাড়ও ডিঙাতে হয়েছে। ১৬তম বিজেএসের লিখিত পরীক্ষার আগে ১৫-১৬ ঘণ্টা পড়েছি। এখনো মনে আছে, ১২তম বিজেএস পরীক্ষার ভাইভার কিছুক্ষণ আগে এক বন্ধু বলেছিল, আমার নাকি চাকরি হবে না। কারণ, আমি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।’

শেষবারে ভালো করার কৌশলটা কী ছিল? উত্তরে ফারহান বলেন, ‘স্নাতক পাস করলেও আমার মধ্যে অনেক বিষয়ে ঘাটতি ছিল। যখন যে ঘাটতি নজরে পড়ত, সে ঘাটতি পূরণে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে যেতাম। যা করার দরকার, তা–ই করতাম। একটা উদাহরণ দিই, স্নাতক পাস করার পরেও আমার হাতের লেখা ভীষণ খারাপ ছিল। হাতের লেখা ভালো করার জন্য দুই মাসের কোর্স করেছি। ছোট শিশুরা ওখানে হাতের লেখা শিখতে আসত। আমি শিশুদের সঙ্গে বসে পেনসিল দিয়ে অ আ ক খ লিখতাম। এই বয়সে এসে শিশুদের সঙ্গে অ আ ক খ লিখতে খুব লজ্জা লাগত। তখন নিজেকে বুঝালাম, সারা জীবন লজ্জা পাওয়ার চেয়ে দুই মাস লজ্জা পাওয়া অনেক ভালো।’

প্রশ্নের ভয়ে গ্রামেই যেতাম না

২০১৭ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত ফারহান বিজেএসের পেছনে লেগে ছিলেন। এ সময় নানা কঠিন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। তিনি বলছিলেন, ‘পরিচিত কারও সঙ্গে দেখা হলেই জানতে চাইত আমি কী করি। এ প্রশ্নের উত্তরে তো আর বলা যায় না যে পাঁচ-ছয় বছর ধরে বিজেএস পরীক্ষা দিয়ে যাচ্ছি, কিন্তু আউটপুট মস্তবড় একটা জিরো! এই প্রশ্নের ভয়ে একটা সময় গ্রামেই যেতাম না।’

স্বপ্ন দেখানোর কেউ ছিল না

ছোটবেলায় জজ বা আইনজ্ঞ হওয়ার কোনো ইচ্ছা ফারহানের ছিল না। তাঁর ভাষায়, ‘ছোটবেলায় আমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখার বা আমাকে স্বপ্ন দেখানোর মতো কেউ ছিল না। যে ছেলে প্রতিবছর এক-দুটি বিষয়ে ফেল করে, টেনেটুনে পাস করে, তাকে নিয়ে কেউ কখনো স্বপ্ন দেখে না।’ তবে সহকারী জজ হয়ে একটা লক্ষ্য ঠিকই নির্ধারণ করে নিয়েছেন। আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ নিশ্চিত করতে চান। বাংলাদেশের বিচার বিভাগ যেন সাধারণ মানুষের আস্থার সর্বোচ্চ চূড়া হয়ে থাকতে পারে, ফারহানের স্বপ্ন এখন সেটাই।

আরও পড়ুন