কীভাবে নিজের মূল্য বাড়াবেন এবং অন্যদের বোঝাবেন, আপনি কেন গুরুত্বপূর্ণ

নিজের মূল্য বুঝতে শেখা আর তা সঠিকভাবে প্রকাশ করা জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতা। অনেক সময় আমাদের মনে হয়, মানুষ আমাদের যথেষ্ট সম্মান বা গুরুত্ব দিচ্ছে না। কিন্তু সেটা মানে এই নয় যে আমরা অক্ষম। বরং এটি একটি সুযোগ—নিজেকে নতুনভাবে উপস্থাপন করার, নিজের ক্ষমতা ও গুরুত্বকে অন্যদের সামনে স্পষ্টভাবে দেখানোর। মানুষ আমাদের যেভাবে দেখে, তার অনেকটাই নির্ভর করে আমরা নিজেদের কীভাবে উপস্থাপন করি তার ওপর। আমরা কীভাবে নিজেদের মূল্য প্রকাশ করি, আমাদের কথা ও আচরণে কী আত্মবিশ্বাস আছে এবং আমরা আমাদের সীমারেখা ঠিকভাবে নির্ধারণ করি—এসবই শেষ পর্যন্ত নির্ধারণ করে অন্যরা আমাদের প্রতি কেমন আচরণ করবে। এবার দেখা যাক, কীভাবে আপনি নিজের মূল্য বাড়াতে পারেন।

নিজের মূল্য বুঝতে শেখা আর তা সঠিকভাবে প্রকাশ করা জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতামডেল: রিয়াদ ও বাপ্পি। ছবি: সুমন ইউসুফ

নিজের মূল্য বুঝুন

অন্যদের কাছে মূল্যবান হতে চাইলে প্রথমে নিজেকে মূল্য দিতে জানতে হবে। অনেক সময় আমরা নিজেরাই নিজেদের কম গুরুত্ব দিই; কারণ, অন্যের মতামতের ওপর অতিরিক্ত নির্ভর করি। কিন্তু সত্য হলো, আপনি অনন্য। আপনার ক্ষমতা, দক্ষতা ও ভাবনাই আপনাকে বিশেষ করে তোলে।

আপনার শক্তিগুলো লিখে রাখুন: আপনার ছোট ছোট অর্জনও লিখে রাখুন। অনেক সময় আমরা ছোট সফলতাগুলোকে গুরুত্ব দিই না, কিন্তু এই ছোট ছোট অর্জনই আপনার বড় আত্মবিশ্বাসের ভিত্তি তৈরি করে। এসব আপনাকে মনে করিয়ে দেয়, আপনি প্রতিদিনই একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছেন।

ছোট ছোট অর্জনই আপনার বড় আত্মবিশ্বাসের ভিত্তি তৈরি করে
মডেল: নাবিলা, পোশাক: কিউরিয়াস, সাজ: শোভন মেকওভার। ছবি: সুমন ইউসুফ

আপনার বিশেষত্ব চিনুন: প্রত্যেক মানুষেরই কিছু অনন্য গুণ থাকে; সেটা দক্ষতা, দয়া বা প্রত্যুৎপন্নমতি—যা-ই হোক না কেন, তা অন্য কারও সঙ্গে পুরোপুরি মেলে না। নিজের সেই বিশেষ দিকগুলো চিনতে পারলে আপনি জানবেন ঠিক কোন কোন ক্ষেত্রে আপনি বিশেষ। নিজের বিশেষত্ব চিনে নেওয়া হলো নিজেকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করার প্রথম ধাপ।

নিজের ওপর বিশ্বাস রাখুন: অন্যের নেতিবাচক মন্তব্যে কখনো ভেঙে পড়বেন না। নিজের ক্ষমতায় আস্থা রাখুন। অর্থাৎ নিজের ওপর বিশ্বাস রাখুন।

আরও পড়ুন

স্পষ্ট ও আত্মবিশ্বাসীভাবে কথা বলুন

মানুষের কথা বলার ভঙ্গি খুবই শক্তিশালী। আপনি কীভাবে কথা বলেন, কীভাবে নিজেকে প্রকাশ করেন, তা দেখেই মানুষ বোঝে আপনি নিজেকে কতটা মূল্য দেন। তাই প্রতিদিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কথা বলার অভ্যাস করুন।

দৃঢ় বা স্পষ্ট করে কথা বলুন: কথা বলার সময় ‘মনে হয়’, ‘হতে পারে’ এ ধরনের শব্দগুচ্ছ ব্যবহার না করে ‘আমি জানি’, ‘আমি নিশ্চিত’—এভাবে কথা বলুন। এতে আপনার দৃঢ়তা প্রকাশ পায়। তবে কোনো বিষয়ে নিশ্চিত না হয়েই এসব বললে আপনি বরং ছোট হবেন।

সংক্ষেপে কথা বলুন: কথা বলার সময় সংক্ষেপেই বলুন। অপ্রয়োজনীয় কথা বলবেন না। দেখবেন, আপনার মূল্য বাড়বে।

আত্মবিশ্বাস দেখান: সব সময় পুরোপুরি নিশ্চিত না হলেও পরিষ্কার ও দৃঢ়ভাবে কথা বলুন। আপনার আত্মবিশ্বাসই অন্যদের ওপর ভালো প্রভাব ফেলবে।

শুধু কথায় নয়, কাজই মানুষকে সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করায়
মডেল: রিয়াদ ও বাপ্পি। ছবি: সুমন ইউসুফ

কাজে আপনার মূল্য দেখান

শুধু কথায় নয়, কাজই মানুষকে সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করায়। কারণ, কাজের মাধ্যমে আপনি আসলে দেখাতে পারেন আপনি কী করতে পারেন এবং আপনার মূল্য ঠিক কোথায়।

আপনার সময়ও মূল্যবান: সময় কোথায় দিচ্ছেন, সেটি ঠিক করুন। সব জায়গায় আপনার সময় ব্যয় করবেন না। পৃথিবীতে সবচেয়ে মূল্যবান হলো সময়। আপনার প্রতিটি সেকেন্ডের দাম আছে, এটা সবাইকে বোঝান।

যেকোনো কাজে সেরা হওয়ার চেষ্টা করুন: যেকোনো কাজ করার সময় নিজের সেরাটা দেওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন। আপনি সেরাটা দিলে মানুষ তা সহজেই বুঝতে পারে এবং স্বাভাবিকভাবেই আপনাকে গুরুত্ব দেয়।

অন্যকে সাহায্য করুন, তবে সীমা রাখুন: আপনাকে অবশ্যই দয়ালু হতে হবে, কিন্তু একই সঙ্গে নিজের সময় ও শক্তির প্রতি সম্মান রাখবেন। সাহায্য করুন, তবে যেন তা আপনাকে ক্লান্ত বা ক্ষতিগ্রস্ত না করে।

আরও পড়ুন

যারা আপনাকে মূল্য দেয় না, তাদের সঙ্গে সীমা নির্ধারণ করুন

অনেক সময় মানুষ আপনাকে গুরুত্ব দেয় না; কারণ, তারা আপনাকে স্বাভাবিক ধরে নেয়। যারা আপনাকে সম্মান দেয় না, তাদের প্রতি আপনি বাধ্য হয়ে সম্মান দেখাবেন না। সীমা নির্ধারণ করা খারাপ কিছু নয়, এটি আসলে আপনার নিজের প্রতি সম্মান দেখানোর একটি উপায়।

প্রয়োজনে দূরত্ব তৈরি করুন: কেউ বারবার অসম্মান করলে তাঁর থেকে একটু দূরত্ব বজায় রাখুন। এতে আপনার নিজের মূল্য আরও স্পষ্ট হয়ে উঠবে এবং লোকজন আপনাকে ঠিকভাবে গুরুত্ব দিতে শিখবে।

আপনার সীমা স্পষ্ট করুন: আপনি কোন আচরণ পছন্দ করেন আর কোনটা করেন না, সেটা স্পষ্ট করে জানিয়ে দিন। এতে আপনার মূল্য বাড়বে বৈ কমবে না।
সম্মান রক্ষা করে প্রতিক্রিয়া দিন: কোনো বিষয়ে রাগ উঠলে রাগ না করে ঠান্ডা মাথায় প্রতিক্রিয়া জানান। এতে আপনার মূল্য বাড়বে এবং অন্যরা বুঝতে পারবে আপনি নিজেকে এবং সম্পর্ককে সম্মান দেন।

এমন বন্ধু নির্বাচন করুন, যাঁরা সব সময় আপনাকে উৎসাহ, সমর্থন দেন এবং প্রয়োজনে আপনার সঠিক সমালোচনাও করেন
মডেল: আরশাদ, সামির, আদিবা, মুনকার এবং তানজিম। ছবি: সুমন ইউসুফ

ইতিবাচক মানুষের সঙ্গে থাকুন

আপনার চারপাশের মানুষ আপনার মানসিকতার ওপর বড় প্রভাব ফেলে। তাই যিনি সব সময় আপনাকে উৎসাহ দেন তাঁর সঙ্গে ভালো যোগাযোগ রাখুন।

সঠিক ও সহায়ক বন্ধু বেছে নিন: এমন বন্ধু নির্বাচন করুন, যাঁরা সব সময় আপনাকে উৎসাহ, সমর্থন দেন এবং প্রয়োজনে আপনার সঠিক সমালোচনাও করেন। ভালো বন্ধুত্ব আপনার নিজের মূল্য বাড়াতেও সহায়ক হয়।
নেতিবাচক মানুষ থেকে দূরে থাকুন: যাঁরা সব সময় আপনাকে খাটো করেন, তাঁদের থেকে দূরে থাকুন।

সংখ্যার চেয়ে গুণগত সম্পর্ককে গুরুত্ব দিন: বন্ধু বেশি হলেই যে আপনার মূল্য বেশি, তা নয় কিন্তু। প্রকৃত বন্ধু একজন মানুষের জন্য অনেক প্রয়োজন। তাই কম হলেও সত্যিকারের বন্ধু থাকলে সেটাই যথেষ্ট।

আরও পড়ুন

জীবনের স্পষ্ট নীতি তৈরি করুন

আপনার চরিত্র ও সিদ্ধান্তগুলো অনেকটাই নির্ভর করে আপনার নীতির ওপর।

আপনি কী চান, তা জানুন: আগে আপনার লক্ষ্য ও অগ্রাধিকার কী, সেটা স্পষ্ট করুন। লক্ষ্য ঠিক না থাকলে আপনি এগোবেন কীভাবে?

নিজের মূল্যবোধ ধরে রাখুন: শুধু খুশি করতে বা মানিয়ে নিতে নিজের নীতি ভাঙবেন না। নিজের মূল্যবোধ ধরে রাখা জরুরি।

দয়া ও দৃঢ়তার সমন্বয় করুন

সদয় হওয়া গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু শুধু সদয় হলে অনেক সময় মানুষ সুযোগ নেয়। তাই দয়া ও দৃঢ়তা—দুটিই দরকার।

সম্মান রেখে দৃঢ় হোন: ভদ্র বা নমনীয় হওয়া ভালো, তবে নিজের অধিকার কখনোই ছাড়বেন না।

সীমা বজায় রাখুন: কেউ সীমা ছাড়ালে শান্তভাবে তা মনে করিয়ে দিন। এতে অন্যরা বুঝবেন আপনার সীমার প্রতি সম্মান দেখানো জরুরি।

কঠিন সময়ে ইতিবাচক থাকুন: মানুষের জীবনে কঠিন সময় আসেই। এ সময় শান্তভাবে পরিস্থিতি সামলাতে হবে এবং ইতিবাচক থাকতে হবে।

প্রতিদিন বই পড়ুন, নতুন নতুন কোর্স করুন বা অভিজ্ঞতা অর্জন করুন
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

জ্ঞান ও দক্ষতায় বিনিয়োগ করুন

আপনি যত শিখবেন এবং নিজের দক্ষতা উন্নত করবেন, আপনার মূল্য তত বাড়বে। নতুন জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অর্জনের মাধ্যমে আপনি শুধু নিজের ক্ষমতা বৃদ্ধি করবেন না, বরং অন্যরাও সহজে বুঝবে আপনি কতটা মূল্যবান।

নিরন্তর শিখুন: প্রতিদিন বই পড়ুন, নতুন নতুন কোর্স করুন বা অভিজ্ঞতা অর্জন করুন। অর্থাৎ প্রতিদিন কিছু না কিছু শেখার চেষ্টা করুন। এ অভ্যাস গড়ে তুললে আপনার জ্ঞান ও দক্ষতা ক্রমেই বৃদ্ধি পাবে, যা আপনাকে আরও মূল্যবান করবে।

নিজের দক্ষতা আয়ত্ত করুন: আপনার দক্ষতা যত বাড়বে, মানুষ ততই স্বাভাবিকভাবে আপনার মূল্য বুঝতে শুরু করবে। নিয়মিত চর্চা ও পরিশ্রমের মাধ্যমে আপনি নিজের ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করবেন এবং অন্যদের কাছে অপরিহার্য হয়ে উঠবেন।

নিজেকে উন্নত করুন: নিজেকে উন্নত করার চেষ্টা করুন এবং ধীরে ধীরে নিজের সেরা সংস্করণে রূপান্তর করুন। নিয়মিত প্রচেষ্টা ও আত্মসমালোচনার মাধ্যমে আপনি আরও দক্ষ এবং আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠবেন।

আরও পড়ুন

সহানুভূতি ও বোঝাপড়া চর্চা করুন

অনেক সময় মানুষ আপনাকে মূল্য দেয় না; কারণ, তারা আপনাকে ঠিকভাবে বোঝে না। অন্যদের দৃষ্টিভঙ্গি বোঝার চেষ্টা করুন।

নিজেকে সত্যিকারভাবে দেখুন: ভালো-মন্দ মিলেই তো মানুষ। তাই প্রয়োজনে নিজের ভুলগুলো শুধরে নিন।

সহানুভূতিশীল থাকুন: কখনো কারও সঙ্গে দ্বন্দ্ব হলে শান্ত ও সহানুভূতির সঙ্গে সমাধান করুন। এতে সম্পর্ক বজায় থাকে এবং মানুষ আপনার মানসিকতা ও মূল্য বোঝে।

অন্তরের শান্তি ও ভারসাম্য খুঁজে নিন

মনের ​দ্বিধা এড়াতে ইতিবাচক ভাবনা ভাবুন
মডেল: শ্রাবণ্য। ছবি: প্রথম আলো

আপনার অন্তরের শান্তি আপনার আচরণে ফুটে ওঠে। যাঁরা ভেতরে স্থির এবং শান্ত থাকেন, মানুষ স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং তাঁদের প্রতি সম্মান দেখায়।

নিজের জন্য সময় নিন: প্রতিদিন কিছু সময় নিজেকে দিন। চুপচাপ বসুন, ভাবুন, বিশ্রাম নিন এবং নিজের মানসিক ও শারীরিক শক্তি পুনরায় জোগাড় করুন।

কৃতজ্ঞতা অনুশীলন করুন: সব সময় নেতিবাচক দিকগুলো নিয়ে ভাববেন না। জীবনের ভালো দিকগুলো ভাবুন। মানসিক, শারীরিক, ইমোশনাল উন্নতিতে মন দিন।

সবশেষে
আপনার মূল্য কখনোই অন্যের ওপর ওপর নির্ভর করে না। এটি নির্ভর করে আপনি নিজেকে কীভাবে দেখেন ও উপস্থাপন করেন তার ওপর।
মনে রাখবেন, আপনার মূল্য আপনার মধ্যেই আছে। প্রথমে নিজেকে মূল্য দিন, পৃথিবী আপনাকে অনুসরণ করবে।

সূত্র: মিডিয়াম

আরও পড়ুন