শেখার সেরা উপায় কোনটি—পড়া নাকি শোনা
চোখ বন্ধ করে আজ থেকে কয়েক শ বছর পরের পৃথিবীর কথা ভাবুন। মানুষ হয়তো তখন নভোযানে চড়ে এক গ্যালাক্সি থেকে আরেক গ্যালাক্সিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। হয়তো বাস করছে নভোযানে কিংবা সমুদ্রের তলদেশে।
আবার বেগুনি আকাশ আছে, এমন কোনো গ্রহেও পাড়ি জমাতে পারে। এবার কল্পনা করুন, শত শত বছর পরের একটি বেডরুম। আপনি সেখানে বসে আছেন। ঘরের জানালা দিয়ে হয়তো দেখছেন শনির বলয় বা সমুদ্রের তলদেশ।
এবার নিজেকে একটা প্রশ্ন করুন। আপনার সেই কল্পিত ঘরে কি কোনো বই থাকবে?
এবার চোখ খুলুন। সম্ভবত আপনার হাতের নাগালেই কোনো না কোনো বই আছে। বিছানার আশপাশে কিংবা খাটের নিচেও থাকতে পারে। কিন্তু কেন?
পডকাস্ট আর অডিওবুকের এই যুগেও কেন বই টিকে আছে? আমরা তো এখন চাইলে প্রায় সবই শুনে নিতে পারি। তাহলে বই পড়ার গুরুত্বটা ঠিক কোথায়?
ভাষাবিজ্ঞানী হিসেবে ঠিক এসব বিষয় নিয়েই গবেষণা করেন স্টেফানি এন ডেল টুফো। এমআরআই (ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স ইমেজিং) এবং ইইজির (ইলেকট্রোএনসেফ্যালোগ্রাফি) মতো যন্ত্র ব্যবহার করে তিনি পরীক্ষা করে দেখেন, আমাদের মস্তিষ্ক কীভাবে লেখা এবং শোনার ভাষাকে গ্রহণ করে।
পড়া ও শোনার পার্থক্য
বই পড়া বা অডিও শোনার লক্ষ্য একটাই—কোনো বিষয়কে বোঝা। কিন্তু এই দুটি কাজ এক নয়। পড়া বা শোনার সাহায্যে আমরা যেকোনো বিষয় বুঝতে পারি, তবে ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে।
শোনার মাধ্যমে পড়ার সব সুবিধা পাওয়া যায় না, আবার পড়ার মাধ্যমেও পাওয়া যায় না শোনার সবটুকু। দুটোই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু একটি অপরটির বিকল্প নয়।
আপনি যখন কোনো বই পড়েন, আপনার মস্তিষ্ক পর্দার আড়ালে অনেকগুলো কঠিন কাজ করে। অক্ষরের আকৃতি চেনা, সেসবকে শব্দের সঙ্গে মেলানো, শব্দের অর্থ বের করা এবং বইজুড়ে সেসব অর্থ একসুতায় বাঁধা।
দাঁড়ি, কমা, নতুন অনুচ্ছেদসহ আরও অনেক কিছু মাথায় রেখে পড়তে হয়। আর সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, আপনি নিজের গতিতে পড়তে পারেন। দ্রুত পড়বেন নাকি ধীরে, তা আপনার ওপর নির্ভর করে।
কিন্তু শোনার সময় আপনাকে বক্তার গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে শুনতে হবে। বক্তা হয়তো ধীরে ধীরে বলে, যা আপনার পছন্দ না–ও হতে পারে। আবার অতিরিক্ত দ্রুত পড়লে আপনার বুঝতে অসুবিধাও হতে পারে।
আবার কোনো গল্প কথ্য ভাষায় শুনলে তা মনে রাখার জন্য মস্তিষ্ককে স্মৃতির ওপর অনেক বেশি নির্ভর করতে হয়।
এ ছাড়া কথা বলার সময় শব্দগুলো তো আলাদা থাকে না, একসঙ্গে মিশে যায়। সেই মিশে যাওয়া শব্দ থেকে মস্তিষ্ককে দ্রুত শব্দ খুঁজে বের করতে হয়।
বুঝতে হয় তার অর্থ এবং বক্তার গলার স্বর ও পরিস্থিতি। এসব মিলিয়ে গল্প বা কবিতার আসল ভাবটা ধরতে হয়।
কোনটা সহজ
অনেকেই ভাবেন, শোনা পড়ার চেয়ে সহজ। কিন্তু গবেষণা বলছে, ব্যাপারটা সব সময় ঠিক নয়। বরং কঠিন বা নতুন কোনো বিষয় শোনার চেয়ে পড়াটাই বেশি সহজ। কারণ, পড়ার সময় আপনি সহজেই যেকোনো অংশে ফিরে যেতে পারেন।
কঠিন জায়গাটা পড়তে পারেন বারবার বা গুরুত্বপূর্ণ লাইনটা দাগিয়ে রাখতে পারেন। কিন্তু শোনার সময় এটা করা বেশ কঠিন এবং তা শোনার প্রবাহকে নষ্ট করে দেয়।
তবে কিছু মানুষের জন্য শোনাটাই বেশি সহজ। যেমন যাঁরা ডিসলেক্সিয়ায় আক্রান্ত। ডিসলেক্সিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা প্রায়ই লিখিত শব্দকে সঠিকভাবে উচ্চারণ করতে বা তার অর্থোদ্ধার করতে সমস্যায় পড়েন। শোনার ক্ষেত্রে এই কঠিন প্রক্রিয়া এড়িয়ে যাওয়া যায়।
এরপর আছে মনোযোগের ব্যাপার। আমরা প্রায়ই অন্য কাজ করতে করতে কিছু শুনি। যেমন ব্যায়াম করার সময়, রান্না করার সময় বা ইন্টারনেট ঘাঁটার সময়।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, একদল ছাত্রকে একটি লেখা পড়তে এবং আরেক দলকে একই বিষয়ের একটি পডকাস্ট শুনতে দেওয়া হয়েছিল।
তাতে দেখা যায়, পড়ার দলটি শোনার দলের চেয়ে অনেক ভালো করেছে। কারণ, যারা শুনেছিল, তাদের অনেকেই অন্য কাজও করছিল। শোনার সময় মনোযোগ দেওয়া পড়ার সময় মনোযোগ দেওয়ার চেয়েও বেশি জরুরি।
কোনটা বেশি জরুরি
পড়া নাকি শোনা—বেশি জরুরি কোনটা? আদতে প্রযুক্তির এই যুগেও বই পড়াই বেশি জরুরি। প্রতিটি কাজের নিজস্ব গুরুত্ব আছে এবং তারা একে অপরের পরিপূরক, তবে বিকল্প নয়।
শেখার সেরা উপায় হিসেবে পড়া এবং অডিওকে এক জিনিস না ভেবে দুটিকে আলাদাভাবে দেখা উচিত। দুটিরই আলাদা গুরুত্ব আছে। তবে পড়া বা শোনার মধ্যে যেকোনো একটি বেছে নিতে হলে পড়ার পাল্লাই বেশি ভারী হবে।
সূত্র: মিডিয়াম