‘মাস্টার্সের আগে কমপক্ষে দুই বছর চাকরি করে আসতে পারলে ভালো’

ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক শামস্‌ রহমান। তিনি সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট বিষয়ের একজন আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বিশেষজ্ঞ। বাংলাদেশে মাস্টার্স ডিগ্রির নানা দিক নিয়ে কথা হলো তাঁর সঙ্গে।

প্রথম আলো:

বাইরের দেশের তুলনায় আমাদের দেশে মাস্টার্সের ধারণা কি কিছুটা আলাদা? সাধারণত দেখা যায়, মাস্টার্স মূলত তাঁরাই করেন, যাঁরা একাডেমিক ক্ষেত্রে কাজ করতে চান, শিক্ষক বা গবেষক হতে চান। আমাদের দেশের পটভূমিটা ভিন্ন কেন?

আপনার এই ধারণাটা হয়তো পুরোপুরি সঠিক নয়। বিদেশেও অনেকেই মাস্টার্স করেন, বিশেষ করে ‘অ্যাপ্লায়েড ডিসিপ্লিন’গুলোয়। যেসব বিষয়ের দক্ষতা শিল্পক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক প্রয়োগ সম্ভব, সেসব বিষয় বা ডিসিপ্লিনে মাস্টার্সের চাহিদা বেশি। যেমন ধরুন, সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট, সাপ্লাই চেইন অ্যান্ড লজিস্টিক ম্যানেজমেন্ট, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, মেশিন লার্নিং, থ্রিডি প্রিন্টিং, ব্লক চেইন, সাইবার সিকিউরিটি, ডেটা সায়েন্স অ্যান্ড অ্যানালিটিকস ইত্যাদি বিষয়ে দক্ষ মানবসম্পদের চাহিদা যেমন বেড়েছে; তেমনি এসব বিষয়ে মাস্টার্স প্রোগ্রামের চাহিদাও বেড়েছে। আমাদের দেশেও উত্তরোত্তর এসব বিষয় প্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের এখানে মাস্টার্স অনেক সময় চাকরির বা পদোন্নতির ক্ষেত্রে একটি ‘অতিরিক্ত যোগ্যতা’ হিসেবে দেখা হয়। তবে আমি বলব মাস্টার্স হওয়া উচিত প্রায়োগিক দক্ষতা কীভাবে বৃদ্ধি পাবে, সেই বিষয় লক্ষ্য রেখে।

প্রথম আলো:

একজন শিক্ষার্থী যখন মাস্টার্সে ভর্তি হন, তখন তাঁর লক্ষ্য কী হওয়া উচিত? কীভাবে নিজেকে অনুপ্রাণিত রাখা উচিত?

একজন শিক্ষার্থী যদি শিক্ষা ও গবেষণাক্ষেত্রে কাজ করতে চান, তাহলে তাঁকে মাস্টার্সের জন্য একধরনের প্রস্তুতি নিতে হবে, আর তিনি যদি প্র্যাকটিক্যাল ফিল্ডে কাজ করতে চান, তাহলে অন্য ধরনের প্রস্তুতি নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে নিজেকে এবং মার্কেটটাকে যথাযথভাবে অনুসন্ধান করা আবশ্যক। তাঁর কী ধরনের দক্ষতা আছে এবং বাজারে সে দক্ষতার কতখানি চাহিদা আছে, তা বিশদভাবে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। এখানে পুরকৌশলের উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। স্নাতকে এই ডিগ্রি অর্জনের পর কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করে কারও মনে হতে পারে তাঁর ‘প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট’, ‘কনস্ট্রাকশন ম্যানেজমেন্ট’ কিংবা ‘সার্ভেয়ার’ বিষয়ে দক্ষতা অর্জন প্রয়োজন। তখন তাঁর জন্য ওই বিষয়গুলোতে পোস্টগ্র্যাজুয়েট সার্টিফিকেট কোর্স কিংবা মাস্টার্স করা প্রয়োজন হয়ে দাঁড়ায়। অর্থাৎ কেউ যদি চাকরিরত থাকেন এবং সেখানকার প্রয়োজনীয় চাহিদা অনুযায়ী সেই বিষয়ে একটা মাস্টার্স করেন, সেটাই হবে তাঁর জন্য উপযোগী সিদ্ধান্ত।

আরও পড়ুন
প্রথম আলো:

অনেকে ব্যাচেলর এক বিষয়ে করে মাস্টার্স করেন আরেক বিষয়ে। এটাকে কীভাবে দেখেন?

এটাকে আমি একটা সুযোগ বলে মনে করি। যেমন ধরুন গণিতে কেউ স্নাতক করলেন, কারণ তাঁর গণিতে আগ্রহ ও দক্ষতা বেশি। কিন্তু একটা পর্যায়ে গিয়ে তিনি দেখলেন পেশাজীবনে এগোতে গেলে গণিতে সুযোগ সীমিত। তখন তিনি তাঁর পেশা পরিবর্তনের জন্য অন্য বিষয়ে মাস্টার্স করতে পারেন। যেমন গণিতের পর অর্থনীতি, ডিসরাপটিভ টেকনোলজি, কম্পিউটারবিজ্ঞান বা ডেটা সায়েন্সে মাস্টার্স করতে পারে। এসব ক্ষেত্রেও কিন্তু গণিতের ব্যাপক প্রভাব আছে। অনেকে আবার প্রকৌশলে পড়ে এমবিএ করেন। কারণ, তাঁরা ক্যারিয়ারটা প্রকৌশল থেকে ব্যবস্থাপনার দিকে নিতে চান। এটা দীর্ঘ সময় ধরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে হয়ে আসছে। আমাদের দেশে টেকনোলজিক্যাল ডেভেলপমেন্ট লেভেলের কারণে একজন প্রকৌশলীকে কর্মজীবনের শুরু থেকেই ব্যবস্থাপনার কাজে মনোনিবেশ করতে হয়। তাই প্রকৌশল দক্ষতার পাশাপাশি ব্যবস্থাপনার দক্ষতা আবশ্যক হয়ে দাঁড়ায়।

আরও পড়ুন
প্রথম আলো:

গবেষণার সুযোগ মাস্টার্সে কীভাবে কাজে লাগানো উচিত? ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই সুযোগ কতটা আছে?

ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন মাস্টার্সের শিক্ষার্থী অথবা যেকোনো শিক্ষার্থীকে একজন শিক্ষকের সঙ্গে যুক্ত থাকতে হয়। তাঁরা সেই শিক্ষকের সঙ্গে যৌথভাবে গবেষণা করতে পারেন। তাঁদের প্রকল্প থাকে, তাঁরা সেই গবেষণা প্রকাশ করতে পারেন। আমাদের সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং আছে, সেখানে গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় ফান্ডিং আছে।। এমনকি ওই গবেষণার ফলাফল উপস্থাপন করতে সম্মেলনে যাওয়ার জন্যও আমাদের শিক্ষার্থীদের তহবিল দেওয়া হয়। মাস্টার্সের পাশাপাশি গবেষণা করতে পারলে ভবিষ্যতে পিএইচডির ক্ষেত্রে প্রাধান্য পাওয়া যায়। ভিনদেশে পিএইচডির আবেদনের সময় কিন্তু তাঁরা সিজিপিএ দেখেন না। সিজিপিএ অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি মানদণ্ড, কিন্তু এর সঙ্গে তাঁরা দেখে গবেষণার কতটুকু অভিজ্ঞতা আছে। যদি কোনো প্রকাশনা থাকে, তাহলে সেটার মূল্যায়ন অনেক।

প্রথম আলো:

আপনার নিজের মাস্টার্স করার অভিজ্ঞতা শুনতে চাই। ব্যাচেলরের পরপরই কি মাস্টার্সে ভর্তি হয়ে গিয়েছিলেন? কীভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন?

আমি মাস্টার্স করার আগে দুটি প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছি। আণবিক শক্তি কমিশন ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন, বিআরটিসিতে কাজ করেছি। পরে যখন মাস্টার্স করতে যাই, তখন দেখি অনেক কোর্স কেসভিত্তিক। ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে মাস্টার্স করি। ওখানকার প্রজেক্ট এবং অ্যাসাইনমেন্টে আমার কর্মজীবনের অভিজ্ঞতাগুলো দারুণভাবে কাজে লেগেছিল। সে জন্যই আমি মনে করি, মাস্টার্স প্রোগ্রামে যাওয়ার আগে একজন গ্র্যাজুয়েট কমপক্ষে দুই বছর চাকরি করে আসতে পারলে ভালো।