কারখানার অন্ধকারে কতগুলো দিন

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর বেশ কবছর ধরে বই আকারে প্রকাশ করছে স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের সংগৃহীত ‘মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী–ভাষ্য’। নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতেই তাদের এই উদ্যোগ। জাদুঘরের আহ্বানে সাড়া দিয়ে শিক্ষার্থীরা পরিচিতজনদের সঙ্গে আলাপ করে একাত্তরের স্মৃতি লিখিতভাবে পাঠায়। ফলে এই কর্মসূচি এক অর্থে বিনিময়। যেখানে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর বয়ে নিয়ে যাচ্ছে ইতিহাস এবং শিক্ষার্থীরা জোগান দিচ্ছে ইতিহাসের নতুন উপাদান। শিক্ষার্থীদের পাঠানো এসব ভাষ্য থেকে বাছাই ৩১টি কাহিনি বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে প্রকাশ করছে প্রথম আলো

সংগ্রহকারী: মাসরুকা আক্তার, নবম শ্রেণি (স্মৃতিকথা সংগ্রহের সময়), ফতুল্লা পাইলট উচ্চবিদ্যালয়, নারায়ণগঞ্জ

বর্ণনাকারী: মো. সিরাজুল ইসলাম, ফতুল্লা, নারায়ণগঞ্জ

আমি তখন নারায়ণগঞ্জের গোদনাইলে ২ নম্বর কটন মিলে ছিলাম
অলংকরণ: কাইয়ুম চৌধুরী

২৫ মার্চ ১৯৭১। সন্ধ্যা থেকেই সবার মধ্যে চাপা আতঙ্ক। রাত যত বাড়ছে, আতঙ্ক তত বাড়ছে। রাত ১২টার দিকে গোলাগুলির ভীষণ শব্দ শোনা যাচ্ছে, মানুষের ছোটাছুটির আওয়াজ আর গুঞ্জন। এর মধ্যে লোকজন ঢাকা শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে ছুটছে। আমি তখন নারায়ণগঞ্জের গোদনাইলে ২ নম্বর কটন মিলে ছিলাম।

পরদিন ২৬ মার্চ সকালে আমরা সপরিবার মিলের ভেতরে চলে গেলাম। আমার বাবা তখন ওই মিলে নিরাপত্তা প্রহরী হিসেবে কর্মরত। তাঁর ডিউটি ছিল সকাল ১০টা পর্যন্ত। এর মধ্যে সকাল ৯টার দিকে মিলের সদর দরজা ভেঙে পাকিস্তানি সেনাদের গাড়ি ভেতরে আসে।

আরও পড়ুন

তখন আমি বাইরে বেরিয়েছিলাম। পাকিস্তানি বাহিনীর গাড়ি আমার সামনে এসে থামে, তারা আমাকে কী যেন বলে, কিছুই বুঝি না।

তখন পেছন থেকে আমার মাথার একটু নিচে বন্দুক তাক করে বলে, ‘উসকো মার দো।’
ভয়ে আমি মাটিতে লুটিয়ে পড়ি। এই দেখে পাকিস্তানি সেনারা আমাকে না মেরে মিলের ভেতরের অফিসে ঢুকে কয়েকজনকে ধরে নিয়ে যায়। যাওয়ার আগে উড়িয়ে দিয়ে যায় পাকিস্তানেরা পতাকা।

পাকিস্তানি সেনারা চলে গেলে মিলের ভেতরে ঢুকে দেখি, ছয়-সাতজনকে গুলি করে মেরে ফেলেছে। নারায়ণগঞ্জ জেলার সিদ্দিকগঞ্জের গোদনাইলে ২ নম্বর সেক্টরের ঠিক ডান দিকে দেখি, কয়েকজন নারীকে নৃশংসভাবে নির্যাতন করে মেরে ফেলেছে ওরা। কেবল নারী নয়, শিশুও ছিল মৃতদের মধ্যে।

আরও পড়ুন

ভয়ে সাত-আট দিন আমার পরিবার ও মিলের ভেতরের লোকজনকে বয়লারের নিচে লুকিয়ে থাকি। অন্ধকারে কেবল মুড়ি খেয়ে দিন কাটাই। এই মিলেই এভাবে কয়েক মাস কেটে যায়। একদিন খবর পেয়ে মিলে আবার হানা দেয় পাকিস্তানি সেনারা।

সবাইকে সারবেঁধে দাঁড় করায়। আমার পরিবারের সঙ্গে আমিও ছিলাম ওই সারিতে। আমাদের গুলি করার ঠিক আগমুহূর্তে আল্লাহর অশেষ রহমতে সেখানে উপস্থিত হন মুক্তিযোদ্ধারা। আমরা বেঁচে যাই।

আরও পড়ুন