মুক্তিযুদ্ধের সাক্ষী
রাতে আশ্রয় নিলাম অচেনা এক বৃদ্ধার বাড়িতে
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর বেশ কবছর ধরে বই আকারে প্রকাশ করছে স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের সংগৃহীত ‘মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী–ভাষ্য’। নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতেই তাদের এই উদ্যোগ। জাদুঘরের আহ্বানে সাড়া দিয়ে শিক্ষার্থীরা পরিচিতজনদের সঙ্গে আলাপ করে একাত্তরের স্মৃতি লিখিতভাবে পাঠায়। ফলে এই কর্মসূচি এক অর্থে বিনিময়। যেখানে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর বয়ে নিয়ে যাচ্ছে ইতিহাস এবং শিক্ষার্থীরা জোগান দিচ্ছে ইতিহাসের নতুন উপাদান। শিক্ষার্থীদের পাঠানো এসব ভাষ্য থেকে বাছাই ৩১টি কাহিনি বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে প্রকাশ করছে প্রথম আলো।
সংগ্রহকারী: সাদিয়া সুলতানা, নবম শ্রেণি (স্মৃতিকথা সংগ্রহের সময়), ফতুল্লা পাইলট উচ্চবিদ্যালয়, নারায়ণগঞ্জ
বর্ণনাকারী: নাম পাওয়া যায়নি
সংগ্রহকারী ও বর্ণনকারীর সম্পর্ক: নাতনি–নানি
মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা ছিলাম খুলনা শহরে। চতুর্দিকে গোলাগুলি। খুলনা শহরে আর থাকা যাবে না, যেতে হবে নিজ বাড়ি মাদারীপুরের শিবচর। তবে খুলনায় যত দিন ছিলাম, ঘরে থাকা সম্ভব হতো না। পাকিস্তানি বাহিনীর নির্যাতন ক্রমশই বাড়ছিল।
উপায় না পেয়ে আমরা অনেকে মিলে জঙ্গলে আশ্রয় নিলাম। দুপুরের দিকে গোলাগুলি একটু কমলে বাসায় গিয়ে চুলায় চাল চড়িয়ে দিতাম। কোনোরকমে চাল আধা সেদ্ধ হলেই জঙ্গলে নিয়ে খাবারের ব্যবস্থা করা হতো। কোনো কোনো দিন রান্নাও হতো না।
আমার ছোট্ট পাঁচ মাস বসয়ী মেয়েটি ক্ষুধায় ভীষণ কষ্ট পেত। এভাবে চলতে চলতে খুলনার অবস্থা ক্রমশ খারাপ হচ্ছিল। তাই মৃত্যুঝুঁকি মাথায় রেখেই আমরা রওনা হলাম গ্রামের দিকে।
হেঁটেই রওনা হলাম আমরা। আমার স্বামী সামনে, আমি অনেকটা পেছনে পড়ে রইলাম। এর মধ্যে অচেনা এক লোককে আমার দিকে আসতে দেখে পাকিস্তানি সেনা মনে করে রাস্তায় ভীষণ ভয়ে আমি অস্থির। তবে লোকটি বললেন, ‘আপনার ভয় নেই, আমি মুক্তিযোদ্ধা, আপনি যান।’
রাতে লঞ্চঘাটে পৌঁছালাম। রাতে আশ্রয় নিলাম অচেনা এক বৃদ্ধার বাড়িতে। তিনি আমাদের দেখে দৌড়ে এসে আমার কোল থেকে মেয়েটিকে নিয়ে দুধ খাওয়ানোর ব্যবস্থা করলেন। তাঁর ঘরে যা ছিল, তা–ই আমাদের খেতে দিলেন।
গভীর রাতে ঘাটে লঞ্চ ভিড়ল, কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনীর ভয়ে তারা ছাড়বে না। অনেক অনুরোধের পর আমাদের নিয়ে লঞ্চটি ছাড়ল। সবার মুখ শুকনো, এই বুঝি মিলিটারি এল। অবশেষে টেকেরহাট এসে নামলাম। সেখান থেকে ভাড়া করলাম নৌকা। এমন অবস্থা, নৌকা সামনের দিকে এগোয় না লাশের জন্য! পানিতে শুধু লাশ আর লাশ! এত দুর্গন্ধ!
অবশেষে বাড়ি এলাম। বাড়ি এসে শুনি, আমার সেজ দেবর রাজ্জাক যুদ্ধ করছে। ওরা গভীর রাতে বাড়িতে আসত চুপিচুপি, কেউ যেন না দেখে। যখন যা ঘরে থাকত, তা–ই খেতে দিতাম। ভোর হওয়ার আগেই ওরা চলে যেত ওদের স্থানে। অনেক রক্তের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হলো। আমরা পেলাম স্বাধীন বাংলাদেশ।