মারিয়া মান্দার লেখা: লড়ি মাঝমাঠে, লড়ি জীবনের মাঠেও
ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলা—পাহাড়ে ঘেরা, সবুজে মোড়া। এই ধোবাউড়ার বন্ধুর পথে ফুটেছে নারী ফুটবলের ফুল। এই নাম এখন উচ্চারিত হয় গর্বের সঙ্গে। আর মারিয়া মান্দা? উঠে এসেছেন সেই ধোবাউড়ার মন্দিরগোনা গ্রাম থেকে। বাংলাদেশের জার্সি গায়ে মাঝমাঠ সামলাচ্ছেন। এটাই তাঁর কাছে সবচেয়ে বড় পরিচয়, আত্মবিশ্বাস এবং এটাই তাঁর জীবন। মারিয়া লিখেছেন বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে এত দূর আসার কথা, তাঁর স্বপ্নের কথা।
ধোবাউড়ার মন্দিরগোনা গ্রামে জন্ম আমার। আমি গারো সম্প্রদায়ের মেয়ে। গারোরা এমনিতেই অনগ্রসর। তবে গারো হিসেবে আমার ফুটবল ক্যারিয়ারে বাধা আসেনি। কেউ বলেনি যে ফুটবল খেলো না। আমার সম্প্রদায় নিরুৎসাহিত করেনি কখনো। তবে মেয়ে হিসেবে আমরা যে গ্রামাঞ্চলে খেলাধুলা করেছি, তাতে সমস্যায় পড়তে হয়েছে।
বলা হতো, গ্রামের মেয়েরা কেন ফুটবল খেলবে! তা-ও আবার হাফপ্যান্ট পরে! এটাই ছিল সবচেয়ে বড় বাধা। রক্ষণশীল সমাজ থেকে নিষেধ করা হতো ফুটবল খেলতে। বাধাটা পেয়েছি আদতে এলাকার কিছু মানুষের কাছ থেকে।
অনেকে আমার মাকে বলতেন, ‘মেয়েকে খেলতে দিয়েছেন, এটা ভালো না।’ অভিভাবকেরা মেয়েদের নিষেধ করতেন ফুটবল খেলতে। বলা হতো, মেয়েরা ফুটবল খেলতে পারবে না।
বাধা পেরিয়ে
তারপরও কলসিন্দুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কোচ মফিজ উদ্দিন স্যার থেমে থাকেননি। সঙ্গে ছিলেন মিনতি রানী শীল ম্যাডাম। সপ্তাহে এক দিন-দুই দিন অভিভাবকদের সভা ডাকতেন; বোঝাতেন, কেন মেয়েদের খেলার সুযোগ দেওয়া উচিত। তাঁদের নেতৃত্বে আমরা ছোটবেলা থেকেই ফুটবল-পাগল হয়ে উঠেছিলাম, বাধা দিলেও অনেকে লুকিয়ে খেলত। তবে খেলার জগতে আসতে পরিবার থেকে বাধার মুখে পড়তে হয়নি বলে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি।
তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময়ই বাবা বীরেন্দ্র মারাক মারা যান। তাঁর কোনো স্মৃতি আমার মনে নেই। ঘরে তাঁর কোনো ছবি নেই, চেহারাটাও মনে করতে পারি না। তাই বাবার স্নেহ কাকে বলে, তা ঠিক জানি না। বাবার মৃত্যুর পর আমাদের চার ভাইবোনকে একাই বড় করেছেন মা—এনতা মান্দা।
গারোরা ধান কাটা, ধন বোনার কাজই বেশি করেন। আমার মা-ও সেটাই করতেন। আমাদের লালন–পালনের জন্য প্রতিদিন যে পরিশ্রম তিনি করেছেন, সেটা সত্যিই অসাধারণ। ধান কাটার কাজ মানে দৈনিক মজুরি, আমাদের নিজের জমি ছিল না, অন্যের জমিতে কাজ করতেন মা। দিনে পেতেন মাত্র ২০০ টাকা। এই টাকায় সংসার চলত না। ঋণ করতে হতো। ছোটবেলা থেকে মা ঘামে, চোখের জলে এগিয়ে নিয়েছেন আমাদের। তাঁর সেই পরিশ্রম আর ত্যাগের মধ্যেই আমার শৈশব কেটেছে।
তত দিনে আমার বড় বোনের বিয়ে হয়ে যায়। সে থাকত শ্বশুরবাড়ি। মেজ বোন পাপিয়া মান্দা মায়ের পাশে দাঁড়াতে অন্যের বাড়িতে কাজ করত। মেজ বোনের ত্যাগ আর সংগ্রামও আমার জন্য সব সময়ের অনুপ্রেরণা। মফিজ স্যার, মিনতি ম্যাডামের সমর্থনও কখনো ভুলব না।
সেই সময়ের কথা ভাবলে কষ্ট লাগে। এখন নিজের পছন্দমতো কিছু কিনে খেতে পারি। দেশ-বিদেশ ঘুরি। ভালো হোটেলে থাকি। কিন্তু ছোটবেলায় সেটা সম্ভব ছিল না। সেই জীবনটা ছিল একেবারেই আলাদা। আর্থিক সংকট আমাদের জীবনকে বেঁধে রেখেছিল আষ্টেপৃষ্ঠে। আমরা মাঝেমধ্যে ধোবাউড়ার বাইরে খেলতে যেতাম। অনেকে সঙ্গে দুই–তিন শ টাকাও নিত। আমি হয়তো নিতে পারতাম ৫০-৬০ টাকা।
স্যার জানাতেন বুট কিনতে হবে। মাকে বলতাম, টাকা দিতে হবে। তিনি তাঁর সামর্থ্যের শেষটা ঢেলে দিতেন আমার জন্য। দুই-তিন দিন টানা কাজ করে টাকা জমিয়ে আমার হাতে তুলে দিতেন। আর এতেই তৃপ্তি পেতেন। আমরা তখন খালি পায়ে খেলতাম। প্রথম বুটটা সম্ভবত ২০১৪ সালে পাই।
সাফল্য যখন ধরা দিল
পেছনের সেসব দিন আমাকে আপ্লুতও করে। কলসিন্দুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যেতে বাড়ি থেকে নেতাই নদী পার হতে হতো। বর্ষাকালে নদী পানিতে টইটম্বুর, নৌকা নিয়ে পারাপার করতে এক ঘণ্টা বা তারও বেশি সময় লাগত। অনেক সময় নৌকা থাকত কিন্তু মাঝি থাকতেন না। তেমন পরিস্থিতিতে সাতসকালে মা নিজেই নৌকা চালিয়ে আমাকে স্কুলে পৌঁছে দিতেন। শূন্য থেকে উঠে আসা এক মেয়ে আমি। কিন্তু আজ আমাকে সারা দেশ চেনে। সাফ জেতার জন্য একুশে পদক পেয়েছি। আর এসব সম্ভব হয়েছে মায়ের ঘাম আর চোখের জলের বিনিময়ে।
ফুটবল আমার জীবনে সে সময় এসেছে আশীর্বাদের মতো। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকেই আমার খেলাধুলা শুরু। নির্দিষ্ট করে বললে, ২০১১ সালের বঙ্গমাতা স্কুল ফুটবল দিয়ে। ২০১৩ সালে আমাদের কলসিন্দুর স্কুল চ্যাম্পিয়ন হয়। আমি সেই বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৪ দলের সদস্য, যারা ২০১৫ সালে নেপালে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ নারী আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়নশিপ (দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া) এবং ২০১৬ সালে তাজিকিস্তানে অনুষ্ঠিত এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ নারী আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়নশিপ (দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া) জয় করেছিল।
বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৫, ১৬, ১৯ দলের অধিনায়ক ছিলাম। আমাদের জেতা প্রথম সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে নেপালে ছিলাম সহ-অধিনায়ক। সাফ ও এএফসির বয়সভিত্তিক টুর্নামেন্টে নানা সাফল্যে ভূমিকা রাখতে পেরেছি। ২০১৬ থেকে জাতীয় দলে খেলছি। তারপর দুবার সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছি আমরা। এ বছর এশিয়ান কাপের চূড়ান্ত পর্বের ওঠা দলের সদস্য হতে পেরে আমি সত্যিই গর্বিত। জাতীয় দলের জার্সিতে ৪৫টির মতো ম্যাচ খেলা হয়ে গেছে আমার।
প্রথম সিনিয়র সাফ জয়ের পর আমার জন্য এলাকাবাসী তিনটি তোরণ সাজায়। যা ছিল আমার জন্য অবিশ্বাস্য। আমাকে বরণ করা হয় ফুল দিয়ে, শিশুরা দাঁড়িয়ে ছিল ফুল হাতে। সংবর্ধনার আসরে যখন বসেছিলাম, দেখেছি মায়ের চোখে অন্য এক আলো। সেই আলো ছিল গর্বের, লড়াইয়ের, আর সুদীর্ঘ অপেক্ষা শেষে পাওয়া রোদের মতো উজ্জ্বল। তখন মনে হয়েছিল, এই তো, আমি পেরেছি। মাঝমাঠে জিতেছি, জীবনের মাঠেও হার মানিনি।
চাই সমতা
এই সাফল্য আমার একার নয়, আমার মায়েরও। আমার গল্পের সঙ্গে জড়িয়ে আছে মায়ের মুখ। অদম্য মেয়েরা প্রামাণ্যচিত্রটিতে দেখবেন, মা আমাকে ভাত খাইয়ে দিচ্ছেন। সেই ভাতের থালার ক্লোজ শট আজও মনে করিয়ে দেয় ক্ষুধা শুধু খাবারের নয়, ক্ষুধা স্বপ্নেরও হয়। আর সেই স্বপ্নের ক্ষুধাই আমাকে ছুটিয়ে নেয় মাঠজুড়ে, আমাকে লড়াই করতে শেখায়।
২০১৫ সালে নেপালে আমরা বয়সভিত্তিক ফুটবল খেলতে গেছি। সেই দলে ছিল কলসিন্দুর স্কুলের ১০ মেয়ে। অবিশ্বাস্য এক ব্যাপার। সাফ জয়ের পর আমাদের নিয়ে ভিডিও হলো, খবর হলো। প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক আনিসুল হক আমাদের গ্রামে গেলেন একাধিকবার। তাঁকে অনুরোধ করলাম, গ্রামে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করে দিন। তাঁর উদ্যোগে বিদ্যুৎহীন গ্রামের বাড়িতে আলো জ্বলে উঠল। মানুষের ভালোবাসা, রাষ্ট্রের নজর, প্রথম আলো বৃত্তির মতো সহায়তা—সবকিছু মিলিয়েই আমার স্বপ্নটা বড় হলো, পথটা পোক্ত হলো।
সাফল্যের সঙ্গে পরিবারে আজ খানিকটা সচ্ছলতা এসেছে। ফুটবল খেলে কিছু টাকা জমিয়ে একটু জমি কিনেছি। মাকে আর দিনমজুরের কাজ করতে দিই না। যদিও তিনি মাঝেমধ্যে কাজ করতে চলে যান। ঘরে বসে থাকতে তাঁর নাকি ভালো লাগে না। গ্রামবাসী একসময় তাঁকে বলেছিলেন, ‘তোমার এই মেয়ে তোমার মুখ উজ্জ্বল করবে।’ বাড়ি গেলে গ্রামবাসী আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেন। বাড়িতে ছোট ভাইয়ের জন্য একটা ঘর তুলেছি। মেজ বোন এখন আর অন্যের বাড়িতে কাজ করে না, বাড়ির পাশে একটা মুদিদোকান দিয়ে নিজেই চালাচ্ছে।
ভুটানের লিগে থিম্পু সিটির জার্সিতে খেলে মাত্রই ঢাকায় এলাম। সেখানে অনেক কিছু শিখেছি। আমরা চাই, দেশেও যেন লিগটা নিয়মিত হয়। উন্নতি করতে হলে প্রচুর ম্যাচ খেলতে হবে। তাহলে ভালো ভালো খেলোয়াড় উঠে আসবে। দেশের জন্য কিছু করতে পারবে। নারীদের ক্রিকেটে বেতন, পুরস্কার সবকিছু ভালো। নারী ফুটবল দলও তা পেলে ভালো হবে। আমরা ভালো ফল করছি, তুলনায় আমরা অতটা টাকাপয়সা পাই না। সাফ জেতার পর দেড় কোটি টাকা পুরস্কার দেবে বলেছে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন। হ্যাঁ, তারা দেবে বলেছে, নিশ্চয়ই দেবে। কিন্তু আমরা এখনো পাইনি। চ্যাম্পিয়ন হয়ে পুরস্কার পেলে আমরা খুশি হই।
আমি লড়াকু মায়ের মেয়ে। মাঠে প্রতিপক্ষের সঙ্গে লড়ি, মাঠের বাইরে জীবনের সঙ্গে। বাংলাদেশের নারী ফুটবল আরও এগিয়ে যাক। আরও মেয়ে উঠে আসুক আমাদের পথ ধরে। আমার মা, আমার পরিবার, আমার গ্রামের মানুষের সাহসিকতায় আমি দাঁড়িয়ে আছি। আমার জীবন, আমার সংগ্রাম, আমার স্বপ্ন—সবই এখন বাংলাদেশের জার্সিতে এগিয়ে যাওয়ার। আমার গল্প হয়তো ছোট, কিন্তু তা প্রত্যেক মেয়ের স্বপ্নকে বড় করার এক উদাহরণ।