আমাদের ইচ্ছাকৃতভাবে বিভক্ত করা হচ্ছে, যেন বুঝতে না পারি আদতে সবাই হারছি

ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন উদ্যোক্তা রেশমা সাজানি। নারীদের কম্পিউটারবিজ্ঞানে উদ্বুদ্ধ করতে ‘গার্লস হু কোড’ নামে একটি অলাভজনক সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভি মাড কলেজের সমাবর্তনে বক্তৃতা দিয়েছেন তিনি। পড়ুন নির্বাচিত অংশের অনুবাদ।

সমাবর্তনের পোশাকে রেশমা সাজানি
ছবি: উইকিপিডিয়া

আজ তোমাদের সামনে অন‍্য একটা বক্তৃতা দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। ব্যর্থতাকে গ্রহণ করা, নতুন কিছু করার শক্তি, এআই দিয়ে ভবিষ্যৎ গড়ার গল্প, নানা কিছু ছিল আমার পরিকল্পনায়। কিন্তু অনুষ্ঠানের দিনটা যত ঘনিয়ে এল, মনে হলো তোমরা আরও সাহসী একটা বক্তৃতা পাওয়ার যোগ্য। তাহলে শুরু করি।

আজকের দিনে তোমাদের সামনে সবচেয়ে বড় সমস্যা শুধু জলবায়ু পরিবর্তন, স্বাস্থ্যসেবা বা এআই নৈতিকতা নয়। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো বিচ্ছিন্নতা। বিভিন্ন লিঙ্গ, শ্রেণি, জাতি—এমনকি বাস্তবতার সঙ্গেও একধরনের বিচ্ছিন্নতা তৈরি হচ্ছে। আর এই বিচ্ছিন্নতাই তোমাদের সব সমস্যা সমাধানের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে।

ব্যাখ্যা করি। আমি ‘গার্লস হু কোড’ শুরু করেছিলাম প্রযুক্তি খাতে মেয়েদের অংশগ্রহণ বাড়ানোর জন্য। কিছুদিনের জন্য আমরা সেটা করতে পেরেছিলামও। সাত লাখেরও বেশি নারী ও নন-বাইনারি (যারা নিজেদের শুধু নারী বা পুরুষ পরিচয়ে আবদ্ধ রাখতে রাজি নয়) শিক্ষার্থীকে আমরা কোডিং শিখিয়েছি, যাদের মধ্যে অনেকে আজ এখানে বসে আছ। আমরা এগোচ্ছিলাম, পৃথিবী উন্মুক্ত হচ্ছিল। কিন্তু এখন আবার সেটা বন্ধ হয়ে আসছে। যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে ডিইআই [ডাইভারসিটি (বৈচিত্র্য), ইকুইটি (সমতা), ইনক্লুশন (অন্তর্ভুক্তি)] ভেঙে পড়ছে, গবেষণা প্রস্তাবনা থেকে ‘বৈচিত্র্য’ শব্দটা মুছে ফেলা হচ্ছে। এমনকি আমাদের সবচেয়ে বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান নাসার যেসব প্রকল্প প্রকাশ‍্যে আসছে, সেখান থেকেও নারীদের বাদ দেওয়া হচ্ছে। ভুল করে নয়, ইচ্ছাকৃতভাবে এগুলো মুছে ফেলা।

আরও পড়ুন

আমাদের বোঝানো হয়েছে—অগ্রগতি মানে হলো ‘জিরো সাম গেম’ (একজনের অর্জন মানেই অন্যের ক্ষতি, এমন একটা ধারণা)। মেয়েরা এগোলে ছেলেরা পেছাবে, অ–শ্বেতাঙ্গ সুযোগ পেলে শ্বেতাঙ্গদের সুযোগ কমে যাবে। যেন নতুন কারো আগমন মানেই তোমার জায়গা কমে যাওয়া। আমাদের ইচ্ছাকৃতভাবে বিভক্ত করা হচ্ছে, যেন আমরা বুঝতে না পারি আদতে সবাই এই খেলায় হারছি। কিন্তু তোমরা হার্ভি মাডে এসেছ পুরোনো নিয়ম আঁকড়ে ধরে থাকতে নয়, বরং চ্যালেঞ্জ জানাতে; অমীমাংসিত সমস্যার সমাধান করতে।

২০০৬ সালে ফিরে যাই। তখন যদি এই বক্তৃতা দিতাম, আমার সামনে শ্রোতাদের ৭০ শতাংশ হতো পুরুষ, কম্পিউটারবিজ্ঞান বিভাগে তার চেয়েও বেশি—৮০ শতাংশ। তখন সারা বিশ্বে প্রচলিত ধারণা ছিল মেয়েরা কম্পিউটারে আগ্রহী নয়। সেই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট ছিলেন মারিয়া ক্ল্যাভে। তিনি এই ধারণা বদলানোর উদ্যোগ নেন। তিনি বুঝেছিলেন, প্রতিভার অর্ধেক অংশ যদি বিজ্ঞান-প্রযুক্তি থেকে বাদ যায়, সেটা হবে ভয়ানক বোকামি। তাই তিনি ও কম্পিউটারবিজ্ঞানের শিক্ষকেরা মিলে প্রাথমিক কোর্স নতুনভাবে সাজিয়েছিলেন, মেয়েদের জন্য নতুন গবেষণার সুযোগ তৈরি করেছিলেন। ফলাফল দেখো—আজ স্নাতকদের অর্ধেকই নারী ও নন-বাইনারি শিক্ষার্থী। এটা অলৌকিক কিছু নয়, এটা এক মডেল। অনেকে এমন ভাব করে—যেন মেধার ভিত্তিতে সব ঠিক হচ্ছে, অথচ বাস্তবে তা নয়। এই নাটক তখনই কাজ করে, যখন আমরা বিভক্ত থাকি। কারণ, পরস্পরকে যদি দোষারোপে ব্যস্ত থাকি, তাহলে খেলার নিয়মটা যে আগে থেকেই সাজানো, সেটা আমরা টেরই পাব না।

‘গার্লস হু কোড’ নামে একটি অলাভজনক সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি
ছবি: উইকিপিডিয়া

আমি নিজেও এই ফাঁদে পড়েছি। কয়েক বছর আগে মেয়েদের এক কলেজে সমাপনী বক্তৃতা দিলাম। ভীষণ গর্ব অনুভব করছিলাম। মঞ্চ থেকে নামার পর আমার বড় ছেলে শান বলল, ‘মা, তুমি সব সময় মেয়েদের কথা বলো, কিন্তু কখনো ছেলেদের কথা বলো না কেন?’ প্রথমে পাত্তা দিইনি। ভেবেছিলাম, ও ছোট, বুঝছে না। কিন্তু আসলে আমি-ই বুঝিনি। বছরের পর বছর বলে গেছি, ‘মেয়েরা, নিখুঁত নয়, সাহসী হও।’ কিন্তু ভাবিনি, ছেলেদেরও তো শেখানো দরকার—নির্বিকার নয়, নমনীয় হও। নিয়ন্ত্রণ করতে নয়, সংযোগ গড়ে তুলতে শেখো। পুরুষের পরিচয় নতুন করে গড়ো, যেখানে সংবেদনশীলতা, সমানুভূতি, যত্নবান হওয়াটা হবে শক্তি।

এভাবেই তো বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়। কারণ, বিচ্ছিন্নতা আমাদের শেখায়—শুধু তোমার লড়াইটাই আসল, বাকি সব মিছে। সাহসী হওয়ার বার্তা তো ছেলেদেরও প্রয়োজন। কারণ, তারাও ভুগছে। তাদের মধ্যে উদ্বেগ বেশি, একাকিত্ব বেশি। তারা কলেজে কম যাচ্ছে, আত্মহত্যা বা মাদকে হারিয়ে যাচ্ছে। অথচ যত্নের পরিবর্তে আমরা তাদের হাতে তুলে দিচ্ছি বিভাজন।

তাই প্রিয় শিক্ষার্থীরা, মনে রেখো তুমি কোথা থেকে এসেছ। অগ্রগতি কোনো হারজিতের খেলা নয়। প্রতিভা আসে সুযোগ বাড়ানোর মাধ্যমে, কমানোর মাধ্যমে নয়।

একবার আমি এক কলেজে ‘উইমেন ইন কম্পিউটিং’ গ্রুপে বক্তৃতা দিতে গিয়েছিলাম। সেখানে কিছু ছেলেকেও দেখলাম। জানতে চাইলাম তোমরা কারা। বলল, ‘আমরা মেয়েদের দলটার সমর্থক।’ প্রথমে মনে হয়েছিল মজা করছে। কিন্তু ওরা সত্যি সত্যি মেয়েদের পরামর্শ আর সহায়তা দিতে এসেছিল। এই ছেলেরা বুঝেছিল, ব্যাপারটা আসলে সহজ—নারীরা এগোলে, আমরা সবাই এগোই।

২০২৫ সালের গ্র্যাজুয়েটরা, তোমাদের বলা হয়েছে ক্ষমতা হলো এক টুকরা কেক, যেখানে তোমার ভাগ পেতে লড়াই করতে হবে। এটা মিথ্যা। তোমাদের লৈঙ্গিক লড়াইয়ে ব্যস্ত রাখা হচ্ছে, যেন সত‍্যিকার শ্রেণিভিত্তিক বৈষম্যের লড়াই তোমরা করতে না পারো।

আসল শক্তি আসে সংযোগ থেকে। যখন আমরা একে অপরের সাফল্যে অঙ্গীকারবদ্ধ হই, তখন কেবল টিকে থাকি না—উড়ি। একটা দুনিয়া গড়ে তোলো, যেখানে সবাই এগোয়। এমন দুনিয়া, যেখানে লিঙ্গ যুদ্ধক্ষেত্র নয়, বরং ভালো কিছু গড়ার শক্তি। যেখানে সমাধান মানুষকে ভাঙে না, বরং এক করে। তোমাদের কাছে দক্ষতা আছে, মূল্যবোধ আছে, সাহস আছে। এখন সময় এসেছে। চলো এগিয়ে যাই।

আরও পড়ুন