গামছা কীভাবে বাঙালি সংস্কৃতির অনুষঙ্গ হয়ে উঠল

বাঙালি সমাজকাঠামো, উৎপাদনপ্রণালি ও সংস্কৃতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে গামছা। মামুলি বস্ত্র হলেও আমাদের জীবনাচার ও হৃদয়ের সঙ্গে এর বন্ধন নিবিড়, যা গড়ে উঠেছে সুদীর্ঘকালব্যাপী। বাঙালির ব্যবসা-বাণিজ্য, জীবনাচার, সামাজিকতা, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, শিল্পসাহিত্য, চিকিৎসা, উৎসব ইত্যাদি ক্ষেত্রে এর বহুল ব্যবহার চোখে পড়ে। যুগের হাওয়ায় ভিন্ন মাত্রা ও আকৃতি পেলেও বাঙালির কাছে গামছার চাহিদা এখনো কমেনি। এই গামছা কীভাবে বাঙালি সংস্কৃতির অনুষঙ্গ হয়ে উঠল?

গামছার ব্যবহার দেখা যায় মূলত বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও ওডিশা রাজ্যে। বেশির ভাগ গামছাই সেলাইবিহীন। তবে সেলাই করা গামছা দেখা যায় ভারতের ওডিশায়। বাংলাদেশে, বিশেষ করে গ্রামীণ জীবনে গামছা জনপ্রিয় এবং প্রয়োজনীয় উপকরণ। এটি পাতলা বলেই আমাদের আবহাওয়ার সঙ্গে মানানসই। আর এ কারণেই গ্রামীণ ঐতিহ্যের সঙ্গে যুগ যুগ ধরে মিশে আছে গামছা। গানবাজনা থেকে শুরু করে গোসল শেষে গা মুছতে, নারীদের চুল ঝাড়তে অনেক কিছুতেই গামছার বিপুল ব্যবহার। ইদানীং বিভিন্ন নামীদামি ব্র্যান্ডও গামছার কাপড়ের শার্ট, পাঞ্জাবি, রুমাল, কামিজ, ওড়না, ফতুয়া, শাড়ি ইত্যাদি উৎপাদন ও বিপণন করছে।

বাঙালি সমাজকাঠামো, উৎপাদনপ্রণালি ও সংস্কৃতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে গামছা
সুমন ইউসুফ

গামছার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

গামছার ইতিহাস বেশ পুরোনো। আজ থেকে প্রায় সোয়া পাঁচ শ বছর আগে ‘মনসামঙ্গল’ কাব্যে বেহুলার বিয়ের অনুষ্ঠানে গামছার উল্লেখ পাওয়া যায়। কবি নারায়ণ দেব লিখেছেন, ‘...গামছা লইয়া ঔসদ লাগে মুছিবার।’ ফলে গামছা যে বাঙালির দীর্ঘকালের অনুষঙ্গ, সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গামছার চল থাকলেও এর ব্যাপক প্রচলন আসামে। সেখানে গামছাকে বলে ‘গামোচা’। এই গামছার চারদিকে রঙিন সুতার বাহার থাকে। আর মাঝখানটা হয় সাদা। আসামের প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ড. লীলা গগৈ লিখেছেন, অহোম রাজার আমল (একাদশ শতাব্দী) থেকেই আসামে গামোচার প্রচলন। ‘আ হিস্ট্রি অব আসাম’ গ্রন্থে ব্রিটিশ লেখক ও গবেষক এডওয়ার্ড গেইটর বলেছেন, ‘১৭৩৯ সালে একটি গামোচার দাম ছিল ছয় পয়সা। তখন বিভিন্ন উৎসব, যেমন বিহু উৎসবে যুবকেরা মাথায় গামোচা বেঁধে বিহু নৃত্যে অংশ নিত।’

খুব ভোরে কৃষক যখন মাঠে যেতেন, তখন কাঁধে লাঙলের সঙ্গে থাকত একটি গামছা
ছবি: সোয়েল রানা

গামছার মূল ব্যবহার গা বা দেহ মুছতে। ‘ঢাকাই মসলিন’ গ্রন্থে লেখক আবদুল করিম বলেন, গা মোছা থেকেই গামছা শব্দের উৎপত্তি। প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে কাছলা, তঙ্গালী, খাড়, সেঁওয়ালি, উড়ান, সামষলী ও সাঙালি নামের গামছার উল্লেখ পাওয়া যায়। বাংলায় অতি প্রাচীনকাল থেকে দুটি জিনিস একসঙ্গে ব্যবহৃত হতো—লুঙ্গি ও গামছা। এর মধ্যে বিশেষ করে গামছা নারী ও পুরুষ উভয়েই ব্যবহার করতেন।

‘হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি’ বইয়ের লেখক গোলাম মুরশিদ লিখেছেন, ‘ঊনিশ শতক শেষ হওয়ার আগেই ইংরেজি শিক্ষিতদের মধ্যে পশ্চিমা পোশাক অথবা সে পোশাকের কিছু উপকরণ অনুপ্রবেশ করেছিল। তবে বৃহত্তর বাঙালি সমাজে বহাল থাকে সনাতনী পোশাক।’

বাজারে উঠেছে তাঁতিদের বোনা গামছা
ছবি: সোয়েল রানা

এখানে ‘সনাতনী পোশাক’ বলতে গোলাম মুরশিদ ধুতি ও গামছাকেই বুঝিয়েছেন বলে ধারণা করা যায়। কৃষিভিত্তিক সমাজে বিশেষ মৌসুমে (যেমন আম-কাঁঠালের মৌসুম, পিঠাপুলির সময়) জামাইদের দাওয়াত দেওয়ার প্রচলন ছিল। তাঁরা শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে এলে সাধারণত মেয়েদের শাড়ি এবং জামাইদের উপহার হিসেবে দেওয়া হতো লুঙ্গি ও গামছা। সে সময় বাংলার লোকজীবনে পোশাক-পরিচ্ছদ ছিল ধুতি, লুঙ্গি, গামছা, চাদর, ফতুয়া ইত্যাদি। বলা হয়, বিশ শতকের শুরুতে আমজনতা অজ্ঞ-অনক্ষর, নিঃস্ব, নিরন্ন, দুস্থ–দরিদ্র ছিল। ফলে কায়িক শ্রমের সময় গামছা পরেই তারা জলে-স্থলে কাজ করত।

গামছার জন্য খ্যাত যেসব এলাকা

গামছা বুনছেন খুলনার ফুলতলার কারিকরপাড়ার এক তাঁতি
ছবি: সাদ্দাম হোসেন

গ্রামবাংলার দৃশ্যের সঙ্গে গামছা যেন অবিচ্ছেদ্য এক অংশ। শুধু গ্রামেই নয়, শহরে এখনো গামছার বহুল ব্যবহার আছে। নরম সুতায় হাতে বোনা গামছার কদর বাঙালির কাছে কখনোই ফুরানোর নয়। শুধু গ্রামবাংলার তাঁতিরাই নন; মণিপুরি, সাঁওতাল, চাকমা, মারমা, গারো ইত্যাদি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষেরাও মনের মাধুরী মিশিয়ে তৈরি করেন গামছা। এসবের ভাঁজে ভাঁজে জড়িয়ে থাকে একেকটি জনপদের সহস্র বছরের সঞ্চিত আবেগ, দক্ষতা, স্মৃতি ও ঐতিহ্য। এসব কেবল সুতার পর সুতা দিয়ে গাঁথা কোনো আটপৌরে কাপড় নয়; বরং পরম মমতা ও ভালোবাসার একেকটি স্মারক।

খুলনার ফুলতলার দামোদর মহল্লায় মহল্লায় গামছা বিক্রি করতে বেরিয়েছেন এক বিক্রেতা, এসব গামছা বিক্রি করেন তিনি ২০০–৩৫০ টাকায়
ছবি: সাদ্দাম হোসেন

সাধারণত গামছা বোনা হয় তাঁতে। অধুনা মেশিনে তৈরি হলেও হাতে বোনা তাঁতের গামছাই বেশি জনপ্রিয়। সিরাজগঞ্জের বেলকুচি, এনায়েতপুর, উল্লাপাড়া, কুষ্টিয়ার কুমারখালী, বগুড়ার কিছু এলাকা, খুলনার ফুলতলা, বরিশাল ও ঝালকাঠির বিভিন্ন এলাকায় তাঁতে তৈরি হয় সুতি গামছা।

গামছার দোকান
ছবি: সোয়েল রানা

সিরাজগঞ্জের পাঁচলিয়া, কুষ্টিয়ার কুমারখালী ও খুলনার ফুলতলা গামছার হাট হিসেবে বিখ্যাত। ইদানীং কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে গামছা আকৃতির একধরনের মোটা তোয়ালের ব্যাপক চাহিদা তৈরি হয়েছে দেশব্যাপী।

বাঙালির জীবনে গামছার ব্যবহার

মানুষের আত্মপরিচয়ের বিধৃত রূপই হচ্ছে সংস্কৃতি। এই পরিচয়ের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত তার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও জীবনযাত্রা। সহজ ভাষায় সংস্কৃতি হলো মানুষের জীবনপ্রণালি। বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে নানা উপাদান। এসব উপাদানের মধ্যে গামছা অন্যতম। গামছাকে বলা হয় ‘সকল কাজের কাজি’।

লাল পেড়ে সাদা শাড়ি, মাথায় গামছা, হাতে বইঠা নিয়ে নৌকা বাইচের জন্য প্রস্তুত নারী
ছবি: প্রথম আলো

গানবাজনা থেকে শুরু করে গোসল শেষে গা মুছতে, চুল ঝাড়তে, কত কিছুতেই না গামছার ব্যবহার। মোটকথা, গামছা ছাড়া বাঙালির জীবন অচল বললে বাড়াবাড়ি হবে না। নিচে বাঙালি জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে গামছার উপযোগিতা তুলে ধরা হলো।

ট্রাকে করে হাটে আনার সময় গামছা দিয়ে চোখ বেঁধে দেওয়া হয়েছে গরুর
ছবি: প্রথম আলো

কৃষিকাজে গামছা: বাঙালি সংস্কৃতি মূলত কৃষিভিত্তিক। খুব ভোরে কৃষক যখন মাঠে যেতেন, তখন কাঁধে লাঙলের সঙ্গে থাকত একটি গামছা। এর একদিকের খুঁটে বাঁধা থাকত চিড়া, গুড়, মুড়ি। আবার কৃষকের সন্তান বাবার জন্য বাড়ি থেকে পান্তাভাত বহন করত গামছায় বাঁধা মাটির সানকিতে। কৃষক হাত–মুখে পানি দিয়ে, গামছায় মুখ মুছে সেই গামছা বিছিয়েই খেতে বসতেন। খাওয়া শেষে কোনো গাছের ছায়ায় জিরিয়ে নিতেন গামছা বিছিয়েই।

গাছের ছায়ায় গামছা বিছিয়ে একটু ঘুম
ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

এ ছাড়া ধান কাটা, পাট কাটা, মাটি কাটা ইত্যাদি কাজের সময় কৃষকের কোমরে গামছার ব্যবহার আজও চোখে পড়ে। এই কৃষক-শ্রমিকদের অনেককে দেখা যায় মাথায় গামছা বেঁধে ভারী জিনিসপত্র বহন করতে। আবার কাজ শেষে বিশ্রামের সময় গামছা ঘুরিয়ে বাতাস করে গা জুড়িয়েও নিতে দেখা যায়।

প্রচণ্ড গরমে গামছাই ভরসা
ছবি: হাসান মাহমুদ

জীবন নির্বাহে গামছা: গামছা কিছু মানুষের জীবন ধারণের সঙ্গে যুক্ত। দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় তাঁতশিল্প আছে এবং এই শিল্পে বহু শ্রমিক গামছা বুননের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন।

মহল্লায়-বাজারে ঘুরে ঘুরে গামছা বিক্রি করেন এই বিক্রেতা
ছবি: সাদ্দাম হোসেন

মাছ শিকারে গামছা: গ্রামীণ জনগোষ্ঠী কোমরে গামছা বেঁধে পলো নিয়ে পুকুর, খাল ও নদীতে মাছ শিকারে নামে। আবার নদীর পাড়ের ছেলেমেয়েরা গামছা দিয়ে পোনা মাছ ধরে।

১ / ৩
বৃষ্টিতে জমা পানিতে গামছা দিয়ে মাছ ধরায় ব্যস্ত শিশুরাছবি: আলীমুজ্জামান

বর্ষা শেষে খাল–বিলের পানি শুকিয়ে গেলে ছেলেমেয়েরা হাঁটুজলে গামছা পেতে মাছ ধরে। মাছ ধরা শেষ হলে গামছায় মাছ বেঁধে বাড়ি ফেরে।

মাথায় গামছা পরেছেন জেলেরা
ছবি: প্রথম আলো

খাবার তৈরিতে গামছা: বাঙালি সমাজে কোনো বড় ধরনের উৎসব-আয়োজনে বাবুর্চিরা গামছা ছাড়া রান্না করতে পারেন না। বিশেষ করে পোলাও বা বিরিয়ানি রান্না করতে গামছার প্রয়োজন পড়ে। এ ছাড়া মিষ্টি তৈরির প্রাক্কালে ছানার মধ্যে যে তরল অংশ থাকে, তা ছাড়ানোর জন্য ছানা গামছায় বেঁধে পানি ঝরাতে হয়। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে আম কুড়ানোর সময় সঙ্গে ছুরি বা চাকু না থাকলেও সমস্যা নেই। আম গামছায় মুড়ে গাছে আঘাত করলে তা ফেটে আঁটি বেরিয়ে আসে। আবার পাকা তালের রসের তেতো অংশ আলাদা করতে গামছায় বেঁধে রস ঝরানো হয়।

১ / ১৪
ঘাটে অপেক্ষায় থাকা এক তরুণ রোদ সহ্য করতে না পেরে গামছা মুড়িয়ে বসে আছেনছবি: মঈনুল ইসলাম
আরও পড়ুন

পোশাক হিসেবে গামছা: পোশাকে গামছা শুধু কাপড় হিসেবেই নয়; বরং বাংলার আবহমান ঐতিহ্য হিসেবেই উঠে এসেছে। সমাজের দরিদ্র ও শ্রমিক শ্রেণির মানুষ গামছাকে পরিধেয় বস্ত্র হিসেবেও ব্যবহার করেন। এ ছাড়া আচ্ছাদন হিসেবেও এর ব্যবহার আছে। বর্তমানে গামছার কাপড়কে আরেকটু নরম করে রং ও নকশা বজায় রেখে তৈরি হচ্ছে শাড়ি, ওড়না, পাঞ্জাবি, শার্ট, ফতুয়া, ব্লাউজ, টপস, স্কার্ট ও টুপি।

গামছা ব্লাউজ
ছবি: প্রথম আলো

আর শীতকালে কনকনে বাতাস থেকে রক্ষা পেতে গামছা দিয়ে মাথা-কান ঢেকে রাখেন অনেকেই। ‘মারো টান হেঁইয়ো...আরও জোরে হেঁইয়ো...’—ভারী জিনিস তুলতে বা টানতে শ্রমিকদের কোমরে বাঁধা থাকে গামছা। মাঝি দাঁড় বায়, গুন টানে কোমরে গামছা বেঁধে। শরীরের শক্তি পুরোপুরি কাজে লাগানোর জন্যই কোমরে এই গামছা বাঁধা।

ফ্যাশন শোয়ে গামছা
ছবি: প্রথম আলো

ভাষা ও সাহিত্যে গামছা: বাঙালির প্রবাদ-প্রবচন, ভাষা ও সাহিত্যেও গামছার ব্যবহার কম নয়। যেমন ‘গলায় গামছা দেওয়া’। এর অর্থ কাউকে লাঞ্ছিত করা, অপমান ও জবরদস্তি করে কোনো কিছুতে বাধ্য করা। ‘গামছা ডলা’র অর্থ গামছা দিয়ে মর্দন বা গোসলের সময় গামছা দিয়ে গা পরিষ্কার করা। ‘গামছা বাঁধা’র অর্থ গামছায় বাঁধা বা গামছা দিয়ে বাঁধা। ব্যাকরণের ভাষায় এই শব্দমালা বাগ্‌ধারা হিসেবে পরিচিত। গামছা নিয়ে বাগ্‌ধারা এসেছে অনেক কবিতায়ও। পল্লিকবি জসীমউদ্‌দীনের কবিতায় আছে ‘গামছা-বাঁধা দই’-এর কথা—

‘আমার বাড়ি যাইও ভ্রমর

বসতে দিব পিঁড়ে...

...বাড়ির গাছের কবরি কলা

গামছা-বাঁধা দই।’

ছাতার বদলে গামছা
ছবি: দীপু মালাকার

গ্রামবাংলার লোকসংগীতেও আমরা গামছার অস্তিত্ব খুঁজে পাই। অর্থাৎ বাঙালির কাছে গামছা শুধু প্রয়োজন মেটানোর উপকরণই নয়; বরং তা বাঙালির ঐতিহ্য, সংস্কৃতি বা এককথায় বাংলার শাশ্বত রূপের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। গায়ক আব্বাসউদ্দীন গেয়েছেন—

‘যদি বন্ধু যাবার চাও

ঘাড়ের গামছা থুইয়া যাও রে...।’

অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়—

‘তীরে তীরে ছেলেমেয়ে নাহিবার কালে

গামছায় জল ভরি গায়ে তারা ঢালে।

সকালে বিকালে কভু নাওয়া হলে পরে

আঁচলে ছাঁকিয়া তারা ছোট মাছ ধরে।’

আরও পড়ুন
‘গাঁয়ের ছেলে’ চলচ্চিত্রে নায়করাজ রাজ্জাকের কাঁধে গামছা
ছবি: ভিডিও থেকে

নাটক-চলচ্চিত্রে গামছা: বাংলাদেশ ও ভারতের অনেক চলচ্চিত্রে অভিনেতাদের গলায় বা কাঁধে গামছা চোখে পড়ে। ‘গাঁয়ের ছেলে’ চলচ্চিত্রে দেখা যায় নায়করাজ রাজ্জাকের কাঁধে গামছা।

ভারতীয় পরিচালক অনুরাগ কশ্যপ তো তাঁর ‘গ্যাংস অব ওয়াসিপুর’-এর পাত্র-পাত্রীদের গলায় গামছা জড়িয়ে কান চলচ্চিত্র উৎসবে নিয়ে গিয়েছিলেন। ‘তাশান’ ছবিতে অক্ষয় কুমার গামছা বেঁধেছেন মাথায়। তবে বলিউড অভিনেতা গোবিন্দ এ ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকবেন। গলায়, মাথায়, হাতে, কোমরে—কোথায় গামছা বাঁধেননি তিনি!

প্রচণ্ড রোদের মধ্যে মাথায় গামছা দিয়ে সড়কের পাশে ভ্যানে সবজি সাজিয়ে বিক্রি করছেন বিক্রেতা
ছবি: আনিস মাহমুদ

দৈনন্দিন ব্যবহারে গামছা: বাঙালি জীবনের নানা প্রয়োজনে গামছার ব্যবহার চোখে পড়ে। বাঙালি নারীরা গোসল শেষে গামছা দিয়ে চুল ঝেড়ে খোপায় গামছা পেঁচিয়ে হেয়ার ড্রায়ারের কাজ সারেন। বর্তমানে গামছা দিয়ে বানানো হচ্ছে জুতা, ঝুড়ি, ঝোলা ব্যাগ, ল্যাপটপের ব্যাগ, পানির বোতল রাখার ব্যাগ, মুঠোফোনের ব্যাগ, হাতের বালা, কানের দুল ইত্যাদি। কয়েকটা বড় বড় গামছা দিয়ে তৈরি করা হয় জানালার পর্দা। ভিন্ন ধাঁচে তৈরি হয় বিছানার চাদর, বালিশের কভার।

আরও পড়ুন

ঘর সাজাতেও ব্যবহৃত হচ্ছে গামছা। বিছানার চাদর, বালিশ, সোফার কুশন কভার, ম্যাট, এমনকি খাবার টেবিলের রানার হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে গামছা। ঘরের কোণে রাখা টেবিল ল্যাম্পের শেড হিসেবেও গামছার ব্যবহার দেখা যায়। গামছার রং উজ্জ্বল বলেই এসব উপকরণে অন্দর বর্ণিল হয়ে ওঠে।

গামছা কাপড় ও আর্টিফিশিয়াল লেদারে তৈরি ব্যাগ
ছবি: প্রথম আলো

ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে গামছা: আবহমানকাল থেকেই গামছা বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসব ও সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে আছে। ইসলাম ধর্মের অন্যতম স্তম্ভ নামাজ পড়তে গেলে অজু করার পর হাত–মুখ মুছতে গামছার প্রয়োজন পড়ে। অনেকে জায়নামাজের বিকল্প হিসেবে গামছা ব্যবহার করেন। গ্রামাঞ্চলে মসজিদে, বিশেষ করে শুক্রবার, তবারক বিতরণ করা হয় গামছায় রেখে।

সনাতন ধর্মের বিবাহরীতি, পূজা-পার্বণ, অপনয়ন (পৈতা নেওয়া), দীক্ষা গ্রহণ, চন্দ্রায়ন, শ্রাদ্ধানুষ্ঠান ইত্যাদি কর্মকাণ্ডে পুরোহিতকে দক্ষিণা হিসেবে শাড়ি, ধুতি, নগদ অর্থ ও অন্য সামগ্রীর পাশাপাশি গামছা দেওয়া হয়।

চিকিৎসাসেবায় গামছা: কোথাও কেটে গেছে, হাতের কাছে ব্যান্ডেজ না থাকলে গামছা তাৎক্ষণিক সমাধান। গ্রামাঞ্চলে এখনো সাপে কাটা রোগীর হাত বা পা গামছা দিয়ে শক্ত করে বাঁধা হয়। আবার সাপে কাটলে রোগীর বিষ নামানোর সময় সাপুড়ে বা ওঝারা মাথায় ও কোমরে গামছা বেঁধে বিন বাজান।

১ / ৬
সোফান কুশনে গামছাছবি: প্রথম আলো

ফ্যাশনে গামছা: দেশীয় ঐতিহ্য ও সমকালীন ট্রেন্ডেও গামছার উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। শিশুদের বউ সাজার শখ হলে গামছা পরেই বউ সেজে তাদের ইচ্ছা পূরণ করা হয়। শুধু পোশাকেই নয়, ফ্যাশনের অনেক স্তরেই আছে গামছার বহুল ব্যবহার। ফ্যাশন হাউসগুলোতে মেলে গামছা কাপড় দিয়ে তৈরি টিস্যু বক্স, ল্যাম্পশেড, টেবিল রানার, জুয়েলারি বক্স, কুশন কভার, শতরঞ্জি, পেইন্টিং ফ্রেম, নোটবুক ইত্যাদি।

পটের বিবির গামছা ব্যাগ
ছবি: প্রথম আলো

ফ্যাশনেবল ব্যাগ তৈরিতে ব্যবহৃত হচ্ছে গামছা। রাবারের সোল, চামড়া ও গামছা দিয়ে তৈরি হচ্ছে ছেলেমেয়েদের স্যান্ডেল। এ ছাড়া আছে রুমাল, মাথার ব্যান্ড ও ফিতা। আড়ং, বিবিয়ানা, যাত্রা, সোর্স, দেশী দশ, স্বদেশিসহ অনেক দেশীয় ফ্যাশন হাউস কাজ করছে গামছা নিয়ে।

১ / ৩
দেশে গামছা ফ্যাশনের সূচনায় বিবি রাসেলের ভূমিকা অনন্যছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

আবার বঙ্গবীরখ্যাত কাদের সিদ্দিকী গামছাকে প্রতীক হিসেবে বেছে নিয়েছেন। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক ফ্যাশন আইকন বিবি রাসেলের ফ্যাশনে ও শহুরে বাঙালিয়ানার উৎসব অনুষ্ঠানে গামছার বহুল ব্যবহার দেখা যায়। দেশে গামছা ফ্যাশনের সূচনায় বিবি রাসেলের ভূমিকা অনন্য। ইদানীং জনপ্রিয় গায়ক জেমসও নিয়মিত গামছা বাঁধছেন মাথায়।

ইদানীং জনপ্রিয় গায়ক জেমসও নিয়মিত গামছা বাঁধছেন মাথায়
ছবি: খালেদ সরকার

উৎসব-আয়োজনে গামছা: বাঙালির বিভিন্ন উৎসব ও আয়োজনে গামছার ব্যাপক ব্যবহার চোখে পড়ে। যেমন পয়লা বৈশাখে তরুণ-তরুণীরা হাতে, মাথায় গামছা বাঁধেন। অনেকে গামছা মাথায় পরে নৃত্য পরিবেশন করেন। সংগীতশিল্পীরাও গামছা মাথায় বাঁধেন বা গলায় ঝোলান।

সংগীতশিল্পী সাহেদকে গামছা ছাড়া দেখা যায় না বললেই চলে। বিভিন্ন রকমের গামছা আছে তাঁর সংগ্রহে

সংগীতশিল্পী সাহেদের নামই হয়ে গেছে ‘গামছা সাহেদ’
ছবি: প্রথম আলো

একজন শিল্পীর নামই তো ‘গামছা পলাশ’। গামছা জিনস, টি-শার্টের সঙ্গে, ধুতি, সালোয়ার ও টপের সঙ্গে মাথায় বেঁধে বা গলায় ঝুলিয়ে রেখেও পরতে দেখা যায় বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠানে।

গুলশানের আলোকি কনভেনশন সেন্টারে ‘রিশকা ফেস্টিভ্যাল’–এর প্রবেশমুখ সাজানো হয়েছিল গামছা দিয়ে
ছবি: নাদিয়া ইসলাম

খেলাধুলায় গামছা: গ্রামের ছেলেমেয়েদের খেলার সময় কানামাছি খেলতে গিয়ে চোখ বাঁধার জন্য গামছা ব্যবহার করে। রুমালচোর খেলতে গেলে রুমাল বা গামছার দরকার পড়ে। হাতের কাছে গামছাটাই সহজে পাওয়া যায় বলে সে প্রয়োজনও মেটে গামছা দিয়ে। আবার হাড়িভাঙা খেলায় গামছা দিয়ে চোখ বাঁধা হয়।

গামছার আদি ও অকৃত্রিম ব্যবহারের জায়গা এখনো আছে, তবে তৈরি হয়েছে এর নতুন উপযোগিতা। উৎপাদনপ্রক্রিয়া আঞ্চলিক ও লোকজ হলেও ব্যবহারিক ও শৈল্পিক মানের বিচারে গামছা অতুলনীয়।

ড. খ ম রেজাউল করিম, সমাজ গবেষক ও শিক্ষক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজ, যশোর

আরও পড়ুন