আল্লাহ মালিক কাজেমী: এক অদেখা নক্ষত্রের নাম

আল্লাহ মালিক কাজেমী
আল্লাহ মালিক কাজেমী

গ্র্যাভিটেশনাল পুলসংক্রান্ত থিওরিটা শুধু পদার্থবিজ্ঞান না, মানবচরিত্রের ক্ষেত্রেও কার্যকর। এটার প্রথম প্রমাণ আমি পাই সদ্য প্রয়াত বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ও পরে চেঞ্জ ম্যানেজমেন্ট অ্যাডভাইজার আল্লাহ মালিক কাজেমী স্যারের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের মাধ্যমেই।

সুবিশাল বা প্রচণ্ড ভরসম্পন্ন কোনো নক্ষত্র তার চারপাশের স্পেস-টাইমে প্রবল মহাকর্ষীয় বলয় তৈরি করে। ধারেকাছের ক্ষুদ্র গ্রহ বা বস্তুকণা তখন সেই প্রবল বলের কাছে পরাজিত হয়। পরাজিত হয় তাদের প্রচলিত গতিপথ।

২০০৯ সালে, আমি তখন পলিসি অ্যানালাইসিস ইউনিটে (বর্তমান চিফ ইকোনমিস্ট ইউনিট)। কয়েক মাস হলো চাকরিতে জয়েন করেছি। একদিন জিএম স্যার একটা রিপোর্টের একটা চ্যাপ্টার আমার হাতে তুলে দিয়ে চোরা হাসি হেসে বললেন, ‘এই চ্যাপ্টারে তো তুমিও কন্ট্রিবিউটর। যাও কাজেমী স্যারের কাছে ড্রাফটা নিয়ে যাও। তবে সাবধান!’ আমি অবাক হই। স্যারকে ড্রাফট দেখাব, তাতে ভয়ের কী আছে? জিএম স্যারকে জিজ্ঞাসা করি, ‘স্যার, সাবধান হতে বললেন কেন? তাহলে আরেকবার চেক করে যাই’? জিএম স্যার হাসি দিয়ে বললেন, ‘লাভ নেই। কাজেমী স্যারের কাছে ১৪ বার চেক করে কিছু দিয়েও লাভ নেই। যেখানে সমস্যা আছে, একবার মাত্র চোখ বুলিয়েই খট করে তা ধরে ফেলবেন। একটা জিনিস মনে রেখো—উনি যে মন্তব্য করবেন সেটার গ্রহণযোগ্যতা অনেকটা পাবলিশড জার্নালের মতো’। এবার সত্যি সত্যিই ভয় পাওয়া শুরু করে আমার।

সেক্রেটারির মাধ্যমে ড্রাফট ভেতরে পাঠিয়ে আমি অপেক্ষা করি। একটু পরে আমাকে ভেতরে ডেকে পাঠান। সালাম দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। হাত ইশারায় বসতে বলেন। বসার সময় একঝলক তাকান আমার দিকে। আবার চোখ রিপোর্টে। জিএম স্যারের কথাটা মনে বাজে, ‘চৌদ্দবার চেক করে কিছু দিয়েও লাভ নেই। যেখানে সমস্যা আছে, একবার মাত্র চোখ বুলিয়েই খট করে তা ধরে ফেলবেন’। হঠাৎ খেয়াল করি নিজের বুকের ঢিপ ঢিপ শব্দ কানে শুনতে পাচ্ছি। স্যার পড়েন, আর ক্ষণিক যেন কী চিন্তা করেন। আবার পরেন, আবার ভাবেন। হঠাৎ প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি নতুন?’ আমি নার্ভাস কণ্ঠে জবাব দিই, ‘জি, জি স্যার।’ স্যার ‘চা খাও’ বলেই ফোনে চা দিতে বললেন।

একটু পর লাল চা আসে। স্যার রিপোর্টের একটা অংশ নিয়ে কিছু মন্তব্য করেন। আমি নোট নিই। একপর্যায়ে বলেন, ‘কী হলো, চা খাচ্ছ না কেন?’ আমার খেয়াল হয় আমি চায়ের কাপে হাতই দিইনি এখনো। হঠাৎ কী জবাব দেব বুঝে পাই না। অন্য পরিস্থিতিতে হয়তো সরি বলে চুমুক দিতাম। কিন্তু কাজেমী স্যারের ব্যক্তিত্বের প্রবল গ্র্যাভিটেশনাল পুলে আমার ব্যক্তিত্ব তখন দুমড়েমুচড়ে একাকার। স্যার যেন ব্ল্যাক হোল, আর আমি মহাকাশে ভেসে বেড়ানো এক টুকরা নুড়ি। বলে ফেলি, ‘ইয়ে, স্যার, আমি লাল চা খাই না।’ বলেই মনে হলো, হায় খোদা; এটা আমি কী বললাম! স্যার আমার দিকে তাকালেন। বললেন, ‘লাল চা খাওনা, সেটা তখনই বলতা। ওরা অন্য ব্যবস্থা করে দিত।’ আবারও এর জবাবে কী বলা উচিত ভেবে পাই না। সত্যি বলতে কি, আমার মনোজগৎ তখন তোলপাড় অবস্থায়। অত্যন্ত অপ্রস্তুতের মতো বলে ফেলি, ‘না না, স্যার। লাল চা মাঝে মাঝে খাই।’ বলেই কাপ হাতে নিয়ে লম্বা চুমুক দিই এবং খোয়াল করি চা তখনো যথেষ্ট গরম।

স্যারের সঙ্গে দ্বিতীয় অভিজ্ঞতা এর অর্ধযুগ পরে। তখন অন্য এক বিভাগে কাজ করি। দাতা সংস্থার সহায়তাপুষ্ট একটা প্রোজেক্ট তখন দাঁড় করাচ্ছি আমরা। একটা ইস্যুতে আমরা দাতার সঙ্গে ঠিক একমত হতে পারছিলাম না। ইস্যুটা বৈদেশিক মুদ্রায় লেনদেন–সংক্রান্ত ছিল। সংশ্লিষ্ট বিভাগ (বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগ) শুরু থেকেই আমাদের সর্বাত্মক সহায়তার পরও ইস্যুটার কোনো সরল সমাধান হচ্ছিল না। একপর্যায়ে মনে হচ্ছিল এই একটা বিষয়ই বিশাল এই প্রোজেক্টটাকে আটকে দিতে পারে। তখনকার ডেপুটি গভর্নর স্যারের পরামর্শে দাতা সংস্থার উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে একটা মিটিং আয়োজন করা হয়—আমাদের দিক থেকে অনেকটা ইস্যু সমাধান করার শেষ চেষ্টা হিসেবে। কাজেমী স্যার তখন চেঞ্জ ম্যানেজমেন্ট অ্যাডভাইজার। তিনি সেই মিটিংয়ে থাকার বিষয়ে সম্মতি দিয়েছেন। এটা শোনার পর সবাই যেন আশার আলো দেখতে পায়। সভার আগের দিন বিকেলে স্যারের কাছে দুই পৃষ্ঠার একটা সামারি জমা দেওয়া হয়। পরদিন কাজেমী স্যারের রুমেই সভা হয়। দাতা সংস্থার বক্তব্য শোনার পর কাজেমী স্যার কথা বলেন। সাকল্যে ৫ মিনিট। ব্যস, সমাধান বের হয়ে আসে! দাতা সংস্থাও খুশি, আমরাও খুশি। স্যার নতুন কিছু পয়েন্ট যোগ করেন আমাদের পয়েন্টগুলোর সঙ্গে। যে কাজ এত এত চিঠি, এত মিটিংয়ে কেউ করতে পারল না; স্যারের উপস্থিতিতে তা কয়েক মিনিটে তার সমাধান হলো। ওই দিন ব্যক্তিত্বের ক্ষেত্রে গ্র্যাভিটেশনাল পুল বলে যে কিছু অবশ্যই আছে, আমার সে ধারণা আরেক দফা পোক্ত হয়।

প্রতিটি দিন তিনি বাংলাদেশ ব্যাংককে, দেশের ব্যাংকিং জগৎকে ও প্রকারান্তরে দেশকে সমৃদ্ধ করেছেন। প্রচারবিমুখ এই কাজপাগল মানুষটি হয়তো সাধারণ জনগণের কাছে খুব একটা পরিচিত নন। কিন্তু তিনি দেশের ব্যাংকিং খাত–সংশ্লিষ্ট সবার পরম শ্রদ্ধার পাত্রে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন নিজ কর্মগুণেই। অনেক সভায় তিনি নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে বলতেন, ‘সেই ১৯৭৬ সাল থেকে আমি বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে আছি।’ তিনি আমৃত্যু ছিলেন এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মহিরুহ হয়ে। তিনি আজ সব সমীকরণের ঊর্ধ্বে যাত্রা করলেন। রেখে গেলেন তাঁর উত্তরাধিকার। সেই উত্তরাধিকার বহন করে বৈশ্বিক এই ক্রান্তিকালে নিজেদের যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে প্রমাণ করার মাধ্যমেই কেবল সম্ভব বাংলাদেশ ব্যাংক তথা দেশের অর্থনীতির ক্ষেত্রে তাঁর অবদানের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন।

* সদরুল হাসান, যুগ্ম পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক