আমেরিকায় মোমবাতি নিয়ে কাড়াকাড়ি!

মোমবাতি আমাদের সবার কাছে অতি পরিচিত একটি নাম। আধুনিক বিজ্ঞানের যুগেও মোমবাতির কদর এতটুকু কমেনি। বাংলাদেশের অব্যাহত লোডশেডিংয়ের জাঁতাকলে পিষ্ট আধুনিক সুসভ্য শহরবাসীর জীবনে যখন অন্ধকার নেমে আসে, তখন মোমবাতিই পরম বন্ধুর মতো আমাদের আলো দেয়। শুধু বাংলাদেশ বলছি কেন, লোডশেডিংয়ের কবলে পড়লে সারা বিশ্বেই মোমবাতিই একমাত্র ভরসা। তাই শুধু গৃহবাসী নয়, দোকানি বা ব্যবসায়ীদের কাছেও এটি খুব দরকারি ও প্রিয় একটি পণ্য। এ ছাড়া সব ধর্মের মানুষের কাছে মোমবাতি সমানভাবে সমাদৃত। বিভিন্ন ধর্মীয় উপাসনালয়ে তাই মোমবাতির প্রচলন অত্যধিক। মোমবাতি জ্বালিয়ে শুধু আর জন্মদিন বা ক্যান্ডেল লাইট ডিনারই পালন করা হয় না। নানা র্ধমের মানুষের উপাসনালেয় সমানভাবে সমাদৃত এই মোমবাতি।
শুধু জন্মদিনে নয়, শোকে প্রতিবাদে, ভালোবাসায়ও আমরা মোমের আলোয় নিজেকে উদ্ভাসিত করি। প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে নিহতদের স্মরণে নদী তীরে মোমবাতি জ্বালিয়ে আমরা উপকূল দিবস পালন করি। পাকিস্তানি বাহিনীর দেওয়া আগুনে পুড়ে শহীদদের স্মরণে শতাধিক মোমবাতি প্রজ্জ্বলন করে আমরা শহীদের স্মরণ করি। শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের প্রতিবাদ ও অপরাধীদের বিচারের দাবিতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মোমবাতি প্রজ্জ্বলন করে থাকে ডাকসু। শাহবাগে অহিংস বিক্ষোভ সমাবেশের মোমবাতির আলোয় উদ্ভাসিত হয়েছিল পুরো বাঙালি জাতি। এই মোমবাতির প্রদীপের আলো জ্বালিয়ে যেকোনো অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করা এখন নয়, বহু পুরোনো উৎসব। দুর্যোগে ও উৎসবে মোমবাতির প্রয়োজন। বিভিন্ন আকার ও বাহারি রঙের মোমবাতি পাওয়া যায় বাজারে। ঘর সাজানোর জন্য সুগন্ধি মোমবাতি ব্যবহার করা হয়।
আপনারা ভাবতেই পারেন, এই দুঃসময়ে কেন আমি মোমবাতি নিয়ে প্যাঁচাল করছি!
বরাবরের মতোই সপ্তাহান্তের শনি ও রোববার আমি নিউইয়র্কের বাঙালি পাড়া ঘুরে ঘুরে খবর সংগ্রহ করি। পাড়া বেড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে আশপাশের মানুষের সুখ–দুঃখের গল্প শুনি। এবারের বিষয় সম্পূর্ণ আলাদা। বিষয় করোনাভাইরাস। যার নাম অজানা ভীতি। বাজার দর। কার ঘরে কতজন এই মুহূর্তে বেকার আছেন, সে সব নিয়ে লেখা।
অনেকেই তাচ্ছিল্য করেন। আপা ডেইলি দেখি আপনে লিখেন, কি লাভ? মানুষ তো শুনে না। বলেছি, ভাই আপনি একজন তো শুনছেন, এটিই আমার পাওয়া। এরই মধ্যে এক ষাটোর্ধ্ব নারী আসলেন, জানালেন তিনি আমাকে খুঁজছেন। কারণ তাঁর স্বামী কোনো এক তরুণী মেয়ের সঙ্গে প্রেম করছেন, তা নিয়ে পত্রিকায় প্রতিবেদন করাতে চান। তাঁকে আশ্বস্ত করলাম, করোনাভাইরাসের ঝামেলা গেলে আপনার বিষয়টি নিয়ে লিখব। আমার ভাবটা এমন, যেন আমি লিখলেই এ সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। ওই নারীর কাছে করোনার আতঙ্ক দেখতে পেলাম না। উনি আতঙ্কিত স্বামীর অনৈতিক প্রেম নিয়ে।
কয়েকটা দোকানে ঘুরে দেখা গেল মানুষজন কম। গত সপ্তাহে সবাই জিনিসপত্র কিনে মজুত করে ফেলেছে। কারণ মানুষ জানত, কোভিড–১৯–এর সংক্রমণ রোধে সরকার যেকোনো সময় লকডাউন ঘোষণা দেবে। তবুও যেন শেষ হয় না মানুষের কেনাকাটা। শেষ মুহূর্তও দরকারি কিছু কিনে রাখতে হবে, তাই কিছু ব্যতিব্যস্ত গ্রাহককে দেখা গেল। মুখে মাস্ক, হাতে গ্লাভসসহ দ্রুত কেনাকাটা করে ঘরে ফিরে যাচ্ছেন তাঁরা। এমন সময় চোখে পড়ল বেশ কয়েকজন নারী-পুরুষ মোমবাতি কিনছেন। এই মোমবাতি কোন জন্মদিনের বা কোনো উৎসবের আয়োজনের জন্য নয়। দোকানি জানালেন, তাদের স্টক শেষ হয়ে গেছে। তাহলে কেন মোমবাতি কেনা? একজনের দেখাদেখি অনেকেই কিনেছেন।
এতগুলো মোমবাতি কেনার কারণ জানতে চাইলে একজন জবাব দিলেন, কেন আপনি জানেন না লকডাউন দিয়েছে?
লকডাউনের সঙ্গে মোমবাতির সম্পর্ক জানতে চাইলে ওই ক্রেতার উত্তর, লকডাউন দিয়েও সরকার যখন মানুষকে ঘরে ঢোকাতে পারবে না, তখন ইলেকট্রিসিটি নিয়ে নিবে।
একজন জ্যামাইকান নারী জানালেন, ইলেকট্রিসিটি আওটেজ হতে পারে। তাই তারা মোমবাতি কিনছেন। কথা হয়তো সত্য।
দোকানে ওই নারীদের কথা শুনে নিজেও কিছু কিনে বাসায় ফিরলাম। হাতে মোমবাতি দেখে বর আজব দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
অমন হা করে দেখছ কি?
সবাই কিনছে, তাই আমিও এক বক্স কিনলাম।
এর মধ্যেই শাম্মী কল দিয়ে একই কথা বলল, সবাই মোমবাতি কিনছে। শাম্মি থাকে জ্যামাইকার হিল সাইডে। কুইন্সের সুপার শপে তার বাচ্চার জন্য দরকারি কিছু না পেয়ে সে লং আইল্যান্ডে কস্টকো, ওয়ালমার্ট ঘুরে এসে ফোন দিয়ে জানাল, শুধু বাঙালি নয়, আমেরিকানরাই বেশি মোমবাতি কিনে স্টক করছে।
আমার বরকে লাউড স্পিকারে শাম্মীর কথা শুনলাম। সে তার চোখমুখে আমাদের দুজনের কথাকে ব্যঙ্গ করতে দেখা গেল। তখন তাকে আর পাত্তা দিলাম না।
এমনিতেই কোয়ারেন্টিনে আছে। খামোখা তর্ক করে গৃহযুদ্ধ বাঁধাতে চাই না। আমি আমার রুমে ঢুকে গেলাম।
আমার মনে পড়ে গেল, দেশে থাকাকালে ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের ঘটনা। বাংলাদেশের চট্টগ্রাম, কক্সবাজার উপকূলের মানুষের জন্য ছিল এক ভয়ানক রাত। ঘণ্টায় ২৪০ কিলোমিটার গতিবেগে বাতাস আর প্রায় ২০ ফুট উচ্চতায় জলোচ্ছ্বাস নিয়ে রাত প্রায় ১২টা নাগাদ উপকূলে আছড়ে পড়ে হারিকেনের শক্তিসম্পন্ন প্রবল এক ঘূর্ণিঝড়। মূলত বিকেল থেকে বইতে থাকা দমকা বাতাস প্রবল এক ঝড়ের আভাস দিচ্ছিল। বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রে যাওয়ার সময় টর্চলাইট, দেশলাইসহ মোমবাতি ও এমনকি শুকনো খাবার এবং বিশুদ্ধ পানি সবাই সঙ্গে নিয়েছিল। তখন লোডশেডিং ছিল সপ্তাহব্যাপী। তখনো দেশে এখনকার মতো যত্রতত্র জেনারেটরের ব্যবহার ছিল না। তাই সবাই মোমবাতি বেশি দামে দিয়ে কিনে মজুত করতে দেখেছি। কিন্তু এই নিউইয়র্কে এই ছয় বছরে কোনো লোডশেডিং দেখিনি। তাহলে কি সোমবার থেকে সত্যিই পাওয়ার আওটেজ হবে?
নাহ। আমার সাধারণ মস্তিষ্কে বলে, এ দেশে মোমবাতি কিনে রাখার মতো পরিস্থিতি এখনো তৈরি হয়নি। সারা বিশ্ব যেখানে স্কুল অফিস আদালত বন্ধ ঘোষণা করেছে। শুধু বন্ধ বলেই ছাড়েনি, হেলথ সেক্টর ছাড়া বাকি সবাইকে বিশেষ করে ছাত্র–শিক্ষকসহ সবাইকে অনলাইনে ক্লাস করবার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। স্কুলশিক্ষার্থীদের ফ্রি ট্যাব ও ইন্টারনেট সংযোগ দেওয়া হয়েছে। যদি বিদ্যুৎই নিয়ে নেবে, তো এসব কর্ম বাসা থেকে কি করে সম্পাদন হবে?
হয়তোবা এটিও একটি ভেসে আসা গুজব।
করোনা বৈশ্বিক মহামারি ধারণ করতে পারে বলে আগে থেকেই মার্কিন গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য ছিল। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে গত জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে করোনাভাইরাস বিস্তার ও বিশ্বব্যাপী এটি মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়া সম্পর্কে গোপন সতর্কবার্তা মার্কিন সরকারকে দেওয়া হয়েছিল। তখন থেকেই যদি এখনকার মতো নজরদারি দেওয়া হতো, তাহলে মৃত্যুর সংখ্যা হয়তো অনেক নেমে আসত।
আমেরিকার নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যকে ‘লকডাউন’ ঘোষণা করা হয়েছে। মানুষের জীবনের জন্য অপরিহার্য নয়, এমন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া সব বন্ধ থাকবে। ২০ মার্চ সকালে নিউইয়র্ক রাজ্যের গভর্নর অ্যান্ড্রু কুমো এ ঘোষণা দেন। স্থানীয় সময় রোববার রাত ৮টা থেকে পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত এই নির্দেশনা কার্যকর থাকবে। আদেশ লঙ্ঘনকারীদের জরিমানা গুনতে হবে।
অঙ্গরাজ্যের গভর্নর ঘোষণায় বলেন, ‘আমরা আমাদের সাধ্যমতো সবকিছু করছি। একটা জীবনও যদি বাঁচাতে পারি, তাহলে খুশি হব।’