করোনাঝড় থামলে পরের প্রস্তুতি কী

পোল্যান্ডের ক্র্যাকোতে লকডাউন চলাকালে মাস্কসহ একটি ভাস্কর্য। ছবি: রয়টার্স
পোল্যান্ডের ক্র্যাকোতে লকডাউন চলাকালে মাস্কসহ একটি ভাস্কর্য। ছবি: রয়টার্স

বিশ্ব এখন করোনাভাইরাস মহামারিতে আক্রান্ত। এ মহামারি থেমে গেলে পরিস্থিতি কী? যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি প্রার্থী ফাহাদ হুমায়ূন আল–জাজিরায় করানো-উত্তর বিশ্ব প্রসঙ্গে একটি মতামত লিখেছেন। এতে তিনি বলেন, কোভিড-১৯ ঝড়টি যখন কমে যাবে, তখন রাষ্ট্রগুলো পরস্পরের সঙ্গে কী ধরনের আচরণ করে, তা নির্দেশ করার জন্য সম্ভবত নতুন নিয়মের প্রয়োজন হবে।

ফাহাদ লিখেছেন, প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে শুরু করে আর্থিক মন্দা, যুদ্ধের সূচনা পর্যন্ত প্রতিটি দুর্যোগে রাজনীতি, মানুষ এবং বাজার যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায়, তা একই রকম। এ ক্ষেত্রে সহজাত প্রতিক্রিয়া হলো ভয় ও অনিশ্চয়তা; এরপর আসে প্রশমন এবং অবশেষে বিপর্যয়ের ধ্বংসাবশেষ থেকে পুনর্নবায়নের জন্য অনুসন্ধান।

আল–জাজিরায় প্রকাশিত মতামতে বলা হয়, পাঁচ কোটির বেশি মানুষকে লকডাউন করে বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশ যখন করোনাভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবিলা জরুরি পদক্ষেপ নিয়েছে, তখন মহামারি–উত্তর বিশ্ব কেমন হবে, এ জন্য প্রস্তুত দেশের সংখ্যা নেহাতই কম। এ সময় সমাজের বিভিন্ন দাবি পূরণ করা হবে কি না বা একবিংশ শতাব্দীর বৈশিষ্ট্যযুক্ত আত্মবিশ্বাস এবং অতি ব্যক্তিত্ববাদ থাকবে কি না, সে প্রস্তুতি নিয়ে প্রশ্ন উঠবে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে একটি উদার আন্তর্জাতিক আদেশের জন্য মূল্যবোধ ও পারস্পরিক নির্ভরশীলতার ভিত্তিতে একটি আন্তর্জাতিক কর্মকাঠামোর প্রয়োজন পড়ে। এর আগে সাত দশকের বেশি সময় ধরে চলা বিশ্বায়ন, দারিদ্র্য ও মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর স্থানীয় অসন্তোষের প্রভাবে এটি ধীরে ধীরে ক্ষয় হচ্ছিল।

কয়েক মাস আগপর্যন্ত এটি প্রায় নিশ্চিত বলে মনে হয়েছিল যে ব্রাজিল থেকে হাঙ্গেরি, ভারত থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক অধিকার পুনরুত্থান ঘটবে। একবিংশ শতাব্দীর অন্যদের নতুন ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে আসবে। একনায়কতন্ত্র (অটোক্রেসি) ঘনীভূত হবে। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে বহিষ্কার ও বিদেশিদের ভীতির বিষয়টি প্রাধান্য পাবে; জাতীয়তাবাদ, ইমিগ্রেশন এবং সুরক্ষার কঠোরতার নামে অভিবাসী সংকট বড় করে দেখানো হবে।

কিন্তু স্প্যানিশ ইনফ্লুয়েঞ্জার পর মারাত্মক এ মহামারি কী সব পরিবর্তন করে ফেলবে? গত দুই দশকের নব্য স্বৈরাচারী চরিত্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের প্রস্থান করার সময় নাটকীয়ভাবে পরিণতি, করোনাভাইরাসের মারাত্মক ছড়িয়ে পড়ার মতো পরিণতি থেকে মুক্ত করতে পারবে?

উদার বৈশ্বিক উত্তরাঞ্চল নাগরিকদের চলাচলকে বিচ্ছিন্ন, পৃথক্‌করণ এবং সীমাবদ্ধ করতে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, তবে দীর্ঘ মেয়াদে এ মহামারি সম্ভবত সুরক্ষা জাল, সহযোগিতা এবং আন্তসীমান্ত সংযোগ ছাড়া বিশ্ব টেকসই নয়, সে বিষয়টিই তুলে ধরবে। রাজনৈতিক নেতা ও নির্বাচিত নেতাদের অপ্রস্তুতি জলবায়ু অস্বীকার পৃথিবীকে অনিরাপদ করা ও রাজনৈতিক চাউনিবাদীদের নিয়ে কঠোর প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে।

করোনাভাইরাস নিয়ে শুধু ইউরোপ নয়, লাতিন আমেরিকা থেকে শুরু করে এশিয়ার বিভিন্ন দেশ রাতারাতি সংহতি ও সহযোগিতার জন্য বাধ্য হয়েছে। আন্তর্জাতিক ভ্রমণ নিয়মের সমন্বয়, জনস্বাস্থ্য পরিচালনার কৌশল–সম্পর্কিত তথ্য ভাগ করে নেওয়া, দেশীয় খবরের সত্যতা যাচাই করা এবং বৈজ্ঞানিক দক্ষতার আদান-প্রদানে সম্মত হয়েছে তারা। পশ্চিম ইউরোপকে পুনর্গঠন করা মার্শাল প্ল্যানের মতো সরকারগুলোকে শিগগিরই আর্থিক উৎসাহ এবং বাণিজ্য নিয়ে সহযোগিতা করা দরকার পড়বে। এটি আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার জন্য একটি বড় কাজ হবে, যা আমেরিকার ‘একা একা’ নীতির চেয়ে আলাদা হবে।

ফাহাদ লিখেছেন, ইতিমধ্যে ইউরোপের নেতারা ডোনাল্ড ট্রাম্পের দেওয়া ইউরোপীয় মিত্রদের ভ্রমণ–নিষেধাজ্ঞার একতরফাবাদের বিষয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তেল নিয়ে রাশিয়া ও সৌদি আরবের মধ্যে লড়াইয়ের মধ্যে তেল উৎপাদনকারীরা এখন মহামারির পটভূমিতে কীভাবে দাম স্থিতিশীল করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা করতে বাধ্য হচ্ছেন। আমেরিকান আইনপ্রণেতারা ইরানের ক্ষেত্রে ‘সর্বোচ্চ চাপের নীতি’ পুনর্বিবেচনা করার আহ্বান জানিয়েছেন, যাতে দেশটি চিকিৎসা সরঞ্জাম আমদানি করতে পারে। জাপানের ক্ষমতাসীন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির সদস্যরা চীনের মহামারি মোকাবিলায় সহায়তা করতে তাঁদের মাসিক বেতন অনুদানের পক্ষে ভোট দিয়েছেন। চীনের সোশ্যাল মিডিয়াতেও জাপানিদের প্রতি প্রশংসায় ভরে গেছে।

ফাহাদের ভাষ্য, মহামারির বিস্তার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমতায় থাকা জনপ্রিয় নেতারা অনিবার্যভাবে একটি বিশ্বাসযোগ্যতার সংকটের মুখোমুখি হবেন। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ভারতের নেতারা এ ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়বেন। মহামারির ক্ষেত্রে কোনো জাতিগত বা অন্যান্য বিষয় নেই। এসব নেতা কার্যকরভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতে এবং রোগের বিস্তারকে ধারণ করতে অক্ষমতার জন্য সমালোচনার মুখোমুখি হবেন। এসব কারণে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দ্রুত প্রযুক্তি সহায়তা নিয়ে সার্ক সদস্যদের নিয়ে ভিডিও কনফারেন্স করেছেন। সত্যি ঘটনা হচ্ছে, মোদির কর্তৃত্ববাদী শাসনের অধীনে ভারত গত পাঁচ বছর আঞ্চলিক সংহতকরণের বিরুদ্ধে কাজ করেছে, পরিবর্তে প্রতিবেশী উত্তেজনা বাড়িয়ে তুলেছে। এমনকি চীনেও যেখানে সোশ্যাল মিডিয়া ব্লগারদের জন্য কড়া নিয়ম রয়েছে, সেখানে কমিউনিস্ট পার্টি মহামারির সময় তথ্য প্রকাশে বাধা দেওয়ার মূল্য বুঝতে পেরেছে।

মতামতে ফাহাদ লিখেছেন, করোনভাইরাস বৈশ্বিক রাজনীতিতে পরিবর্তন আনবে। দুটি কারণে এটি ঘটতে পারে। প্রথমটি হলো যুদ্ধ, ভূমিকম্প ও দুর্ভিক্ষের মতো ধাক্কার বিপরীতে মহামারি অঞ্চল বা মানবপরিচয় বিবেচনায় বৈষম্যমূলক আচরণ করে না। প্রাকৃতিকভাবেই মহামারি অন্তর্ভুক্তিমূলক এ ক্ষেত্রে বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া প্রয়োজন পড়ে। দ্বিতীয়ত, অন্যান্য নিরাপত্তা সংকটের মতো বিপক্ষ দলকে চুপ করিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা সরকারের হাতে থাকে না। যেহেতু এ ক্ষেত্রে সমালোচনাকে আনুগত্যহীন বা দেশপ্রেমহীন হিসেবে অভিহিত করা আরও শক্ত হবে। এটি নেতৃত্বের পরিবর্তনে সরকারকে দুর্বল করে তুলবে এবং প্রান্তিক রাজনৈতিক দলগুলোকে উদ্ভাবনের সুযোগ দেবে।

ফাহাদ তাঁর লেখায় বলেছেন, গণতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্রের জন্য করোনাভাইরাস বৈদেশিক এবং দেশীয় নীতি পরিচালনার ক্ষেত্রে একটি নৈতিক হিসাব হিসেবে গণ্য করে। কারণ বৈষম্য, জলবায়ু পরিবর্তন এবং সামাজিক গতিশীলতার চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করার জন্য ক্ষমতা সবার সামনে উন্মুক্ত থাকবে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ইতিমধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর জন্য ঋণ মওকুফ করার আহ্বান জানিয়েছেন। এটা হোক বা না হোক, নিয়ন্ত্রণের ঘাটতি, সামাজিক সমতার প্রতি দায়বদ্ধতা এবং দুর্যোগের পূর্ববর্তী আন্তসীমান্ত সংযোগ ব্যর্থতার ক্ষেত্রে সরকারি কর্মীরা অবশ্যই দায়বদ্ধ হবেন। করোনাঝড় থামলে তখন রাষ্ট্রগুলোর আচরণ নির্দেশের জন্য নতুন নিয়ম প্রয়োজন হবে।

আরও পড়ুন:
করোনাভাইরাস: বিশ্ব যেভাবে বদলে যাবে 
করোনার বিপক্ষে যুদ্ধ : নেতৃত্বহীন মানব সম্প্রদায়
বিশ্বটা যেভাবে পাল্টে যাবে
করোনা মোকাবিলা: আর বিলম্ব নয়, এখনই সময়
‘সিস্টেম’-এ ছিদ্র ছিল
ভবিষ্যতে বৈশ্বিক নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্র না চীন, প্রশ্নটা তুলেই দিল করোনা
করোনার পায়ে পায়ে মন্দার পদধ্বনি?
হায়, গুলিতে তো করোনা মরে না