
যাঁর যে স্বীকৃতি প্রাপ্য, সেটি দেওয়া উচিত বলেই আমি মনে করি। স্বাধীনতার ঘোষণাটা জিয়াউর রহমানই প্রথম দিয়েছিলেন কি না, এ নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। তবে এই তথ্যটা বিতর্কাতীত যে, আকাশযানের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় করিয়ে দেওয়ার স্বীকৃতিটা জিয়াউর রহমানেরই প্রাপ্য। সালটা ১৯৭৮ বা ১৯৭৯ হবে। সেভেন বা এইটে পড়ি। কালের প্রবাহ এবং সমাজবাস্তবতা মিলিয়ে গৌরীশঙ্কর মাঠ থেকে নামান্তরিত সরিষাবাড়ী গণময়দানে জিয়াউর রহমানের ‘ঐতিহাসিক বিশাল জনসভা’। যত দূর মনে পড়ে, কারও দ্বারা আদিষ্ট হয়েই শিক্ষক সমভিব্যাহারে স্কুল থেকে আমাদের গণময়দানে যাত্রা। যেতে যেতে মনে একটা শঙ্কাও কাজ করছিল। ‘বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট’-এর বাইরে আমার কাছে তখন জিয়াউর রহমানের একটাই পরিচয়—চোখে সানগ্লাস-মাথায় ক্যাপ এই ভদ্রলোক যেখানে যান, সেখানেই খাল কাটতে শুরু করেন। খেলাধুলা ছাড়া বাকি সব কায়িক শ্রমে চরম অনীহ ছিলাম (পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতেও আদর্শে অবিচল থেকে এখনো তা-ই আছি)। মনে তাই ভয়, দেশের জন্য কাজ করাটা ছোটবেলা থেকেই অভ্যাস করানো ভালো মনে করে আমাদের না আবার কোদাল দিয়ে মাটি-টাটি কাটার কাজে লাগিয়ে দেওয়া হয়! ভাগ্য ভালো, খাল কাটাটা অনুষ্ঠানসূচিতে ছিল না। এসব বাহুল্য কথা হচ্ছে। আকাশযানের সঙ্গে পরিচয়ের কথায় আসি। গণময়দানের পাশেই নদী—সুবর্ণখালী। নামটা যত সুন্দর, জলপ্রবাহ তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। গ্রীষ্মে সেটি শুকিয়ে যায়। প্রেসিডেন্টের হেলিকপ্টার সেখানেই নেমেছে। প্রচণ্ড গর্জন আর বায়ুপ্রবাহের জন্ম দিয়ে আকাশ থেকে নেমে আসা বস্তুটি আমার বিস্ময়ের সবটুকু অধিকার করে নিয়েছে। জিয়াউর রহমান ভাষণ দিতে শুরু করার কিছুক্ষণ পর মনে হলো, হাতের কাছে অমন বিস্ময়কর জিনিসটা একটু কাছ থেকে দেখে নেওয়ার সুযোগটা হারানো নির্বোধের কাজ হবে। আমি তাই ওই জনারণ্য ছেড়ে হেলিকপ্টারমুখী যাত্রা শুরু করলাম। আকাশে উড্ডীয়মান অবস্থায় ক্ষুদ্রকায় দেখানো জিনিসটি তো দেখছি বেশ বড়! হেলিকপ্টারের হাত দশেকের মধ্যে পৌঁছে যাওয়ার পর ভেতরে ঢোকা ঠিক হবে কি না ভাবছি, ‘হেনকালে হায় যমদূত প্রায়’ সেনাবাহিনীর দুই সদস্য অস্ত্র উঁচিয়ে ছুটে এল। একজন আমার ঘাড় ধরে প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, ‘এই পিচ্চি, এখানে কী করিস?’ ‘তুই’ করে সম্বোধিত হওয়ার বিরক্তি চেপে রেখে আমি সত্যিটাই বললাম, ‘হেলিকপ্টার দেখতে এসেছি।’ আমার অনুসন্ধিৎসু মনের বিন্দুমাত্র মর্যাদা না দিয়ে চড় মারার ভঙিতে হাত উঠে গেল একজনের, ‘যা, ভাগ এখান থেকে।’
খুবই অপমানজনক আচরণ। হেলিকপ্টারটা ভালোভাবে দেখে-টেখে সেটির গল্প বলে বন্ধুদের তাক লাগিয়ে দেব ভেবেছিলাম। উল্টো ভগ্ন মনোরথে ফিরে আসতে আসতে সভয়ে চারপাশে তাকালাম, আমার এই অপমান কেউ দেখে ফেলল নাকি! এর পর থেকে হেলিকপ্টার দেখলেই আমার এই ঘটনাটা মনে পড়ে। জিয়াউর রহমান নামটা শুনলেও।
আকাশযান কাছ থেকে দেখার প্রায় চৌদ্দ-পনেরো বছর পর প্রথম সেটিতে চড়ার সুযোগ এল। সেই অভিজ্ঞতাও নিস্তরঙ্গ নয়। কলকাতা-চেন্নাই হয়ে কলম্বোতে যাব। বোর্ডিং পাস নিয়ে ইমিগ্রেশন পর্যন্ত চলে গেছি। গিয়ে আবিষ্কার করলাম, পাসপোর্টটাই সঙ্গে নেই। পাসপোর্ট-টিকিট ও অন্য সব প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ছিল ছোট্ট একটা কালো ব্যাগে। সেটিও নেই! ইমিগ্রেশন অফিসার সন্দেহমাখা চোখে তাকিয়ে। আমি পাগলের মতো ছুট লাগালাম। প্রথম বিদেশযাত্রা শুধু এয়ারপোর্ট-যাত্রাতেই শেষ হয়ে যাচ্ছে না তো! ট্রাভেল ট্যাক্স তখন এয়ারপোর্টে ব্যাংকের বুথে জমা দিতে হতো, সেখানেই হয়তো ফেলে এসেছি। কিন্তু সেখানে এত লোকের ভিড়, সেটি কি আর এতক্ষণ পড়ে থাকার জিনিস! শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক থাকার পরও ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়া বলতে কী বোঝায়, সেটি বুঝলাম দূর থেকেই ব্যাগটা দৃশ্যমান হওয়ায়। জীবনে কোনো জড়বস্তু দেখে এমন খুশি হইনি।
সেই শুরু, এরপর পেশাগত কারণে আকাশযান অন্য সব যানবাহনের মতোই হয়ে গেছে প্রায়। একবার বাংলাদেশের কোন একটা ট্যুর থেকে ফেরার সময় বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক কোচ ডেভ হোয়াটমোরের সঙ্গে আড্ডায় দুজন হিসাব করছিলাম, জীবনের কতটা সময় আকাশে উড্ডীয়মান অবস্থায় হারিয়ে গেছে। হোয়াটমোরের তুলনায় তো আমি শিশু। তাঁকে তাই ‘খেচর’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলাম। এর অর্থ ‘আকাশে চড়ে যাহা’ জানার পর হোয়াটমোর খুব মজা পেয়ে বেশ কয়েকবার শব্দটা উচ্চারণ প্র্যাকটিস করেছিলেন।
প্রায় প্রতিটি ভ্রমণেই কোনো না কোনো গল্প আছে। একটি বলতে গেলে আরেকটি মনে পড়ে। কিন্তু ঈদসংখ্যার সম্পাদক যে লেখার শব্দ বেঁধে দিয়েছেন! স্মৃতির সাগরে সাঁতরাতে সাঁতরাতে যে দু-তিনটি বড় ঢেউ মনে আছড়ে পড়ছে, আপাতত না হয় তা-ই বলি।
২০০৪ সালে অলিম্পিক কাভার করতে এথেন্সে যাচ্ছি। চেক-ইন করে বিমানে ওঠার অপেক্ষায়। এমিরেটসের এক কর্মী এসে বললেন, ‘স্যার, আপনি আগেই প্লেনে উঠবেন না। অপেক্ষা করবেন।’ এই রে, কি-না-কি ঝামেলা হয়েছে, কে জানে! টুইন টাওয়ারে হামলার পর থেকে এয়ারপোর্ট মানেই হাজারো হ্যাপা। জর্জ বুশ যখন ওসামা বিন লাদেনকে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছেন, কে যেন লাদেনকে জীবিত ধরতে পারলে তাঁর একটা ‘শাস্তি’র প্রস্তাব করেছিলেন। টানা এক মাস প্রতিদিন ৫০ বার লাদেনকে এয়ারপোর্টের সিকিউরিটি সিস্টেমের ভেতর দিয়ে যেতে হবে। এয়ারপোর্টে যখন বেল্ট-জুতা পর্যন্ত খুলে স্ক্যানিং মেশিনে দিতে হয়, কথাটা খুব মনে পড়ে।
ইকোনমি ক্লাসের যাত্রীরা বিমানে উঠতে শুরু করেছে। আমি আক্ষরিক অর্থেই কম্পিত বক্ষে অপেক্ষা করছি। এমিরেটসের ওই লোকটাকেও কোথাও দেখছি না। হঠাৎই পেছন থেকে একটা কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম, ‘আপনাকে অপেক্ষা করানোর জন্য দুঃখিত।’ তা না হয় বুঝলাম, কারণটা বল না! সেই কারণটা জেনে খুব খুশি, আমার ইকোনমি ক্লাসের টিকিটটা বিজনেস ক্লাসে আপগ্রেড করে দেওয়া হয়েছে। এমিরেটসে এত যাওয়া-আসা করেছি, এই সৌভাগ্য আগে হয়নি। আমি তাই জানতে চাইলাম, ‘দয়া করে বলবেন, আমার “অপরাধ”টা কী?’ আমার বলার ভঙ্গিতে খুব মজা পেয়ে লোকটা হাসতে হাসতে জানাল, ঢাকা-দুবাই রুটে ইকোনমি ক্লাস ওভারফ্লো হয়ে গেছে। বিজনেস ক্লাসে সিট খালি। বসতে দিলে শোয়ার জায়গা খোঁজার অভ্যাসটা বোধ হয় মানুষের মজ্জাগত। সঙ্গে সঙ্গেই আমার মনে হলো, আহা, দুবাই-এথেন্স রুটেও যদি এমন হতো!
সেটি তো হয়ইনি, বরং দুবাই-এথেন্স যাত্রাপথটা পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল অসহ্য এক অভিজ্ঞতার সঙ্গে। সেই প্রসঙ্গে পরে আসি। আগে ঢাকা থেকে দুবাই যাই। বিজনেস ক্লাসে পাশের যাত্রীর সঙ্গে পরিচয় হলো। মোটাসোটা মধ্যবয়সী ভদ্রলোক। নামটা যত দূর মনে পড়ছে, রেজাউর রহমান। উত্তরা নিবাসী, কী একটা যেন ব্যবসা করেন। খেলা কাভার করতে প্রায়ই বিদেশ যাওয়া হয় শুনে আফ্রিকায় কখনো গিয়েছি কি না জানতে চাইলেন। আফ্রিকার যে তিনটি দেশে গিয়েছি, তার মধ্যে জিম্বাবুয়েও আছে জেনে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ভিক্টোরিয়া ফলসে গেছেন?’ আমি সগর্বে বললাম, ‘আমার তো মনে হয়, আমি একটা রেকর্ডই করে ফেলেছি। দুবার ভিক্টোরিয়া ফলসে বাংলাদেশের আর কেউ গেছে বলে তো মনে হয় না।’
শুনে ভদ্রলোক মিটিমিটি হাসছেন। তখন সেটির অর্থ বুঝিনি। তাঁর পরের প্রশ্নটা একটু অবাকই করল, ‘পূর্ণিমার রাতে ভিক্টোরিয়া ফলস দেখেছেন?’
ভদ্রলোকের অজ্ঞতায় বিরক্ত না হয়ে ক্ষমাসুন্দর একটা হাসি দিয়ে বললাম, ‘পূর্ণিমার রাতে ভিক্টোরিয়া ফলস দেখব কীভাবে? এটির প্রবেশদ্বার তো বিকেল পাঁচটা না ছয়টায় বন্ধ হয়ে যায়।’
‘হ্যাঁ, তা যায়। তবে আমি প্রায় দুই বছর প্রতি পূর্ণিমার রাতে ভিক্টোরিয়া ফলস দেখেছি। ওই দৃশ্যের কোনো তুলনা হয় না। আর আপনি কী রেকর্ডের কথা বলছিলেন না! আমি কতবার ভিক্টোরিয়া ফলসে গেছি, সংখ্যাটা ঠিক বলতে পারব না। তবে পঞ্চাশ-ষাটবারের কম তো অবশ্যই নয়।’
আমি যত না বিস্মিত, তার চেয়ে বেশি বিরক্ত। চাপা মারার আর জায়গা পাও না! আমার মুখে মনের ভাব ফুটে উঠে থাকবে। তা দেখে মুখে মৃদু হাসি নিয়ে সবিস্তার ব্যাখ্যাও দিলেন ভদ্রলোক। ভিক্টোরিয়া ফলস জাম্বিয়ার সঙ্গে জিম্বাবুয়ের সীমান্তে। তিনি জাম্বিয়ায় এক ব্যাংকে দুই বছর চাকরি করেছেন। ভিক্টোরিয়া ফলসে যাওয়াটা হয়ে গিয়েছিল নেশার মতো। নির্ধারিত সময়ে তো অনেকবারই গেছেন। পূর্ণিমার রাতে যেতেন গাড়িভর্তি বন্ধুবান্ধব মিলে। প্রবেশাধিকারের ‘চিচিং ফাঁক’ মন্ত্র ছিল গার্ডের হাতে কিছু ডলার গুঁজে দেওয়া।
শুনে-টুনে আমি খুব লজ্জা পেলাম। এই লোকের কাছে আমি দুবার ভিক্টোরিয়া ফলসে যাওয়া নিয়ে বড়াই করছি! নাটকীয় ভঙ্গিতে তাই ক্ষমা চাইলাম। হো-হো হাসিতে মনে হলো, সেটি পেয়েছিও। ‘প্রবাবিলিটি’র একটা অঙ্কও মাথায় ঘুরতে থাকল। দুবার ভিক্টোরিয়া ফলস তো আসলেই বাংলাদেশের খুব বেশি মানুষ দেখেনি। এই কীর্তির আলোয় আলোকিত আমার পাশের সিটেই ভিক্টোরিয়া ফলসকে বাড়ির উঠান বানিয়ে ফেলা ওই লোকটার সিট পড়ার ‘প্রবাবিলিটি’ কত ছিল?
এখানে বিব্রত হয়েছিলাম নিজের দোষে। তবে দুবাই-এথেন্স যাত্রাপথে যে বিব্রতকর অভিজ্ঞতা, সেটির দায় একটুও আমার নয়। দুবাই এয়ারপোর্টেই দেখা হয়েছিল লেসোথোর অলিম্পিক দলের সঙ্গে। তাদের একজনকে পেলাম আমার পাশের সিটেই। লেসোথো দলের ম্যারাথন কোচ। ভালোই হলো, দূরপাল্লার দৌড়ে আফ্রিকার সাফল্যের রহস্য নিয়ে আলাপ করা যাবে। আগাম একটা স্টোরির রসদও কিছুটা জোগাড় হয়ে যাবে তাতে। তখন কল্পনাও করিনি, পরবর্তী ঘণ্টা চারেক কী অস্বস্তিই না উপহার দিতে যাচ্ছেন চিমসে মুখের ওই তালপাতার সেপাই। সিটে বসার পর থেকেই মৃদু একটা ‘সুগন্ধ’ টের পাচ্ছিলাম। সেটি যে ম্যারাথন কোচের গাত্র-নিঃসৃত, সেটি বুঝতে বেশি সময় লাগল না। এই ‘গিদর’ কি স্নান-টান করে না নাকি! করলেও সেই কর্মটা বোধ হয় প্রতি লিপইয়ারে একবার হয়!
একটু পরই অবশ্য আসল কারণটা জানতে পারলাম। তিন-চার এয়ারপোর্ট ঘুরে লেসোথোর অলিম্পিক দলটা দুবাই পৌঁছেছে দেশ ছাড়ার ২০-২১ ঘণ্টা পর। বলাই বাহুল্য, এই সময়টা এক কাপড়েই কেটেছে। তা এমন ঝাঁজালো গন্ধ উৎপাদন করছে যে, আফ্রিকার দূরপাল্লার দৌড় নিয়ে আলোচনার উৎসাহ কর্পূরের মতো উবে গেছে। আমি মাঝের সিটে, বাঁয়ের সিটে ওই ‘জীবন্ত সুগন্ধি’, যা থেকে বাঁচতে ডান দিকের সিটের যাত্রীর বিরক্তি উৎপাদন করে জানালায় উঁকিঝুঁকি দিতে শুরু করলাম। কিছুক্ষণ পর কোচ মহোদয় ছোট ঘরে যাওয়ার পর ভাবলাম, ‘যাক, কিছুক্ষণের জন্য একটু স্বস্তি।’ হলো উল্টো, আগের চেয়েও ঝাঁজালো একটা গন্ধ এসে এবার রীতিমতো ঝাপটা দিল নাকে। কী ব্যাপার, ঘটনা কী!
গন্ধের উৎস খুঁজতে গিয়েই ঘটনা পরিষ্কার। ওয়াশরুমে যাওয়ার আগে তালপাতার সেপাই কেডস খুলে তাতে মোজাজোড়া গুঁজে দিয়ে গেছেন। মোজায় অনেকেরই গন্ধ হয়, কিন্তু সেটি যে এমন তীব্র এবং বৈচিত্র্যময় হতে পারে, এটা আমার কল্পনাতেও ছিল না। নাকে হাত দিয়ে আছি, পেছন থেকে এক যাত্রী এসে কেডস জোড়াতে ডিওডরেন্ট স্প্রে করে দিতেই প্লেনে হাসির রোল উঠল। বুঝতে পারলাম, পাশে বসেছি বলে আমার ভাগে বেশি পড়ছে, তবে এই ‘মধুগন্ধ’ থেকে অন্যরাও একেবারে বঞ্চিত হচ্ছে না। ম্যারাথন-কোচ সিটে ফেরার পর আমি মোজার দিকে ইঙ্গিত করে বললাম, ‘গুড পারফিউম!’ বিব্রত হওয়ার বদলে ডিওডরেন্টের কথা বলছি ভেবে উল্টো ‘ইয়েস, গুড পারফিউম’ বলে তাঁর মুখে মৃদু হাসি।
কথায় কথা আসে। আকাশপথে সহযাত্রীর উপহার দেওয়া ‘দারুণ’ আরেকটি অভিজ্ঞতার কথাও মনে পড়ে গেল। লন্ডনে যাচ্ছি, পাশের দুই সিটে পাঁচ-ছয় বছরের এক ছেলেকে নিয়ে মাথায় ঘোমটা টানা এক ভদ্রমহিলা। স্বামী ইংল্যান্ডে গেছেন বেশ কিছুদিন, অনেক চেষ্টাচরিত্রের পর স্ত্রী-পুুত্রও সেখানে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। ভদ্রমহিলা খুব লজ্জা-লজ্জা ভাব করে সিলেটিতে এটুকু জানিয়েছেন। পরপুরুষের সঙ্গে কথা বলতে লজ্জা পাচ্ছেন দেখে আমি কথা বাড়াইনি। কানে হেডফোন দিয়ে একটা সিনেমা দেখতে শুরু করেছি, হঠাৎই শার্টে টান। চমকে উঠে দেখি, ছোট্ট ওই ছেলেটা শার্ট খামচে ধরেছে। কান থেকে হেডফোন খোলার পর কারণটা জানা গেল, ‘ওই, আমার টেলিবিশন ছলে না।’
‘টেলিবিশন’ মানে সামনের সিটের পেছনের ছোট্ট পর্দাটা চালিয়ে দিলাম। রিমোট টিপে একটা কার্টুনও এনে দিলাম। সিনেমাটায় মজে গেছি, এবার হাতে খামচি, ‘ওই, আমি কানে শুনি না।’ কানে শোনো না তো আমি কী করব, আমি নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞ নাকি! ওই ছোট্ট বাচ্চাকে এটি কীভাবে বলি! হেডফোনের কানেকশনটা লুজ হয়ে ছিল, সেটি ঠিক করে দিলাম। ১০ মিনিটও যায়নি, আবার পেটে খোঁচা। এবার একটু বিরক্তই হলাম, এ তো দেখি ভালো যন্ত্রণায় পড়া গেল! এবারের সমস্যা তৃষ্ণাজনিত, ‘আমি ফানি খাইতাম।’ বালকের বলার ভঙ্গিতে এমন অধিকারবোধ ফুটে বেরোচ্ছে যে, সন্দেহ হলো এ মনে হয় অনুপস্থিত বাবার আসনে আমাকে বসিয়ে দিয়েছে! বিমানবালাকে ডেকে ‘ফানি’র ব্যবস্থা করা গেল।
সেই ‘ফানি’ খাওয়ার সময় তা ছলকে এসে প্যান্ট ভিজিয়ে দিল। কিছুক্ষণ পর খাবার ট্রলি নিয়ে পাশে বিমানবালা, ‘ফিশ অর চিকেন?’ আমি আমারটা বললাম। আবারও খামচি সহকারে ওই বালকের প্রবল অধিকারবোধের প্রকাশ, ‘ওই, আমি খী খাইতাম?’
মাছ না মুরগি বুঝিয়ে বলার পর সিদ্ধান্তহীনতা থেকে মুক্তি পেতে বালকের সরল সমাধান, ‘দুইডাই খাইতাম!’