
‘কাবুলিওয়ালা ও কাবুলিওয়ালা, তোমার ও ঝুলির ভিতর কী’ ১৮১২ সালে লেখা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্প ‘কাবুলিওয়ালা’য় ছোট্ট মিনি যেভাবে কথা বলেছিল আফগানিস্তানের কাবুলের অধিবাসী এই মানুষগুলোর সঙ্গে, আজ এতকাল পরে সেই সুর ও স্বর কি ফিরে এল আবার! ধানমন্ডির দৃক গ্যালারিতে আমাদের চারপাশে যখন দেখতে পাচ্ছি অসংখ্য কাবুলিওয়ালা—ফ্রেমে ফ্রেমে কাবুলিওয়ালাদের অজস্র ছবি, এমন ভাবনা তখন অপ্রাসঙ্গিক মনে হয় না মোটেও। গল্পে রবিঠাকুর কাবুলিওয়ালার যে বর্ণনা দিয়েছেন: ‘ময়লা ঢিলা কাপড় পরা, পাগড়ি মাথায়, ঝুলি ঘাড়ে, হাতে গোটা দুই-চার আঙুরের বাক্স’, সেই বর্ণনার সঙ্গে এখানে আমাদের দেখা কাবুলিওয়ালাদের অমিল বেশ খানিকটা। যেমন, তাঁদের মাথায় পাগড়ি থাকলেও ঢিলা পরিচ্ছেদের কোথাও নেই ‘ময়লা’র চিহ্ন। ঘাড়ে দেখতে পাওয়া গেল না ঝুলি। এমনকি হাতে দেখতে পেলাম না আঙুরের বাক্সও। এখনকার কাবুলিওয়ালাদের যেসব ছবি দেখলাম আমরা, সেখানে কী ভাসল তবে?
মোস্কা নাজিব ও নাজেস আফরোজের ‘কাবুল থেকে কলকাতা: সম্পদ, স্মৃতি ও পরিচয়’ শিরোনামের আলোকচিত্র প্রদর্শনীতে আমরা দেখলাম দেশহীন ক্ষয়মান এক সম্প্রদায়কে। গ্যেটে ইনস্টিটিউটের আয়োজনে ২৪ এপ্রিল প্রদর্শনীটি শুরু হয়েছে দৃক গ্যালারিতে।
কাবুলিওয়ালাদের আলোকচিত্রের এই সমাহার নিছক একটি প্রদর্শনী না থেকে হয়ে উঠেছে প্রায় এক ‘কনসেপচ্যুয়াল ওয়ার্ক’। উপরন্তু এই কাজের মধ্য দিয়ে দুই আলোকচিত্রীর অন্যতম মোস্কা নাজিব সংযুক্ত হতে চেয়েছেন নিজের জন্মভূমি আফগানিস্তানের সঙ্গে। প্রদর্শনীর উদ্বোধনী পর্বে এই নারী আলোচিত্রশিল্পী যখন বললেন, ‘কাবুলিওয়ালি হিসেবে আমি গর্বিত’, কথার মর্ম প্রথমে ঠিকঠাক বুঝিনি আমরাও। পরে জানা গেল, মোস্কা নাজিব এখন ভারতের নাগরিক, কাজ করছেন সিঙ্গাপুরে, কিন্তু তাঁর জন্মভূমি আফগানিস্তান। মুজাহিদিনরা কাবুল দখলের আগে তাঁর বাবা নাজিবুল্লাহ ছিলেন আফগানিস্তানের শেষ রাষ্ট্রপতি। ১৯৯৬ সালে তালেবানরা কাবুলের রাজপথে নির্মমভাবে হত্যা করে তাঁকে। মোস্কার কথায়ও মিলল জন্মভূমির সঙ্গে বন্ধন গড়ার সুর, ‘অন্য ভূখণ্ডে বাস করেও কাবুলিওয়ারা যেভাবে শতবর্ষ ধরে বাঁচিয়ে রেখেছে তাঁদের সংস্কৃতি, এ কাজের মাধ্যমে আমি তেমনি দেশের সঙ্গে আমার সম্পর্কটাকে বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছি।’

কাবুলিওয়ালাদের জীবনছবি ধরে রাখতে গিয়ে দুই আলোকচিত্রী মোস্কা নাজিব ও নাজেস আফরোজের খাটুনিও কম হয়নি—তিন বছর ধরে পার্ক স্ট্রিটসহ চষে বেড়িয়েছেন কলকাতার নানা অলিগলি, কাবুলিওয়ালাদের এন্তার ছবি তুলেছেন তাঁরা। কেবল ছবি তোলা নয়, দেখেছেন তাঁদের জীবনযাপন ও বদলে যাওয়ার ধরনগুলো। তাই প্রতিটি ছবিরই আছে ভিন্ন ভিন্ন গল্প। তবে গল্প ভিন্ন হলেও মূল সুর কিন্তু এক তারে বাঁধা: ছবির পর ছবিতে আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে এক অভিবাসী সম্প্রদায়ের মুখচ্ছবি। এঁদের বসতি এখন কলকাতায় হলেও তাঁদের কাছে ‘দেশ’-এর অর্থ ভিন্ন, দেশ বলতে আজও তাঁরা আফগানিস্তানকেই বোঝেন, বারবারই ফিরতে চান শিকড়ে—আফগানিস্তানে; বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, এখন আর আফগানিস্তানেরও নাগরিক নন এই কাবুলিওয়ালারা। ফলে তাঁদের ভেতর যে শিকড়চ্যুতি, তাদের কল্পনা ও বাস্তবতার মধ্যে যে ফারাক—প্রতিটি ছবিতে স্পষ্ট সেই চিহ্ন। ‘নতুন বাড়িতে পুরোনো চাল’ নামের ছবি সম্পর্কে বলি: এখানে কাবুলিওয়ালাদের ঘরের ভেতর কার্পেট পেতে রাখার দৃশ্য আমাদের মনে করিয়ে দেয় রং বাহারি কার্পেট দিয়ে বাসস্থান সাজানো তো আফগানদের সাধারণ রীতি। আবার ‘লোটা বাটি কম্বল’ শীর্ষক আলোকচিত্রের ফ্রেমে দেখা যাচ্ছে কেবল গুটিকয় দ্রব্য—কাবুলি জুতা, চিলমচি ও চায়ের গ্লাস। এভাবেই কি ভিন দেশের বাস্তবতায় তাঁরা গড়ে তুলছেন, পেয়ে যাচ্ছেন তাঁদের কল্পিত দেশের স্বাদ!
আরেকটি ছবিতে আছে এক কাবুলিওয়ালার অবয়ব—জন্ম ভারতে, কখনো যাননি কাবুল। কিন্তু নিজের মায়ের কাবুলি পোশাকটির মধ্যেই যেন তিনি খুঁজে পাচ্ছেন কাবুলের অস্তিত্ব ও অনুভব। মায়ের কাবুলি গাউনটি হাতে নিয়ে উচ্ছ্বসিত ভঙ্গিতে তাই তো দাঁড়িয়েছেন আয়নার সামনে। আয়নায়ও ফুটে উঠেছে পোশাক হাতে কাবুলিওয়ালার সেই প্রতিচ্ছবি।
থরে-বিথরে ছবিতে ছবিতে এভাবে যেমন রয়েছে কাবুলিওয়ালার স্মৃতি, আত্মপরিচয় অন্বেষণ ও দেশ-ভাবনা, একইভাবে প্রয়োজনের তাগিদে তাঁরা যে অন্য সংস্কৃতি এবং ভিন্ন জীবিকাকে মেনে নিয়েছেন—এটিও ধরা পড়েছে গাঢ় কালিতে। প্রদর্শনীর দু-একটি আলোকচিত্র লিখেছে একটিই কথা—এসেছে নতুন প্রেক্ষাপট, কাবুলিওয়ালারা ছেড়েছেন পুরোনো জীবিকা। তাই কোনো ছবিতে তাঁদের পেলাম দরজির দোকানে কর্মরত, আবার কোনো চিত্রে কাবুলিওয়ালা, মানে এককালের রহমতদের খুঁজে পাওয়া গেল ট্যাক্সিচালক হিসেবেও। ‘মিনির কাবুলিওয়ালা’ নামের ছবিতে বাঙালি বিয়ের আসরেও দেখা গেল কাবুলিওয়ালার হাস্যময় মুখ।
সব মিলিয়ে ছবিগুলোতে আছে এক বিচিত্র জনগোষ্ঠী ও তাঁদের জীবনের বারো রকম গল্প—তাঁদের স্বপ্ন ও বাস্তবতার মধ্যকার বৈপরীত্য। তাই এই আলোকচিত্রগুলোতে শিল্পমূল্যের চেয়ে যেনবা কাবুলিওয়ালাদের জীবন ও বাস্তবতার অনুসরণই বড় হয়ে দেখা দেয় শেষ অবধি। তবে নান্দনিকতার বিচারে বসলে এই বিস্তর চিত্র সমারোহের বেশ কয়েকটিতেই ঝকমকিয়ে ওঠে সোনা-রূপা।
রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পে মিনি যে প্রশ্ন করেছিল, কাবুলিওয়ালার ঝুলির ভেতরে কী? প্রদর্শনীর ছবিগুলো দেখার পর প্রশ্নটি দোল খায় আমাদের মনেও। তখন মনে মনেই উত্তরটি বলে ফেলি আমরা: কাবুলিওয়ালার ঝুলির ভেতর আছে অদৃশ্য বিচিত্র এক মিশ্র অভিজ্ঞতা, যার কিছুটা বাস্তব আর কিছুটা কল্পনায় গড়ে ওঠা। ঢাকার আগে কাবুল ও দিল্লিতেও চলেছে ‘কাবুল থেকে কলকাতা: সম্পদ, স্মৃতি ও পরিচয়’ শিরোনামের এ প্রদর্শনী। এরপর যাবে কলকাতায়। এখানে প্রতিদিন বিকেল তিনটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত চলমান এই প্রদর্শনীটি শেষ হবে ৬ মে।