তিন পাগলের মেলা

তাঁরা অসামান্য বাঙালি মনীষা—লালন সাঁই, কাঙাল হরিনাথ মজুমদার, মীর মশাররফ হোসেন। জন্মেছিলেন কাছাকাছি সময়ে সাবেক নদীয়ার কুষ্টিয়ায়। তিন ব্যক্তিত্বই গভীর প্রভাব রেখেছেন বাংলার মননে ও সমাজে। তাঁদের তিনজনের পারস্পরিক সম্পর্ক আর সংযোগের অনবদ্য গল্প

লালন সাঁই (১৭৭৪—১৮৯০) ভাবের ঘোরে গান বেঁধেছিলেন: ‘তিন পাগলে হলো মেলা নদে এসে’। কারা সেই পাগল, তার জবাবে লালন বলেন: ‘ও সে চৈতে নিতে অদ্বে পাগল নাম ধরেছে’। ‘চৈতে’ মানে শ্রীচৈতন্য, আর ‘নিতে’ ও ‘অদ্বে’ সেই চৈতন্যের দুই প্রধান পার্ষদ নিত্যানন্দ ও অদ্বৈতাচার্য। গুরু-শিষ্যের সম্মিলনে জাতপাতহীন এক অভিনব প্রেমধর্মের জোয়ারে সেদিন ভেসেছিল নদীয়া।

কয়েক শতাব্দী পরে সেই নদীয়ারই এক প্রান্তে কুষ্টিয়া-সংলগ্ন কুমারখালী অঞ্চলে আবির্ভাব ঘটেছিল ফকির লালন সাঁইয়ের। এই মহৎ মহাজনও মানবপ্রেমের এক মরমি ভুবন নির্মাণ করেছিলেন বাউল সাধনার সুবাদে। নানা সূত্রে তাঁর সঙ্গে যোগ ঘটেছিল তাঁর নিকট-পড়শি কুমারখালীর কাঙাল হরিনাথ মজুমদার (১৮৩৩—১৮৯৬) ও লাহিনীপাড়ার মীর মশাররফ হোসেনের (১৮৪৭—১৯১১)। শিষ্য না হয়েও তাঁরা তাঁর শিষ্য ছিলেন। চৈতন্যের সঙ্গে যেমন নিত্যানন্দ-অদ্বৈতাচার্যের, তেমনি লালনের সঙ্গে গড়ে উঠেছিল এক নিবিড় ঐক্য ও সুভাব কাঙাল ও মশাররফের।

লালন সাঁই (১৭৭৪—১৮৯০)
লালন সাঁই (১৭৭৪—১৮৯০)

আরশিনগরের পড়শি
‘বাউল’—এ কথাটির সঙ্গে সব বাঙালিরই কমবেশি পরিচয় আছে। বাউলের সাধনা বা তত্ত্ব-দর্শনের চেয়ে বাউলের গানের প্রতিই আমজনতার ঝোঁক বেশি। বাংলা চিরকালই গানের দেশ—আর কিছুটা ভাবের, মন-উদাস করা, মরমি চেতনার গান বাঙালিকে একটু বেশি টানে। বহুকাল ধরেই তাই বাঙালি সমাজে বাউল আর তার গানের আদর-কদর। লালন ফকিরকেই এই বাউলগানের শ্রেষ্ঠ পদকর্তা ও বাউলতত্ত্বের প্রধান ভাষ্যকার হিসেবে গণ্য করা হয়। লালনের গান আজ তাই দুই শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে বাঙালির মরমি-মানসের অধ্যাত্মক্ষুধা ও রসতৃষ্ণা মিটিয়ে আসছে।

কালজয়ী এই যে সাধক-পদকর্তা, তাঁর জীবনকাহিনি কিন্তু রহস্যে আচ্ছন্ন। জাত-ধর্ম-জন্ম সম্পর্কে তিনি উদাস ও নির্লিপ্ত ছিলেন—পূর্বাশ্রমের কোনো কথাতেই তাঁর কোনো আগ্রহ ছিল না। তবুও যখন সমকালের নাছোড় মানুষ তাঁর জাত-ধর্মের পরিচয় জানার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে, তখন তিনি কোমল কণ্ঠে জবাব দিয়েছেন, ‘আমার আমি না জানি সন্ধান।’ মীর মশাররফ হোসেন-সম্পাদিত পাক্ষিক হিতকরী পত্রিকায় (৩১ অক্টোবর ১৮৯০) এ বিষয়ে বলা হয়, ‘ইঁহার জীবনী লিখিবার কোন উপকরণ পাওয়া কঠিন। নিজে কিছুই বলিতেন না। শিষ্যেরা হয়তো তাঁহার নিষেধক্রমে না হয় অজ্ঞতাবশতঃ কিছুই বলিতে পারে না।’ তবে নানা ফাঁকফোকর গলে এই তথ্যটুকুর সন্ধান মেলে যে, লালনের জন্ম কুমারখালীর অন্তর্গত ভাঁড়ারা গ্রামে এক কায়স্থ কর-পরিবারে। ১৮৯০-এ লালনের মৃত্যু হয়, এ খবর দিয়ে হিতকরী উল্লেখ করে মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ১১৬। এই বয়স আমলে নিয়ে হিসাব করে দেখা যায়, তাহলে তাঁর জন্মের বছর হয় ১৭৭৪।

জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা লালন সাঁই, ৫ মে ১৮৮৯। ছবি: সংগৃহীত
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা লালন সাঁই, ৫ মে ১৮৮৯। ছবি: সংগৃহীত

তাঁর জীবনকাহিনি অনেকটাই নাটকীয় বিন্যাসে রচিত। যৌবনের প্রথম পর্বে প্রতিবেশীদের সঙ্গে দূরদেশে গঙ্গাস্নান বা তীর্থভ্রমণে যান। ফেরার পথে গুরুতর বসন্ত রোগে আক্রান্ত হন। সঙ্গীরা তাঁকে অন্তর্জলি করে বা মৃত ভেবে নদীর জলে ভাসিয়ে দেয়। ভাসতে ভাসতে কালীগঙ্গার ঘাটে এসে ভেড়ে অচৈতন্য লালনের দেহ। ছেঁউড়িয়া গ্রামের এক তন্তুবায় মুসলমান রমণীর কল্যাণে লালন ঠাঁই পান তাঁর গৃহে। এই পরিবারের আন্তরিক সেবা-যত্নে লালন সেরে ওঠেন। এরপর ‘মৃত’ লালন স্বজন-সমীপে হাজির হন। কিন্তু শাস্ত্র ও ধর্মের দোহাই মেনে সমাজ ও সংসার তাঁকে গ্রহণ করে না। লালন ফিরে আসেন। এরপর শুরু হয় তাঁর জীবনের নতুন পর্ব। সিরাজ সাঁইয়ের কাছে বাউলমতে দীক্ষা নেন। ছেঁউড়িয়ার কারিকর সম্প্রদায়ের সৌজন্যে ওই গ্রামেই আখড়া বেঁধে শুরু করেন সাধকজীবন। কালে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ে বৃহত্তর বাংলা মুলুকে। হিতকরী পত্রিকা জানাচ্ছে, ‘লালন ফকীরের নাম এ অঞ্চলে কাহারও শুনিতে বাকী নাই। শুধু এ অঞ্চলে কেন, পূর্ব্বে চট্টগ্রাম, উত্তরে রঙ্গপুর, দক্ষিণে যশোহর এবং পশ্চিমে অনেক দূর পর্য্যন্ত বঙ্গদেশের ভিন্ন ভিন্ন স্থানে বহুসংখ্যক লোক এই লালন ফকীরের শিষ্য; শুনিতে পাই ইহার শিষ্য দশ হাজারের উপর।’ সেই সময়ের নিরিখে লোকসংখ্যার অনুপাতে তাঁর শিষ্যের এই সংখ্যা তাঁর গুরুত্ব ও জনপ্রিয়তার প্রমাণ দেয়।

বাউলের শাস্ত্র নেই—নেই কোনো অনুশাসন—গানই তাঁর উপাসনা-সাধনার বিধিবিধান। তাই লালনেরও জীবনবেদ ছিল তাঁর গান। সাধনার গোপন পন্থা-পদ্ধতি কেবল দীক্ষিত শিষ্য-শাবকের মধ্যে প্রচারের উদ্দেশ্যেই এই গানের জন্ম। শিল্পসৃষ্টির সচেতন প্রয়াস এখানে অনুপস্থিত। লালনও তাই বিশুদ্ধ শিল্প-প্রেরণায় গান বাঁধেননি, বিশেষ উদ্দেশ্য-সংলগ্ন হয়েই এই গানের সৃষ্টি। তবে প্রয়োজনকে ছাপিয়ে লালনের গান অনায়াসে শিল্পের সাজানো বাগানে প্রবেশ করেছে স্বমহিমায়। তাঁর গান তাই একাধারে সাধনসংগীত, দর্শনকথা ও শিল্পশোভিত কাব্যবাণী। লালন তাঁর দীর্ঘজীবনে কত গান রচনা করেন, তার সঠিক হিসাব মেলা ভার। এখন উদ্দেশ্য-সাধন ও অনধিকারচর্চার জেরে লালনের জাল-নকল-বিকৃত গানে সয়লাব হয়ে গেছে সব। লালনের মনে গানের ভাব এলে তিনি ‘ওরে আমার পোনা মাছের ঝাঁক এসেছে’ বলে শিষ্যদের ডেকে নিয়ে গান জুড়তেন। মুখে মুখে গান রচনা করতেন, আর তাঁর শিষ্যদের মধ্যে কেউ কেউ সে গান খাতায় লিখে রাখতেন। লালনের গানের প্রধান লিপিকর ছিলেন তাঁর প্রিয় শিষ্য ফকির মনিরুদ্দীন শাহ। সে রকম একজোড়া খাতা রবীন্দ্রনাথ ছেঁউড়িয়ার লালন-আখড়া থেকে সংগ্রহ করেন, যা এখন বিশ্বভারতীর রবীন্দ্রভবনে আছে।

লালনের গানের একান্ত অনুরাগী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেই গান তিনি সংগ্রহ ও প্রকাশও করেছেন। এই সাধকের গানের ছন্দশৈলীর প্রশংসা ও তাঁর মানবিক আবেদনকেও রবীন্দ্রনাথ সংবর্ধনা জানিয়েছেন। লালনের গানের ভাব-ভাষা-ভাবনায় প্রাণিতও হন তিনি এবং তাঁর কিছু গানে সেই ছাপ ফুটে উঠেছে। রবীন্দ্রনাথ যে নিজেকে ‘রবীন্দ্রবাউল’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন তার পেছনেও ছিল মূলত লালনেরই প্রভাব। কিন্তু লালনের সঙ্গে তাঁর দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছিল কি না, সে-সম্পর্কে স্পষ্ট কিছু জানা যায় না। তবে ঠাকুর-পরিবারের কারও কারও সঙ্গে লালনের আলাপ-পরিচয় ছিল। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৮৯ সালের ৫ মে শিলাইদহে পদ্মা নদীর ওপর বোটে বসিয়ে লালনের একটি রেখাচিত্র এঁকেছিলেন, এই সাধকের মৃত্যুর প্রায় বছর দেড়েক আগে। সমকালীন আরও কিছু খ্যাতিমান মানুষের সঙ্গে লালনের আলাপ-পরিচয়-ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল—তাঁদের মধ্যে কাঙাল হরিনাথ ও মীর মশাররফের নাম আগেই বলেছি।

কাঙাল হরিনাথ মজুমদার (১৮৩৩—১৮৯৬)
কাঙাল হরিনাথ মজুমদার (১৮৩৩—১৮৯৬)

কাঙাল-কথামৃত
কাঙাল হরিনাথ মজুমদার উনিশ শতকের এক স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। নিভৃত পল্লিতে বসে সংস্কৃতিচর্চার যে দৃষ্টান্ত তিনি স্থাপন করেছিলেন তা বিস্ময় জাগায় মানুষের মনে। এই বহুমাত্রিক মানুষটি একাধারে ছিলেন সাহিত্যসাধক, সাময়িকপত্র-পরিচালক, সমাজসংস্কারক, ধর্মবেত্তা ও নব্য-সাহিত্যসেবীদের উদার পৃষ্ঠপোষক। একদিকে বিজয়বসন্ত উপাখ্যানের রচয়িতা ও বাউলগানের পদকর্তা হিসেবে তিনি সাহিত্য খ্যাতি অর্জন করেন, অপরদিকে গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা পত্রিকার মাধ্যমে জমিদার-মহাজন-নীলকরের অত্যাচার-অবিচার-শোষণের বিরুদ্ধে তাঁর ছিল সাহসী সামাজিক ভূমিকা।
হরিনাথের জন্ম কুমারখালী তিলি মজুমদার-বংশের এক দরিদ্র-শাখায়। ছেলেবেলায় মা-বাবাকে হারিয়ে নিদারুণ দারিদ্র্য ও দুঃখ-কষ্টের ভেতর দিয়ে তাঁর জীবন শুরু। অন্ন-বস্ত্র-আশ্রয়ের অভাব তাঁকে শৈশবেই ‘কাঙাল’ করেছিল। এই কারণে তাঁর উপযুক্ত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভ হয়নি। ব্রাহ্মসমাজ ও কবি ঈশ্বর গুপ্তের সংবাদ প্রভাকর পত্রের সৌজন্যে তাঁর যেটুকু ‘ভাষাজ্ঞান’ হয় তা তাঁর শিক্ষকতা, সাহিত্যচর্চা ও সাময়িকপত্র-সম্পাদনার কাজে খুব সহায়ক হয়েছিল। তাঁর এক প্রিয় সাহিত্যশিষ্য জলধর সেন বলেছেন, ‘কোনদিন কোন বিদ্যালয়ে লেখাপড়া না শিখেও কাঙ্গাল হরিনাথ অদ্বিতীয় সাহিত্যিক ও অশেষ শাস্ত্রজ্ঞ হয়েছিলেন।’ স্বশিক্ষিত এই সাহিত্যসাধক সম্পর্কে এটি খুব খাঁটি কথা।
হরিনাথের শেষজীবন অজ্ঞাতবাসের কাল। প্রায় সমাজবিচ্ছিন্ন হয়ে সাধনমার্গে তাঁর জীবনের বাকি দিনগুলো কাটে। আর্থিক, শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হরিনাথ সমাজ-সংসার সম্পর্কে অনেকখানিই বীতস্পৃহ হয়ে পড়েন। ৫ বৈশাখ ১৩০৩ কাঙালের মৃত্যু হয়। মৃত্যুর সামান্য আগে জগৎ ও জীবন সম্পর্কে তাঁর উপলব্ধির অন্তিম-ভাষ্য রচনা করেন:
আগেও উলঙ্গ দেখ, শেষেও উলঙ্গ।
মধ্যে দিন দুইকাল বস্ত্রের প্রসঙ্গ।।
মরণের দিন দেখ সব ফক্কিকার।
তবে কেন মূঢ় মন কর অহঙ্কার।।...
পুঁথি পড়, পাঁজি পড় কোরান পুরাণ।
ধর্ম্ম নাই এ জগতে সত্যের সমান।।...

কাঙাল হরিনাথের পত্রিকা গ্রামবার্ত্তা প্রবেশিকা
কাঙাল হরিনাথের পত্রিকা গ্রামবার্ত্তা প্রবেশিকা

জগৎ পরাধীন, মন স্বাধীন
মীর মশাররফ হোসেন উনিশ শতকের একজন মান্য লেখক। আধুনিক বাংলা সাহিত্যে মুসলিম-প্রয়াসের সার্থক সূচনা তাঁকে দিয়েই। সব্যসাচী শিল্পী-ব্যক্তিত্ব মশাররফ ছিলেন দীর্ঘ সামাজিক-ঘুম থেকে জেগে ওঠা মুসলিম মধ্যশ্রেণির প্রধান সাংস্কৃতিক মুখপাত্র। তাঁর রচনার বিষয়-বৈচিত্র্য, প্রকাশ-নৈপুণ্য, সমাজ-মনস্কতা, অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও অকপট স্বীকারোক্তি তাঁকে লেখক হিসেবে একটি আলাদা মহিমা ও মর্যাদা দিয়েছে।
মশাররফ জন্মেছিলেন কুমারখালীর লাহিনীপাড়া গ্রামের এক ক্ষয়িষ্ণু সামন্ত পরিবারে। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আমোদ-প্রমোদে মগ্ন থাকায় প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়াটা তেমন হয়নি। তবে কাঙাল হরিনাথের গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা ও কবি ঈশ্বর গুপ্ত-প্রতিষ্ঠিত সংবাদ প্রভাকর-এর সুবাদে লেখালেখি ও সাংবাদিকতার হাতেখড়ি হয়। ১৮৬৫ থেকে ১৯১০ সাল, প্রায় ৪৫ বছর মশাররফের শিল্পসৃষ্টির সময়কাল। এই দীর্ঘসময়ে তাঁর সাহিত্যসাধনার ফসল কম নয়। গদ্য-পদ্য মিলিয়ে তাঁর পঁচিশখানা প্রকাশিত বইয়ের সন্ধান পাওয়া যায়। এ ছাড়া আছে বেশ কিছু অপ্রকাশিত, অসমাপ্ত ও অগ্রন্থিত রচনা। পত্রপত্রিকা সম্পাদনাতেও তাঁর উদ্যোগ ছিল, তার দৃষ্টান্ত আজীজন নেহারহিতকরী। উপন্যাস বিষাদ-সিন্ধু ও নাটক জমীদার দর্পণ তাঁর কালজয়ী রচনা। মশাররফ তাঁর লেখার জন্যে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, অক্ষয়চন্দ্র সরকার, কাঙাল হরিনাথ, অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, জলধর সেনের প্রশংসা পেয়েছেন। সেকালের পত্রপত্রিকায় তাঁর গদ্যভাষা বিশেষ স্বীকৃতি ও সমাদর পায়—কোনো কোনো পত্রিকা এ রকম মন্তব্যও করে যে, মশাররফের মতো এমন স্বাদু বাংলা বাঙালি হিন্দু লিখতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করবে।
মুসলমান সমাজে মশাররফ ছিলেন ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রথম প্রবক্তা। ১৮৭৪ সালে মশাররফ তাঁর আজীজন নেহার পত্রিকায় স্পষ্টই ঘোষণা করেছিলেন: ‘আমরা মুক্তকণ্ঠে সংবাদপত্রে স্বীকার করিয়াছি, আমরা বাঙ্গালী, বাঙ্গালা আমাদের মাতৃভাষা...। কোন দেশে পুরুষানুক্রমে বাস করিয়া তদ্দেশীয় বলিয়া পরিচয় দেওয়া দেশীয় ভাষা ব্যবহার করা অবমাননার বিষয় নহে...।’

‘জগৎ পরাধীন, মন স্বাধীন’—মশাররফের এই উপলব্ধি আরও সত্য ও তাৎপর্যময় হয়ে উঠেছে জাতিত্ব-স্বদেশ-মাতৃভাষার প্রশ্নকে সামনে রেখে।

লালন ও কাঙাল: সম্পর্কের খতিয়ান

উনিশ শতকের দুই প্রধান গ্রামীণ ভাবুক—লালন ও কাঙালের মধ্যে যে সখ্য-সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তা ছিল কীর্তিময় এক সহমর্মিতা ও মৈত্রীর স্মারক। লালন-আবিষ্কারে হরিনাথের ভূমিকা যেমন পথিকৃতের, তেমনি হরিনাথের অন্তর্জগতের পরিবর্তন, মরমি ভাবনায় সমর্পণ ও সেই সূত্রে বাউলগান রচনার মূলে রয়েছে লালন সাঁইয়ের একান্ত প্রভাব। একদিকে লালন যেমন হরিনাথের মনে মরমি ও অধ্যাত্ম-চেতনার বীজ বপন করেছিলেন, অপরদিকে কাঙালের বিপন্ন সময়ে তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে লালন আন্তরিক বন্ধুকৃত্য ও সামাজিক কর্তব্যও পালন করেছিলেন।

বাঙালির লোকচৈতন্যে লালনের নাম ধ্রুবতারার ঔজ্জ্বল্যে দীপ্তিমান, কিংবদন্তির মতো প্রচারিত তাঁর নাম-পরিচয়। তাঁর জীবৎকালেই তিনি বাংলার বিদ্বৎসমাজের মনোযোগ আকর্ষণে সক্ষম হয়েছিলেন। তাই তাঁর সমকালেই তাঁকে নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত এবং তাঁর গান সংগ্রহ ও প্রকাশের উদ্যোগ গৃহীত হয়। কাঙাল হরিনাথের রচনাতেই প্রথম লালন সাঁইয়ের কথা জানা যায়। সাপ্তাহিক গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকায় (ভাদ্র ১ম সপ্তাহ ১২৭৯) ‘জাতি’ শীর্ষক এক সংবাদ-নিবন্ধে লালন ফকিরের উল্লেখ মেলে। গ্রামবার্ত্তার নিবন্ধকার লিখেছেন, ‘সকলেই ব্রাহ্ম ও ধর্ম্মসভার নাম শুনিয়াছেন। গৌরসভা নামে নিম্নশ্রেণীর লোকেরা আর এক সভা স্থাপন করিয়াছেন।...লালন শাহ নামে এক কায়স্থ আর এক ধর্ম্ম আবিষ্কার করিয়াছে। হিন্দু-মুসলমান সকলেই এই সম্প্রদায়ভুক্ত।... ৩/৪ বৎসরের মধ্যে এই সম্প্রদায় অতিশয় প্রবল হইয়াছে। ইহারা যে জাতিভেদ স্বীকার করে না সে কথা বলা বাহুল্য। এখন পাঠকগণ চিন্তা করিয়া দেখুন, এ দিকে ব্রাহ্মধর্ম্ম জাতির পশ্চাতে খোঁচা মারিতেছে, ওদিকে গৌরবাদিরা তাহাকে আঘাত করিতেছে, আবার সে দিকে লালন সম্প্রদায়িরা, ইহার পরেও স্বেচ্ছাচারের তাড়না আছে। এখন জাতি তিষ্ঠিতে না পারিয়া, বাঘিনীর ন্যায় পলায়ন করিবার পথ দেখিতেছে।’ লক্ষ করা যায়, এই নিবন্ধে প্রসঙ্গক্রমে দৃষ্টান্ত হিসেবে লালনের কথা উঠেছে এবং লেখকের মন্তব্য প্রশংসাসূচক ছিল না।

এর প্রায় ১৩ বছর পর কাঙাল হরিনাথের লেখায় আবার লালনের প্রসঙ্গ আসে। হরিনাথের ব্রহ্মা-বেদ (প্রথম ভাগ ১ম সংখ্যা: ১২৯২) গ্রন্থে তিনি লালনের একটি গান (‘কে বোঝে সাঁইয়ের লীলাখেলা’) সম্পূর্ণ উদ্ধৃত করেন। ব্রহ্মা-বেদ-এর তৃতীয় ভাগ ষষ্ঠ সংখ্যায় (১২৯৭) লালনের এই গানটির সুরে বাঁধা তাঁর নিজের কয়েকটি গানের উদ্ধৃতি দেন। হরিনাথের এই ব্রহ্মা-বেদ-এই (দ্বিতীয় ভাগ ১ম সংখ্যা) চুম্বক-মন্তব্যে পাওয়া যায় লালন সাঁইয়ের কয়েক পঙ্‌ক্তির অতি সংক্ষিপ্ত পরিচিতি। এখানে যোগতত্ত্বের আলোচনা-প্রসঙ্গে এক উপপাদটীকায় হরিনাথ লালন সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন: ‘নূরনবী হজরৎ মহম্মদের পরে মোশল্মানকুলে (মুসলমান কুলে) আর কোন ভক্ত জন্মগ্রহণ করেন নাই, কেহ পাছে এরূপ মনে করেন, সেই আশঙ্কায় আমরা বলিতেছি যে, মহম্মদের পর অনেক ভক্ত মোশল্মানকুল পবিত্র করিয়াছিলেন। অনেক ভক্ত ফকীরের বৃত্তান্ত অনেকেই অবগত আছেন।...নদীয়া জেলার অন্তর্গত কুষ্টিয়া বিভাগের নিকটবর্ত্তী ঘোড়াই গ্রামে লালন সাঁই নামে যে ফকীর বাস করেন, তিনিও পরমভক্ত যোগী। তাঁহার গুরু সিরাজ সাঁই সিদ্ধযোগী ছিলেন।’

এখানে হয়তো অসতর্কতা বা অজ্ঞতার ফলে গ্রামের নাম ‘ছেঁউড়িয়া’র জায়গায় ‘ঘোড়াই’ হয়েছে। নানা সূত্র থেকে জানা যায়, হরিনাথের অপ্রকাশিত দিনলিপিতেও তাঁর বিপন্ন দিনের সহায় লালন ফকিরের উল্লেখ আছে। লালনচর্চার সূচনা কাঙাল হরিনাথের হাতেই হয়েছিল—এ বিষয়ে তাঁকেই পথিকৃতের মর্যাদা দিতে হয়।

হিতকরী পত্রিায় লালনকে নিয়ে প্রবন্ধ। সংগৃহীত
হিতকরী পত্রিায় লালনকে নিয়ে প্রবন্ধ। সংগৃহীত

কাঙাল হরিনাথ ও লালন সাঁইয়ের জন্ম একই অঞ্চলে। হরিনাথ জন্মেছিলেন কুমারখালীতে, আর লালনের জন্মও এই কুমারখালীরই অন্তর্গত গড়াই নদীর অপর পাড়ে ভাঁড়ারা গ্রামে। এই যে কাছাকাছি অবস্থান, তা দুজনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রচনায় একটি সহায়ক ভূমিকা রেখেছিল। স্থানিক নৈকট্য ছাড়াও লালন ও কাঙালের সাদৃশ্য ছিল দারিদ্র্যের—নিদারুণ দারিদ্র্যের মধ্যে থেকেও তাঁরা মহৎ জীবনের অন্বেষণ করেছেন। আর পথ ও পন্থা ভিন্ন হলেও উভয়েই ছিলেন পার্থিব আকাঙ্ক্ষামুক্ত মানবমিলন-প্রয়াসী লোকায়ত সাধনপথের মরমি পথিক। এ ক্ষেত্রে দুজনেরই ‘অমোঘ অস্ত্র’ ছিল তাঁদের গান—সে গান কেবল দেহতত্ত্বের নয়, মানবতত্ত্বেরও—জীবনসত্যের অনুষঙ্গে ভাবসাধনার গান।
কোন প্রেক্ষাপটে কোন সময়ে লালনের সঙ্গে কাঙালের প্রথম পরিচয়, সে ইতিহাস অজ্ঞাত। তবে দুজনের পরিচয় যে দিন গড়িয়ে ঘনিষ্ঠতায় পরিণত হয়, নানা ঘটনায় তা বেশ জানা যায়। সেই অন্তরঙ্গতার টানেই লালন মাঝেমধ্যে কুমারখালীতে কাঙাল-কুটিরে আসতেন। অপরদিকে কাঙালও গিয়ে আসর জমাতেন ছেঁউড়িয়ায় লালনের আখড়ায়। একদিন লালন কাঙাল-কুটিরে এসে সংগীত পরিবেশনের পর হরিনাথের অনুরাগীদের মনে তা গভীরভাবে দাগ কাটে। কাঙাল-শিষ্য জলধর সেন এই ঘটনার এক আন্তরিক বিবরণ দিয়েছেন তাঁর কাঙাল-জীবনীতে (কাঙ্গাল হরিনাথ, ১ম খণ্ড, ১৩২০): ‘সে দিন প্রাতঃকালে লালন ফকির নামক একজন ফকির কাঙ্গালের সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিয়াছিলেন। লালন ফকির কুমারখালীর অদূরবর্ত্তী কালীগঙ্গার তীরে বাস করিতেন। তাঁহার অনেক শিষ্য ছিল। তিনি কোন্ সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন তাহা বলা বড় কঠিন, কারণ তিনি সকল সম্প্রদায়ের অতীত রাজ্যে পৌঁছিয়াছিলেন। তিনি বক্তৃতা করিতেন না, ধর্ম্মকথাও বলিতেন না। তাঁহার এক অমোঘ অস্ত্র ছিল—তাহা বাউলের গান। তিনি সেই সকল গান করিয়া সকলকে মুগ্ধ করিতেন।...সেই লালন ফকির কাঙ্গালের কুটীরে, আমরা যে দিনের কথা বলিতেছি, সেই দিন আসিয়াছিলেন এবং কয়েকটী গান করিয়াছিলেন। সব কয়টী গান আমার মনে নাই; একটি গান মনে আছে। যথা—
আমি একদিনও না দেখিলাম তারে;
আমার ঘরের কাছে আরসী-নগর,
তাতে এক পড়সী বসত করে।...’
লালনের এই গানের প্রেরণাতেই অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়র মনে একটি ‘বাউলের দল’ গঠনের চিন্তা আসে। এই প্রস্তাবে উৎসাহিত হয়ে ওঠেন কাঙালের শিষ্যদল এবং সঙ্গে সঙ্গেই তা বাস্তবায়নের জন্যে ‘ফিকিরচাঁদ’ ভণিতা যোগ করে গান রচিত হয়, ‘ভাব মন দিবানিশি, অবিনাশি, সত্য-পথের সেই ভাবনা’। গ্রামবার্ত্তা পত্রিকার সহযোগী ও ছাপাখানার কর্মীদের এই অভিনব ‘ফিকির’ হরিনাথের সাগ্রহ অনুমোদনই শুধু লাভ করেনি, কাঙাল নিজেও সেই মুহূর্তেই গান রচনায় হাত দেন। ‘আমি কোরব এ রাখালী কতকাল!/ পালে ছ’টা গরু ছুটে, কোরছে আমায় হাল-বেহাল’, এই হলো কাঙাল-রচিত প্রথম বাউলগান। এরপর হরিনাথের মনে গানের জোয়ার এল, একের পর এক রচিত হতে লাগল অন্তরপ্লাবী মনোহর সব বাউলগান। ‘অবসর সময়ের খেয়াল’ থেকে জন্ম নেওয়া হরিনাথের এই গানে সমগ্র বাংলাদেশ প্লাবিত হয়েছিল—‘সামান্য বীজ’ থেকে জন্মেছিল ‘প্রকাণ্ড বৃক্ষ’। আর এর মূলে ছিল লালন ফকিরের প্রত্যক্ষ প্রভাব ও প্রেরণা। এ থেকে স্পষ্টই বোঝা যায়: ‘...কাঙাল হরিনাথের জীবন-চেতনা বরাবর এক তালে চলেনি, লালন ফকির এসে তার মূলে মোচড় দিয়ে গেছেন।’ (মীর-মানস, মুনীর চৌধুরী, ১৩৭৫)।

মীর মশাররফ হোসেনের হাতের লেখা
মীর মশাররফ হোসেনের হাতের লেখা

লালন পদকর্তা-হরিনাথের মরমি-মানস উদ্বোধনে যেমন মূল ভূমিকা পালন করেছিলেন, তেমনি তাঁর গানের শৈল্পিক উৎকর্ষ-অর্জনের ক্ষেত্রেও পরামর্শক-উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বসন্তকুমার পালের মহাত্মা লালন ফকির বই থেকে জানা যায়: একবার কাঙাল তাঁর কয়েকটি গান লালন সাঁইকে শুনিয়ে এ-সম্পর্কে মতামত জানতে চান। লালন হেসে উঠে জবাব দিলেন, ‘তোমার এ ব্যঞ্জন বেশ হয়েছে, তবে নুনে কিছু কম আছে।’ নুন কম থাকার অর্থ ভাষা কিছু নীরস হয়েছে। লালনের এই মতামত স্মরণে রেখে নিরন্তর চর্চা ও অনুশীলনে কাঙালের গানের ভাষা উত্তরকালে যথেষ্ট হৃদয়গ্রাহী, সরস ও মার্জিত হয়ে উঠেছিল।
বাউলগান রচনায় লালন যে শুধু হরিনাথের প্রেরণাই ছিলেন তা নয়, তাঁর ভাব-ভাষা-ভাবনার একটা প্রভাবও হরিনাথের গানে পড়েছিল। বাউল বা সমানধর্মী মরমি গানের সীমাবদ্ধতা হলো এর বহুল উচ্চারিত তত্ত্বকথা ও গতানুগতিক বিষয়ের অনুবর্তন। তাই পদ রচনা করতে গিয়ে কাঙাল অনিবার্যভাবেই এই সীমাবদ্ধ তত্ত্ব-বিষয়ের মধ্যেই আবর্তিত হয়েছেন এবং এ প্রসঙ্গে পূর্বসূরি লালনের প্রভাব তাঁকে স্বীকার করতে হয়েছে। হরিনাথের পারমার্থিক ও জাত-সম্পর্কিত গানে সে প্রভাব স্পষ্ট। যেমন কাঙালের এই গানটি:
যারা সব জাতের ছেলে,
জাত নিয়ে যাক্ যমের হাতে।
বুঝেছি জাতের ধর্ম,
কর্মভোগ কেবল জেতে।।

এর সঙ্গে সহজেই তুলনীয় লালনের জাত-ধর্ম-সম্পর্কিত গানগুলো। যেমন:

সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে।

লালন বলে জাতের কি রূপ

        দেখলাম না এ নজরে।।

কিংবা এই পদটি:

একবার জগন্নাথে দেখ্ রে যেয়ে,

        জাত কেমন রাখ বাঁচিয়ে।

চণ্ডালে আনিলে অন্ন ব্রাহ্মণে তাই লয় খেয়ে।।

কাঙাল হরিনাথের একটি গানে ‘মনের মানুষ’ অন্বেষণের গভীর আকুতি ফুটে উঠেছে:

এখন, আমার মনের মানুষ কোথা পাই।

যার তরে মনোখেদে প্রাণ কাঁদে সর্বদাই।।

অনুমান করতে বাধা নেই যে, পরম প্রিয়ের সান্নিধ্য-লাভের এই ব্যাকুলতার উৎস হতেই পারে লালনের সমধর্মী কোনো গানের ভাব ও বাণী:

মিলন হবে কত দিনে

আমার মনের মানুষেরই সনে।।

জীবনসায়াহ্নে সাধকের কাছে পৃথিবীর রং যখন ক্রমশ ধূসর হয়ে আসে, পারাপারের আকাঙ্ক্ষায় যখন তাঁর অন্তর হয় ব্যাকুল, ঠিক তেমনি এক মুহূর্তে দয়ালগুরুর অভয়-শরণ কামনায় একান্ত আত্মনিবেদনের সুর শোনা যায় লালনের কণ্ঠে:

পার কর হে দয়ালচাঁদ আমারে।

ক্ষম হে অপরাধ আমার ভবকারাগারে।।

 ‘ভবপারের কান্ডারির অনুগ্রহপ্রাপ্তির আশায়’ ব্যাকুল হরিনাথের কণ্ঠেও অভিন্ন সুর ধ্বনিত হয়ে উঠেছে:

ওহে, দিন তো গেল সন্ধ্যা হ’ল,

        পার কর আমারে।

তুমি পারের কর্তা, শুনে বার্তা,

        ডাকছি হে তোমারে।।

এ রকম লালনের গানের বিষয়-ভাব-উপমা-রূপক-চিত্রকল্প-ভাষাগত সাদৃশ্য কাঙালের আরও অনেক গানে আবিষ্কার সম্ভব। আসলে বাউলগানের শ্রেষ্ঠ পদকর্তা-বাউলসাধনার শ্রেষ্ঠ ভাষ্যকার লালন ফকিরের প্রভাব অস্বীকার করা সমকাল ও উত্তরকালের বাউল-পদকর্তাদের পক্ষে অসম্ভব ছিল। সংগত কারণেই এ ক্ষেত্রে কাঙাল হরিনাথও তার ব্যতিক্রম নন।

লালন ও হরিনাথের সম্পর্কে একটি অভিনব মাত্রা যুক্ত হয়েছিল বিপন্ন হরিনাথের সহায় হিসেবে তাঁর পাশে এসে লালন ফকিরের দাঁড়ানোর ভেতর দিয়ে। লালনের সাহসী সামাজিক ভূমিকার একটি ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত মেলে তাঁর পরম-বান্ধব কাঙাল হরিনাথকে জমিদারের সহিংস আক্রোশ থেকে রক্ষার ঘটনায়। হরিনাথ তাঁর গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা পত্রিকায় ধারাবাহিক শিলাইদহের ঠাকুর-জমিদারদের প্রজা-পীড়নের সংবাদ প্রকাশ করায় তাঁরা তাঁর ওপর অত্যন্ত কুপিত হন। প্রতিশোধস্পৃহ জমিদারপক্ষ কাঙালকে শায়েস্তা করার জন্য দেশীয় লাঠিয়াল ও পাঞ্জাবি গুন্ডা নিয়োগ করে। কাঙালের অপ্রকাশিত দিনপঞ্জি থেকে জানা যায়, জমিদারের লাঠিয়াল বাহিনীর হাত থেকে বিপন্ন বন্ধু হরিনাথকে রক্ষার জন্য বাউলসাধক লালন ফকির ‘তাঁর দলবল নিয়ে নিজে লাঠি হাতে সেই লাঠিয়ালের দলকে আচ্ছা করে ঢিঢ করে সুহৃদ কৃষকবন্ধু হরিনাথকে রক্ষা করেন।’ (লোকসঙ্গীত সমীক্ষা: বাংলা ও আসাম, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, পৃষ্ঠা: ৬৬-৬৭)

হরিনাথের জীবন শুরু হয়েছিল সাহিত্যচর্চা, সাময়িকপত্র-সম্পাদনা, শিক্ষা-প্রসার, নারীজাগৃতি, প্রজাহিতৈষণা ও সমাজহিতব্রতের মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে। লালন ফকিরের সখ্য ও সাহচর্যে এসে তাঁর জীবনে যুক্ত হয় মরমি ভাব-সাধনার ধারা এবং সেই সূত্রে বাউলগান রচনার পর্ব। একসময়ে লালন ও তাঁর পথ এসে একটি মিলন-বিন্দুতে মেশে মূলত বাউলগানের অনুষঙ্গে, ‘শখের বাউল’ কাঙালের জীবনে এই বাউলগানই অবশেষে হয়ে ওঠে তাঁর জীবনবেদ—যার মূলে ছিল লালন সাঁইয়ের প্রেরণা, প্রভাব ও পরিচর্যা—যা কাঙাল-মানসের এক ভিন্ন ইতিহাস রচনার সহায়ক হয়। 

মীর মশাররফ হোসেনের (১৮৪৭—১৯১১)
মীর মশাররফ হোসেনের (১৮৪৭—১৯১১)

মশাররফ-মানসে লালন
কাঙালের সূত্রে তাঁর শিষ্যমণ্ডলীর সঙ্গেও লালন ফকিরের একটি আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। মীর মশাররফ হোসেন, জলধর সেন, অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, তন্ত্রাচার্য শিবচন্দ্র বিদ্যার্ণব—এসব কাঙাল-শিষ্যের স্মৃতি ও বিবরণে লালন সাঁইয়ের প্রসঙ্গ উঠে এসেছে।
বিষাদ-সিন্ধু-খ্যাত মীর মশাররফ হোসেনের জন্মপল্লি লাহিনীপাড়া লালনের সাধনক্ষেত্র ছেঁউড়িয়ার খুবই কাছের গ্রাম। লালনের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগের প্রাথমিক সেতু ছিলেন কাঙাল হরিনাথ। মশাররফের সঙ্গীত লহরীর (১৮৮৭) একটি গানে লালনের উল্লেখ মেলে:
আরে ভাই, না পাই দিশে, কলির শেষে,
কিসে, কার মন মজেছে।
ফিকিরচাঁদে, আজবচাঁদে,
রসিকচাঁদে সব মেতেছে।
কোথা আর পাগল কানাই, লালন গোঁসাই,
সব সাঁই এতে হার মেনেছে।
 সঙ্গীত লহরীতে বাউলাঙ্গের আরও কিছু গান আছে, যা কাঙাল ও লালনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
লালন সম্পর্কে প্রথম বিশদ বিবরণ পাওয়া যায় মীর মশাররফ হোসেন-সম্পাদিত পাক্ষিক হিতকরী পত্রিকায়। লালনের মৃত্যুর (১৭ অক্টোবর ১৮৯০) পরপরই, মাত্র ১৪ দিনের ব্যবধানে, ১৮৯০ সালের ৩১ অক্টোবর হিতকরী পত্রিকায় ‘মহাত্মা লালন ফকীর’ নামে একটি সংক্ষিপ্ত অথচ তথ্যবহুল ও সুলিখিত নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। ছেঁউড়িয়ার আখড়ায় মীরের আসা-যাওয়ার খবর তাঁর লালন-অনুরাগের সাক্ষ্য দেয়।

ত্রয়ী-মিলনের তামাম-শুদ্
ছেঁউড়িয়া-কুমারখালী-লাহিনীপাড়া মিলে লালন-কাঙাল-মশাররফ একটি মরমি বলয় গড়ে তুলেছিলেন সখ্য-সৌহার্দ্যে-ভাববিনিময়ে। শিলাইদহের কথাও ভুলে গেলে চলবে না এই সূত্রে ছেঁউড়িয়ার সঙ্গে যোগ রচিত হয়েছিল জ্যোতিরিন্দ্রনাথ-রবীন্দ্রনাথের—এই মরমি-সম্মিলনে কণ্ঠ মিলিয়েছিলেন গগন হরকরা-গোঁসাই গোপাল-সর্বক্ষেপী বোষ্টমীও। পদ্মা-গড়াই-কালীগঙ্গা এক পানসিতে তুলেছিল মরমি ভাব-সাধকদের। জলধি-জনপদে ছড়িয়ে পড়েছিল লালনের গানের অমিয় সুরধারা:

সাধুর বাজার কি আনন্দময়

অমাবস্যায় চন্দ্রের উদয়...

তাঁদের রচনা থেকে

লালন সাঁই

সাধক

জন্ম ১৭৭৪ সালে। বাংলার প্রভাবশালী বাউল-সাধক। ছয় শয়ের বেশি গানের রচয়িতা। মৃত্যু ছেঁউড়িয়ায়, ১৬ অক্টোবর ১৮৯০।

এ দেশেতে এই সুখ হলো আবার কোথা যায় না জানি।

পেয়েছি এক ভাঙা নৌকা জনম গেল সেচতে পানি।।

            কার বা আমি কে বা আমার

            আসল বস্তু ঠিক নাহি তার

            বৈদিক মেঘে ঘোর অন্ধকার

                        উদয় হয় না দিনমনি।।

            আর কিরে এই পাপীর ভাগ্যে

            দয়ালচাঁদের দয়া হবে

            কতদিন এই হালে যাবে

                        বহিয়ে পাপের তরণী।।

l লালনের গান থেকে অংশবিশেষ

কাঙাল হরিনাথ মজুমদার

গ্রামীণ সাংবাদিকতার পুরোধা

জন্ম ১৮৩৩ সালে। গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা। লেখক, গীতিকবি। মৃত্যু ১৬ এপ্রিল ১৮৯৬।

আমি শুনিলাম, বাঙলা সংবাদপত্রের অনুবাদ করিয়া গভর্মেণ্ট তাহার ম্মর্ম অবগত হইতে সংকল্প করিয়াছেন। তন্নমিত্ত একটি কার্য্যালয়ও স্থাপিত হইবে। ‘ঘরে নাই এক কড়া, তবু নাচে গায় পড়া’। আমার ইচ্ছা হইল, এই সময় একখানি সংবাদপত্র প্রচার করিয়া, গ্রামবাসী প্রজারা যে যেভাবে অত্যাচারিত হইতেছে, তাহা গভর্মেণ্টের কর্ণগত করিলে, অবশ্যই তাহার প্রতিকার এবং তাহাদিগের নানা প্রকার উপকার সাধিত হইবে, সন্দেহ নাই। গ্রাম ও গ্রামবাসী প্রজার অবস্থা প্রকাশ করিবে বলিয়া পত্রিকার নাম গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা রাখিয়া ‘গিরিশযন্ত্রে’র কর্ত্তা গিরিশচন্দ্র বিদ্যারত্ন মহাশয়কে একটি শিরোমুকুট...আর একটি শ্লোক প্রস্তুত করিতে প্রতিশ্রুত করাইলাম।

l কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের ‘ডায়েরি’ থেকে অংশবিশেষ 

মীর মশাররফ হোসেন

প্রথম মুসলমান ঔপন্যাসিক

জন্ম ১৩ নভেম্বর ১৮৪৭ সালে। লেখক–সম্পাদক। বিষাদ-সিন্ধু তাঁর জনপ্রিয়তম উপন্যাস। মৃত্যু ১৯ ডিসেম্বর ১৯১২, ফরিদপুরে।

এই পরিশূন্য ঘূর্ণায়মান জগতে রূপান্তর আশ্চর্য্য নহে। যে কাঞ্চনশৃঙ্গ নীলাকাশ ভেদ করিয়া ঊর্ধ্বে উঠিয়াছে, হয়তো কালের প্রবাহে চূর্ণবিচূর্ণ সমতল ক্ষেত্রে পরিণত হইতে পারে। মহা সিন্ধু কালচক্রে পরিশুষ্ক হইয়া বালুকাময় মরুভূমি হইয়া মরীচিকারূপে পথিকের ভ্রম জন্মাইতে পারে। অতি উচ্চ শিখর দেখা দিয়া জলধির জলরাশি সরাইয়া স্বীয় মস্তক উন্নত করিতে পারে।...নিয়তির অসাধ্য কিছু নাই। পরিবর্তন, রূপান্তর জগতের আশ্চর্য্য নহে।

l আত্মজীবনীমূলক উপাখ্যান ‘উদাসীন পথিকের মনের কথা’ থেকে অংশবিশেষ