স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, জাদুঘরে ঢুকে প্রাগৈতিহাসিক যুগের ফসিল কিংবা রাজরাজড়াদের ব্যবহৃত থালাবাটি দেখার চেয়ে আমার আকর্ষণ খোদ ঐতিহাসিক জায়গাটির প্রতি, যেখানে সপ্রাণ মানুষের এককালের যাপিত জীবনের ঘ্রাণ পাওয়া যায়। তাই সুব্রত শংকরের সঙ্গে ঔপনিবেশিক ভাজির্নিয়ার রাজধানী কলোনিয়াল উইলয়ামসবার্গ দেখতে যাওয়ার প্রস্তাব লুফে নিয়েছিলাম। সংরক্ষিত এই প্রাচীন পল্লির সব কটি দ্রষ্টব্য দেখতে হলে এককাড়ি টাকা দিয়ে টিকিট করলেই হবে না, তার জন্য দুদিন সময়ও লাগবে। অতএব আমাদের সেই ইচ্ছা পরিত্যাগ করতে হয়।
ভেবেছিলাম, বাড়িগুলোয় ঢোকা না গেলেও বাইরে থেকে উঁকিঝুঁকি মেরে কিছু দেখে ফেলা যাবে। কিন্তু দেখা গেল, সব কটিরই দরজা বন্ধ, টিকিট দেখালেই ভেতরে যাওয়া সম্ভব। যেমন, র্যানডলফের বাড়ির কাছারির সামনে অষ্টাদশ শতাব্দীর পোশাক পরা এক ঠাকুরমা হাত নেড়ে ঘরের বন্ধ দরজার সামনে জড়ো হওয়া জনা চারেক দর্শনার্থীকে অমৃতবচন শোনাচ্ছেন। মাথাজোড়া সুখী টাক নিয়ে প্রাচীন পোশাকের আরেকজন ক্লান্ত ভঙ্গিতে পেছনের বেঞ্চিতে বসা। দৃশ্যটার ছবি তোলার জন্য দূর থেকে জুমইন করলে ভিউফাইন্ডারে দেখতে পাই, আমার দিকে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে পাঁচ আঙুল দেখিয়ে কিছু একটা বলছেন ঠাকুরমা। তার মানে, হাত তুলে বাধা দিচ্ছেন না। হয়তো বলছেন, ‘পাঁচ ডলার দিয়ে বাপু ভেতরেই তো ঢুকতে পারো, দূর থেকে চোরের মতো ছবি তোলা কেন?’ একবার সিডনির অপেরা হাউসের প্রমেনেডে এক আদিবাসীকে বাদ্যযন্ত্র বাজাতে দেখে তাঁর ছবি তুলতে গেলে পাশে শিঙা বাজানো আরেকজন ধমকের সুরে বলেছিলেন, ছবি তুললে দশ ডলার দিতে হবে। এ রকম নিষেধাজ্ঞার অভিজ্ঞতা ছিল বলে ঠাকুরমার হাত দেখানোর ফাঁকেই কাজ সেরে ফেলি। র্যানডলফের অষ্টাদশ শতাব্দীর (১৭১৫) বাড়িটা যে উইলিয়ামসবার্গের সবচেয়ে পুরোনো এবং আদি বাড়িগুলোর একটি, সেটা তার বহিরঙ্গের লাল কাঠের দেওয়াল আর শার্সি দেখেই বোঝা যায়। বাড়ির সামনে রাস্তার পাশে একটা মদের পিপে কেন খাড়া করে রাখা হয়েছে, বোঝা গেল না। র্যানডলফ সাহেব যেমন ছিলেন ধনশালী, তাঁর কৌলিন্যও তেমনই, এই তল্লাটের মধ্যে একমাত্র তিনিই ইংরেজ রাজের কাছ থেকে নাইট উপাধি পেয়েছিলেন। মনে মনে ভাবি, আরে ছো! আমাদের রবিঠাকুরও তো নাইট খেতাব পেয়েছিলেন, (জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘটনার পর) সেটা ছুড়েও ফেলেছিলেন।
এখান থেকে দুপা এগোলেই নিকলসন স্ট্রিট, তার পাশে মাঠের এ মাথায় দৈত্যাকার একটা ওকগাছ। ঠিক এগারো বছর পর ওটাকে শতবর্ষী বৃক্ষ বলা যাবে। এখানকার বন বিভাগের এক কর্মীর স্ত্রী মিসেস কম্পটনের নামে এটাকে ওরা আদর করে নাম দিয়েছে কম্পটন ওক। পেল্লায় গাছটা এ রকম রৌদ্রকরোজ্জ্বল দুপুরেও তার নতমুখী শাখা–প্রশাখা ছড়িয়ে ঘন ছায়া নামিয়ে দিয়েছে চারপাশে। গাছ ঘিরে মাটিতে পায়া পোঁতা বেঞ্চি বসানো। একটা ডাল ভূমির সমান্তরাল হয়ে চড়ে বসার মতো উচ্চতায় বাড়িয়ে রেখেছে তার বাহু। উল্টো দিকে দুপা এগোলেই ১৭৮৮ সালে তৈরি আইনজীবী এবং অধ্যাপক সেন্ট জর্জ টাকারের বাড়ি, তারপর ১৭১৮ সালের মেয়রের বাড়ি পেরিয়ে গেলে ১৭২২ সালে তৈরি গভর্নর প্যালেস। প্যালেস বলছে বটে, কিন্তু ওটার আকার–আকৃতি দেখে ভক্তি-শ্রদ্ধা জাগে না। তবে হ্যাঁ, প্যালেস বলা যায় ১৯০৫ সালে তৈরি আমাদের তখনকার গভর্নর হাউস মানে বর্তমানের বঙ্গভবনকে। এদের গভর্নর প্রাসাদে ঢোকার কোনো ব্যবস্থা দেখি না। তবে পাশেই প্রাসাদের রসুইঘরে যাওয়ার ব্যবস্থা আছে দর্শনীর বিনিময়ে, ওখানে খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থাও আছে। ওটার দরজার সামনে আঠারো শতকের পোশাকের এক পরিচারিকাকে দেখা গেল, অভ্যর্থনা করার জন্য প্রস্তুত। তবে ভেতরে না ঢুকে কেউ ওর সঙ্গে ছবি তুলতে চাইলেও আপত্তি করছে না।
আমরা কোনো বাড়িতে ঢুকছি না বলে বিশেষ কিছু দেখা থেকে যে বঞ্চিত হচ্ছি, এমন মনে হচ্ছে না। রাস্তায় লোকজনের বহর দেখে মনে হয়, ভেতরে যত লোক ঢুকছে, তার চেয়ে বেশি মানুষ আমাদের মতো বাইরে থেকেই ঘুরে দেখছে। একটা খালি বাড়ির পেছনে পাথরের দেওয়ালঘেরা পাতকুয়া, তার পাশে মোটা ফাঁসির দড়ির মতো ফাঁসে বাঁধা কাঠের বালতি। কুয়ার ওপর ছোট দোচালা। এককালে যে এখানে সাপ্লাইর পানি ছিল না, কুয়াটা তারই সাক্ষীগোপাল। এটা সবার জন্য খোলা, তা না হলে মিনিমাগনা ভেতরে ওটার কাছে যাওয়ারই কোনো সুযোগ মিলত না।
ডিউক অব গ্লুচেস্টার রোডটাই পল্লির প্রধান সড়ক। ওটার দুই পাশে জুতার কারিগরের কারখানা, ফ্যাশন স্টোর, অলংকার তৈরির স্যাকরার দোকান। ব্রিটিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য ভার্জিনিয়াবাসীকে নিজেদেরই অস্ত্র তৈরি করতে করেছিল। এই রাস্তার পাশেই রয়েছে সেই অস্ত্রকারখানা। কারিগর, কর্মী আর ক্রীতদাসদের জন্য রুটির কারখানা এবং আনুষঙ্গিক ওয়ার্কশপ ইত্যাদিও গড়ে উঠেছিল এটিকে ঘিরে।
এই প্রাচীন পল্লিতেই ছিল আমেরিকার দ্বিতীয় প্রাচীন কলেজ উইলিয়াম অ্যান্ড মেরি। এটা থেকে পাস করে বের হওয়া ছাত্রদের মধ্যে তিনজন পরবর্তী সময়ে দেশটির প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন—জেফারসন, জেমস মনরো ও জন টাইলার। প্রথম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন এই কলেজে না পড়লেও এখান থেকে নিয়েছিলেন সার্ভেয়ার সনদ, পরবর্তী সময়ে কলেজটির প্রথম আমেরিকান চ্যান্সেলরও হয়েছিলেন তিনি।
ডিউক অব গ্লুচেস্টার রোডের পাশে একটা বাড়ি চিনতে পারি মালিকের নাতজামাইয়ের নাম দেখে। বাড়িটার মালিক অরলান্ডো জোনস ছিলেন জর্জ ওয়াশিংটনের দাদাশ্বশুর। জোনস ১৭১৯ সাল পর্যন্ত এ বাড়িতেই থাকতেন।
রাস্তার উল্টো পাশে কোর্টহাউস। সেটির বন্ধ দরজার ভেতর থেকে দুই পাশ ওল্টানো হ্যাট পরা বিচারক কোনো দিকে না তাকিয়ে চিন্তিত গম্ভীর মুখে রাস্তা পেরিয়ে হেঁটে গেলেন, মনে হলো যেন এইমাত্র একটা ফাঁসির হুকুম দিয়ে এসেছেন।
এ পাশে রাস্তার পাশে খোলা বাজার বসেছে অল্পস্বল্প পসরা নিয়ে। তেমন কিছু পাওয়া যায় না সেখানে, বেতের হ্যাট, সাবেকি আমলের লন্ঠন, বাচ্চাদের কিছু খেলনাপাতি, ফলমূল, বোতলের জল আর ড্রিংকস। দু–চারটা বাচ্চা পায়ের পাতার ওপর ভর দিয়ে অতি সাধারণ খেলনাগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করার চেষ্টা করছে। মায়েদের দৃষ্টিতে নির্লিপ্ততা দেখে সরে আসে ওরা।
ডিউক অব গ্লুচেস্টার রোডের শেষ মাথায় লালচে ইটের ক্যাপিটল বিল্ডিংয়ের গেটের বাইরে অষ্টাদশ শতাব্দীর পোশাকের এক নারী আমন্ত্রণের হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে। ওয়াশিংটন ডিসির বর্তমান ক্যাপিটল ভবনের তুলনায় নিতান্ত ছোটখাট এই তিনতলা ভবন পুরোনো ধাঁচের করে তৈরি হলেও প্রাচীনত্বের কোনো ছোঁয়া নেই। সেটিতে ঢোকার কোনো পরিকল্পনা ছিল না বলে আমরা দ্রুত পা চালিয়ে যখন চিজ শপ নামের খাবারের দোকানটায় পৌঁছাই, তখন বিকেলের ছায়া ঘন হয়ে নেমে এসেছে।