১০০ বছর ধরে উচ্চারিত হচ্ছে একটি কবিতার নাম; হাজার পৃষ্ঠায় লিপিবদ্ধ হচ্ছে তার ভাষ্য। সাহিত্যের ইতিহাসে এ রকম ঘটনা বছরে বছরে দশকে দশকে ঘটে না। কখনো কখনো মানুষের সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতা ও ইতিহাস কোনো কোনো কবিতাকে স্মৃতি ও সত্তার ভেতর গেঁথে ফেলে। বাংলা কবিতার মানচিত্রে ‘বিদ্রোহী’ এক স্মৃতিবিদ্ধ নাম। কবিতার টেকনিক বদলেছে, বদলে গেছে ভাব ও ভাষার শরীর; অথচ ‘বিদ্রোহী’কে আজও পড়তে হয়। কিন্তু বাঙালি কেন কবিতাটিকে সাদর সম্ভাষণে গ্রহণ করল? কেমন ছিল বাংলা কবিতার হালহকিকত? পরবর্তী কালের বাংলা সাহিত্যে পড়েছিল কি ‘বিদ্রোহী’র প্রভাব? কবিতাটির ১০০ বছরের পরিভ্রমণ শেষে সম্ভবত এ প্রশ্নগুলো আজও প্রাসঙ্গিক। আর তাই আমাদের ফিরে তাকাতে হবে বাংলা কবিতার আধুনিকায়নের পরিপ্রেক্ষিতে যেখানে ঔপনিবেশিক ইতিহাস একটি বিরাট পর্ব।
আমরা দেখব উনিশ শতকজুড়ে তৈরি হয়েছে নতুন এক বাংলা সাহিত্য, যার অধিকাংশ রচয়িতা ও ভোক্তা উঠে এসেছেন ঔপনিবেশিক শিক্ষাধারার গহিন প্রবাহ থেকে। ভারতীয় উপমহাদেশ কিংবা বাংলা অঞ্চলের ইতিহাস পড়ার আগেই তাঁরা পড়ে ফেলেছেন ইউরোপের ইতিহাস। চার্বাক পড়ার আগেই যাঁরা জেনে গেছেন সক্রেটিস কিংবা প্লেটোর নাম। কালিদাস, আমির খসরু, চণ্ডীদাস না পড়লেও পড়ে ফেলেছেন হোমারের সাহিত্য। সন–তারিখ মেপে মেপে গ্রিক-রোমান সাম্রাজ্যের বিবরণও তাঁদের পড়া হয়ে গেছে। আর শেক্সপিয়ার হয়ে গেছেন অনেকেরই জীবনের ধ্রুবতারা। বিদ্যাচর্চার এ যন্তরমন্তর ঘরে যাঁরাই গিয়েছেন, তাঁদেরই মন ও মগজ গড়ে উঠেছে ঔপনিবেশিক কায়দায়। মানসিক দাসত্বের লক্ষণগুলো নিয়ে তাঁদের কোনো মনোবেদনা ছিল না; বরং কেউ কেউ সরব ঘোষণায় জানান, ‘ইংলন্ডীয় কাব্যপদ্ধতি’তে কবিতা রচনায় উৎসাহী তিনি। যেমন বলেছিলেন রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। মাইকেলেরও ইচ্ছা ছিল বড় কবি হওয়ার, কিন্তু স্বপ্নের কেন্দ্রভূমি ছিল সাত সমুদ্র তেরো নদীর অন্য পারে। উনিশ শতকের বাংলা কবিতার প্রেক্ষাপট এ তথ্য দেয় যে সাংস্কৃতিকভাবে উপনিবেশিত বাংলায় কবিতাও ছিল উপনিবেশিত সৃষ্টি। অবশ্য ঔপনিবেশিক শাসনের সাংস্কৃতিক আধিপত্যকে এড়িয়ে যেতে পেরেছিল নিম্নবর্গের সাহিত্যিক সৃষ্টি—কবিগান, পালাগান, কথকতা ইত্যাদি। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত এগুলোকে যথাসম্ভব এড়িয়ে গিয়েছে।
বাংলা কবিতার মানচিত্রে ‘বিদ্রোহী’ এক স্মৃতিবিদ্ধ নাম। কবিতার টেকনিক বদলেছে, বদলে গেছে ভাব ও ভাষার শরীর; অথচ ‘বিদ্রোহী’কে আজও পড়তে হয়। কিন্তু বাঙালি কেন কবিতাটিকে সাদর সম্ভাষণে গ্রহণ করল? কেমন ছিল বাংলা কবিতার হালহকিকত? পরবর্তী কালের বাংলা সাহিত্যে পড়েছিল কি ‘বিদ্রোহী’র প্রভাব? কবিতাটির ১০০ বছরের পরিভ্রমণ শেষে সম্ভবত এ প্রশ্নগুলো আজও প্রাসঙ্গিক।
এ শতকের বাংলা কবিতায় কমপক্ষে তিনটি ধারা আমরা পাব। প্রথমত, সামাজিক বাস্তবতার উপস্থাপনানির্ভর কবিতা; দ্বিতীয়ত, ক্ল্যাসিসিস্ট বা ধ্রুপদি ধারার কবিতা; তৃতীয়ত, রোমান্টিক স্বপ্ন–কল্পনাপ্রসূত কবিতার ধারা। এমন নয় যে অন্য আর কোনো ধারায় প্রবেশ না করে একজন কবি জীবনভর একটি রীতির কবিতাই রচনা করে গেছেন। সমকালীন বাস্তবতার উপস্থাপন যাঁদের আরাধ্য, তাঁদের কেউ কেউ সংশয়ে দুলতে দুলতে ঔপনিবেশিক সংস্কৃতির সমালোচনা করেছেন, কিন্তু কণ্ঠ ভরে গেয়েছেন ব্রিটিশ শাসনের প্রশংসা। যেমন দেখতে পাই ঈশ্বর গুপ্তের কবিতায়। ধ্রুপদিবাদীরা ফিরে গেছেন সাংস্কৃতিক অতীতে, রামায়ণ-মহাভারতের পৌরাণিক পৃথিবীতে। কেউ কেউ উঁকি দিয়েছেন ইতিহাসে। অনিবার্যভাবেই কবিদের তালিকায় উঠে আসবে মধুসূদন, নবীনচন্দ্র, হেমচন্দ্রের নাম। তবে সবচেয়ে প্রভাবশালী কবি মধুসূদনের বিস্তৃত অভিঘাতে তৈরি হয়েছিল অনুকারী কবিদের দল, কালের পরীক্ষায় যাঁরা উত্তীর্ণ হননি। এমনকি সাহিত্যের ইতিহাস পুস্তকেও তাঁরা করুণভাবে ধরাশায়ী। পুরাণের কল্পবিশ্ব আর ইতিহাসের ঝনঝনানিতে মৃদু সুর নিয়ে এলেন বিহারীলাল চক্রবর্তী। বলতে দ্বিধা নেই, ব্যক্তি ‘আমি’র হৃদয় আবিষ্কারে পথিকৃৎ তিনি। রবীন্দ্রনাথ যথার্থভাবেই তাঁকে শনাক্ত করতে পেরেছিলেন এবং অনুপ্রেরণার প্রাথমিক উৎস হিসেবে গ্রহণও করেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ নিজে ছিলেন আদি-অন্ত রোমান্টিক। এক ‘আমি’র পেছনে তিনি ছুটে বেড়িয়েছেন সম্পূর্ণ জীবন। নজরুলও খুঁজেছিলেন ‘আমি’র মর্মশাঁস। কিন্তু সে এক অন্য ‘আমি’—বাংলা কবিতায় আগে যার দেখা মেলেনি—অহমের ডালপালা মেলে জানান দিয়েছে, আমিই শক্তি, আমিই ক্ষমতা, আমিই সৃষ্টি; আমার ভেতর দিয়েই শুরু ও সমাপ্তি। বাংলা কবিতার নজরুল-পূর্ব কোনো যুগেই এ আমির উৎসারণ দেখতে পাব না। ‘বিদ্রোহী’র সহসা আবির্ভাব তাই মুহূর্তে সচকিত করে তুলল সবাইকে। চমকে গেল প্রথাগত সামন্ত সমাজ, সাম্প্রদায়িকতা ও শ্রেণিসংগ্রামে কাতর মধ্যবিত্ত। নজরুল দেখালেন আমির শক্তি ও সম্ভাবনা ব্যাপক; সে ভাঙতে পারে, গড়তে পারে, প্রথা ও নিয়মের বেড়াজাল ডিঙিয়ে দিতে পারে তুমুল চিৎকারে। ‘উৎপীড়িতের ক্রন্দন’ থামার সূত্রেই সমাপ্তি পাবে বিদ্রোহীর অভিযাত্রা। নজরুল যেন বলছেন, ব্যক্তির যুদ্ধংদেহী মন আছে, সহিংস রূপও আছে। কিন্তু কার বিরুদ্ধে এই সহিংসতা? নিশ্চিতভাবে, বিরুদ্ধ পক্ষে আছে ঔপনিবেশিক ও সামন্তবাদী শাসন ও নিপীড়নের সুদীর্ঘ ইতিহাস। অবিরল ক্রন্দনের মর্মের কারণ এটিই; আর তাই প্রতিরোধ জরুরি। খেলাফত আন্দোলনের গণজোয়ার যেন এ সত্যকেই প্রতিষ্ঠিত করেছিল।
সত্যিকার অর্থে সামন্ত শাসনে ব্যক্তিসত্তার সামাজিক মূল্য ছিল না। আধুনিক সমাজে চিন্তা, মত ও অংশগ্রহণের ভেতর দিয়ে ব্যক্তি তার সামাজিক মূল্য তৈরি করেছে। এ সমাজে শ্রেণি হিসেবে মধ্যবিত্ত ‘আমি’র হদিস নিয়েছে সবার আগে। কিন্তু কখনো ভাবেনি, কবিতায় এ রকম ঘটতে পারে, ভাঙনের ডাক দিয়ে উদ্দীপিত করে তোলা যায় জনতাকে, কবিতা হতে পারে সাংস্কৃতিক ক্ষমতার প্রকাশ। ‘বিদ্রোহী’ কবিতার মাধ্যমে নজরুল ব্যক্তির সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও দার্শনিক মূল্য তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। আর অবশ্যই সাহিত্যের কাছে মেটাতে পেরেছেন কবিতার নন্দনতাত্ত্বিক মূল্য। নয়তো ইতিহাসে ‘বিদ্রোহী’ কবিতার দীর্ঘমেয়াদি পরিগ্রহণ সম্ভব হতো না। ‘কবিতার ইতিহাস মূলত কলাকৌশলের ইতিহাস’—ফরাসি কবি লুই আরাগঁর এ কথা মেনে নিয়ে সন্দেহাতীতভাবে বলা যায়, বাংলা কবিতার কলাকৌশলের ইতিহাসে ‘বিদ্রোহী’ কবিতার স্বতন্ত্র নন্দনতাত্ত্বিক মূল্য আছে।
নজরুল কবিতাটিকে বেঁধেছেন ছয় মাত্রার মাত্রাবৃত্তে। অসমান পঙ্ক্তির বিন্যাস দিয়ে বাক্যকে করেছেন মুক্ত ও প্রবহমান। অন্ত্যমিল থাকলেও রেখে দিয়েছেন অতি পর্ব, অপূর্ণ পর্ব সাদা পৃষ্ঠার ওপর ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে অসমান পঙ্ক্তির কালো অক্ষর। এ অসমতা, ছন্দের চঞ্চলতা তারুণ্য ও যৌবনের উদ্দীপনাকে ইশারা করে। কবিতাটি পড়তে পড়তে মনে হয়, ছন্দ–নিরূপিত পথে পাঠক ছুটছেন এক স্থান থেকে অন্য স্থানে, এক ‘আমি’র চিত্রপট থেকে অন্য চিত্রপটে; এক ‘আমি’র বিন্দু থেকে ছড়িয়ে পড়ছে বহুরৈখিক আলো। সুফি সাধনার মতো ধ্যানী ও মগ্ন এই আমি, কিন্তু দিওনুসিয় আনন্দে মশগুল।
নজরুল যা বলতে চান এবং ‘আমি’ যা ধারণ করতে চায়, তার জন্য অবশ্যম্ভাবী এ কৌশল। এর সঙ্গে তুলনা চলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ কবিতার। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ আত্মোপলব্ধির প্রতিনিধি হিসেবে বেছে নিয়েছেন ঝরনাকে। নিজের ‘আমি’ পরিচয়কে লুকিয়ে ফেলেছেন ঝরনার স্রোতের তলদেশে। অন্যদিকে ‘বিদ্রোহী’ কবিতাজুড়ে নজরুলের ‘আমি’ নিজেই একটি বিষয়, নানা রূপে তার বিচিত্র প্রকাশ। একবার কুঠার তো আরেকবার বাঁশি; একবার নটরাজ, অন্যবার ভৃগু; অর্ফিয়ুসের বাঁশি মুহূর্তেই পরিণত হয়ে যায় কৃষ্ণের বাঁশিতে। প্যারাডক্সের আরও নজির, ‘লোকালয়/ শ্মশান, কুঠার/ বাঁশি, জাহান্নাম/ পুষ্পের হাসি, বাঁশি/ রণ-তূর্য।’ বৈপরীত্যের সমাবেশ কখনো সমানতালে চলতে পারে না বলেই হয়তো নজরুল রেখে দিয়েছেন অতি পর্ব, অপূর্ণ পর্ব কিংবা অসম পঙ্ক্তি। আধার ও আধেয়র এ রকম হরগৌরী সম্বন্ধ নজরুল-পূর্ব বাংলা কবিতায় খুব বেশি পাওয়া যাবে না।
‘বিদ্রোহী’ পাঠককে টেনে নিয়ে যায় চড়াই–উতরাই ভরা পথে। ছন্দে ছন্দে কবিতা চলে, তাল মিলিয়ে চলেন পাঠক। একবার শীর্ষে, আরেকবার সমতলে। কবিতা পাঠের সফরে থাকে নৃত্যগীতময় টান টান উত্তেজনা। ‘আমি’র ক্রম রূপান্তর নিঃসন্দেহে চমকপ্রদ ব্যাপার। পাঠক নিজেও রূপান্তরিত আমিকে উপভোগ করেন। কবিতার আমির সঙ্গে নিজের আমিকে মিলিয়ে দেখার আকাঙ্ক্ষা জাগে তাঁর। লেখকের আমি, কবিতার আমি ও পাঠকের আমির মধ্যে একটি কল্পিত ও সৃষ্টিশীল যোগাযোগ স্থাপিত হয়ে যায়। প্রতিটি নতুন পাঠক ঢুকে যান তিন আমির সমবেত স্বরের ভেতর, খুঁজে নেন নিজের আমিকে। একে বলব নন্দনতাত্ত্বিক যোগাযোগ বা সম্পর্ক, ‘বিদ্রোহী’ যা অত্যন্ত অল্প সময়ে স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিল।
যোগাযোগসক্ষম হওয়ার মৌল কারণগুলো নিহিত ছিল সে কালের সমাজ ও সংস্কৃতির ভেতর। কেননা, ঔপনিবেশিক ইতিহাস ও রাজনীতি বহু কাল ধরে তৈরি করে রেখেছিল আত্মপরিচয়ের সংকট, যা প্রধানত শিক্ষিত মধ্যবিত্তের, তবে তা তাড়িত করেছিল সমাজের নিম্নবর্গকেও। শ্রেণিগত সংকটে ডুবুডুবু মানুষটি কিংবা ব্যক্তিক সংকটে ভুগতে থাকা মানুষটিও নিজের আমিকে খুঁজতে চেয়েছে; নিজেকেই খুঁজে খুঁজে ফেরার অভিযানে ‘বিদ্রোহী’ এল আগুনের হলকার বেশে। তার উত্তাপে জ্বলে উঠল অসংখ্য ব্যক্তি-আমি; ছন্দ, প্রতীক ও পুরাণ কবিতার সঙ্গে গড়ে তুলল জনতার অন্ত্যমিল। পৌরাণিক প্রসঙ্গ, আরবি, ফারসি ও উর্দু শব্দের প্রয়োগ বিশেষভাবে খুশি করল হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়কে। ‘বিদ্রোহী’ হয়ে উঠল অনন্ত আত্মবিচ্ছুরণ। বাংলার সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিসরে এ বিচ্ছুরণ স্থাপন করেছে প্রতিরোধী চৈতন্যের মজবুত ভিত্তি।
‘বিদ্রোহী’ কেবল পাঠকের অজস্র ‘আমি’কে প্রভাবিত করল না কিংবা কবিতার নন্দনতাত্ত্বিক স্বভাবকে বদলে দিল না, বরং সমগ্র বাংলা সাহিত্যে স্বভাব বদলের ইশতেহার হয়ে উঠল। ভেবে অবাক হতে হয়, জীবনানন্দ দাশ, স্বতন্ত্র কাব্যভাষা নিয়ে যিনি বাংলা কবিতায় কালোত্তীর্ণ এক স্মারকচিহ্ন রূপে বিদ্যমান, তিনিও প্রভাবিত হয়েছিলেন নজরুলের কবিতা দ্বারা। বাঙালি মুসলমান কবিদের অনেকে ‘বিদ্রোহী’কে অনুসরণ করেছেন এবং লুপ্ত হয়েছেন নিশ্চিত ব্যর্থতায়। সমকালীন তরুণেরা রবীন্দ্রোত্তর আধুনিক সাহিত্যের বিনির্মাণে নজরুলকে একটি বড় বাঁক হিসেবে দেখেছিলেন। বুদ্ধদেব বসুর স্মৃতিচারণায় কবিতার আধুনিকায়ন ও নজরুলের সম্পর্কের ছকটি বেশ স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। চল্লিশের কবিদের কেউ কেউ তাঁকে আত্মিকভাবে গ্রহণ করেছেন। ‘বিদ্রোহী’ কবিতার চেতনাগত প্রভাব স্বীকার করেছেন। ফররুখ আহমদের স্মৃতি ও সন্দর্ভ সে রকম ইঙ্গিত দেয়। প্রকৃতপক্ষে বাঙালির নতুন নন্দনতত্ত্বে ‘বিদ্রোহী’ ছিল সাহসের প্রতীক।
নজরুলের ভাষাকে কেউ ধারণ করতে পারেননি, হয়তো চাননি। কারণ, এ ভাষা বিশিষ্টভাবে ‘নজরুলি’, গ্রহণমাত্র সেই প্রভাবিত কবি ও লেখককে বরণ করে নিতে হবে আত্মঘাত। ‘বিদ্রোহী’ কবিতার পুরাণ, শব্দ, রূপক স্থায়ী কিছু মনশ্চিত্র তৈরি করে দিয়েছে বাংলা ভাষায়: রুদ্র ভগবান, দীপ্ত জয়শ্রী, ভাসমান মাইন, যজ্ঞ, পুরোহিত, ইস্রাফিলের শিঙ্গা, ঝঞ্ঝা, বোররাক, পরশুরামের কুঠার, নৃত্য-পাগল ছন্দ, মুক্ত জীবনানন্দ ইত্যাদি। নজরুলের উপনিবেশবিরোধী মতাদর্শ ও প্রতিরোধী সাহিত্যের নন্দনতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি আলোড়িত করেছে বাংলা সাহিত্যকে। রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে থাকা চরমপন্থা, মার্ক্সবাদ ও বিপ্লবী রাজনীতির তৎপরতার কারণে নজরুলের প্রতিরোধ জারি থাকল। তবে তাঁর কালের আধুনিকতাবাদীরা, এমনকি পরবর্তী কালের কেউ কেউ ‘বিদ্রোহী’র ভাষা, পুরাণ ও সাময়িকতাকে বুঝতে পারলেও রাজনৈতিক নন্দনতত্ত্বকে অনুভব করতে পেরেছিলেন বলে মনে হয় না।
নজরুলের রূপান্তরহীনতা নির্দেশ করে বুদ্ধদেব বসু তাঁকে বলেছিলেন ‘প্রতিভাবান বালক’। বিশ শতকের শেষ প্রান্তে হুমায়ুন আজাদ নজরুলকে বলেছেন বড় মাপের ‘পদ্যকার’। এ ধরনের মন্তব্য ভীষণ দুর্বল, অনেকাংশে অনৈতিহাসিক। সাহিত্যকে তাঁরা নিছক সাহিত্যমূল্যের নিরিখে বিচার করেছেন বলে কবিতা, সংস্কৃতি ও নন্দনতত্ত্বের রাজনীতি বুঝতে পারেননি। সে কারণে তাঁদের নজরুল মূল্যায়ন খণ্ডিত। বাঙালির সাংস্কৃতিক ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, অনেক প্রজন্ম ধরে জনমতের কাছে নজরুলের কবিতা হয়ে গিয়েছিল লেখালেখির মৌলিক মানদণ্ড, কবিতা মানেই ছিল ছন্দোবদ্ধ বিদ্রোহ। অথচ বহু নদী সাঁতরে নানা দিকে প্রবাহিত হয়েছে বাংলা কবিতার জল। আমপাঠকের নিশানা হয়তো সেটি নয়; কিন্তু বিচিত্র কবিতাসম্ভারে ঘুরে বেড়ানো দীক্ষিত পাঠকমাত্র জানেন, অনন্ত জলের প্রবাহে ‘বিদ্রোহী’র ভিন্ন রং চেনা যায় সহজেই।