‘বিদ্রোহী’র ছন্দ

‘বল বীর বল উন্নত মম শির’—কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি আমাদের জাগরণের স্মারক। কালজয়ী কবিতাটি নজরুল লিখেছিলেন ১৯২১ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে। সেই হিসাবে এখন ধ্রুপদি এ কবিতার শতবর্ষ। ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় যে মাত্রাবৃত্ত ছন্দ ব্যবহৃত হয়েছে, তার রকমফেরটি আসলে কেমন?

কাজী নজরুল ইসলাম
ছবি: সংগৃহীত

পাঠ্য, উপভোগ্য এবং অননুকরণীয় কবিতা হিসেবে ‘বিদ্রোহী’ ১০০ বছর পরও তরতাজা রয়ে গেছে। এ বাস্তবতা নিজেই জানিয়ে দেয়, ছন্দমিল ও সুর-লয়ের সামঞ্জস্যপূর্ণ আয়োজনেই সম্পন্ন হয়েছিল কবিতাটির নির্মাণকলা। ‘বিদ্রোহী’ বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান ক্ল্যাসিক; আর অন্য যেকোনো ক্ল্যাসিকের মতো এ কবিতাও শরীর ও মনের অভেদ রচনা করেই কেবল এ সাফল্য পেয়েছে। শুরু থেকেই কবিতাটির পাঠকেরা এর বিচিত্র শরীরী প্রতিভায় উচ্ছ্বাস দেখিয়েছেন। কিন্তু এ কবিতায় কাজী নজরুল ইসলাম যে একটি নতুন ছন্দরূপ—সম্ভবত নিজের অজান্তেই—উন্মোচন করেছিলেন, সে কথা প্রচারিত হয়েছে অনেক পরে। আবদুল মান্নান সৈয়দই প্রথমবারের মতো ‘বিদ্রোহী’র শরীর আর বাংলা কবিতার ইতিহাস বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, মুক্তক মাত্রাবৃত্তের কবিতাটি এ জাতীয় ছন্দের প্রথম রচনা। ছয় মাত্রার মুক্তক মাত্রাবৃত্ত। অসমপার্বিক। বিস্তর ভগ্নপর্ব। সঙ্গে অতিপর্বের ছড়াছড়ি। আবার পঙ্‌ক্তিমধ্যস্থিত অতিপর্বের চাপে অনেক সময়ই পঙ্‌ক্তি পড়তে হয় দুই ভাগে ভাগ করে। কয়েকটি পঙ্‌ক্তি উদ্ধৃত করে ব্যাপারটা দেখানো যাক:

‘আমি /প্রভঞ্জনের/ উচ্ছ্বাস, আমি/ বারিধির মহা/ কল্লোল,

আমি /উজ্জ্বল, আমি/ প্রোজ্জ্বল,’ [উদাহরণ: ১]

এখানকার প্রথম পঙ্‌ক্তিতে অতিপর্ব ‘আমি’ আলাদা রেখে পড়লে প্রথম পর্বটি হবে ‘প্রভঞ্জনের’; কিন্তু দ্বিতীয় পর্বের ছয় মাত্রার জন্য ‘উচ্ছ্বাস’–এর সঙ্গে ‘আমি’ যোগ করতে হয়। অথচ, এই ‘আমি’ ‘বিদ্রোহী’ কবিতার কেন্দ্রীয় ভাবপ্রকাশক ধ্রুব পদ। কাজেই সাধারণ সুর ও লয়ের টানে একে পড়লে ছন্দ-সুর বজায় থাকে বটে, ভাবপ্রবাহে বেজায় টান পড়ে। আবদুল মান্নান সৈয়দ পর্ব বিভাজন করতে বলেছেন অনেকটা এভাবে:

‘আমি/ প্রভঞ্জনের/ উচ্ছ্বাস,

আমি/ বারিধির মহা/ কল্লোল,

আমি/ উজ্জ্বল,

আমি/ প্রোজ্জ্বল,’

বাংলা কবিতায় ছয় মাত্রার মাত্রাবৃত্ত তুলনামূলক ধীর লয়ের গীতল ছন্দ। এ ছন্দের প্রচলিত ঢঙে তাই উত্তুঙ্গ তেজ, গতি ও বীর্য সঞ্চার করা সহজ ছিল না। তদুপরি ‘বিদ্রোহী’তে সুরের সম্মোহন প্রবল হলেও সে সুর বিপ্লব ও বিদ্রোহের। সে সুর লড়াই ও যুদ্ধের হুংকার।

তিনি ঠিকই বলেছেন। অন্তর্নিহিত এ গড়নের কারণে কবিতার ছন্দ, সুর, তাল, লয়ে যেসব ঘটনা ঘটে, তার দু-একটি পরে উল্লেখ করছি। আপাতত কবিতার অন্য অংশ থেকে এ প্রস্তাবের যথার্থতা চিহ্নিত করা যাক:

‘আমি উত্থান, আমি পতন, আমি অচেতন-চিতে চেতন,

আমি বিশ্ব-তোরণে বৈজয়ন্তী, মানব-বিজয়-কেতন।’ [উদাহরণ: ২]

এখানকার প্রথম পঙ্‌ক্তির প্রথম পর্ব ‘আমি উত্থান’ ধরলে বা ‘উত্থান, আমি’ ধরলে পরের পর্ব ছয় মাত্রার হয় না। আবার ‘আমি অচেতন-চিতে’ অংশটি নিশ্চিতভাবে ‘আমি’কে আলাদা পড়তে, অর্থাৎ অতিপর্ব হিসেবে পড়তে বাধ্য করে। ব্যাপারটা মোটেই এমন নয় যে একটি পর্বে ছয় মাত্রা হয় না বলেই এভাবে পড়তে হবে। বরং কবিতাটির অন্তর্নিহিত সুর, ঝোঁক ও লয় এভাবে পড়তেই বাধ্য করবে। সে ক্ষেত্রে ওপরের দুই পঙ্‌ক্তির পাঠ বিভাজন হবে এ রকম:

‘আমি/ উত্থান,

আমি/ পতন,

আমি/ অচেতন-চিতে/ চেতন,

আমি/ বিশ্ব-তোরণে/ বৈজয়ন্তী,/ মানব-বিজয়/ কেতন।’

দুটি উদাহরণ থেকেই পরিষ্কার, সম্ভাব্য ক্ষুদ্রতম পঙ্‌ক্তি এবং সে পঙ্‌ক্তিতে একমাত্র পর্বটি ভগ্ন পর্ব—এই বিন্যাস ‘বিদ্রোহী’র খুব অন্তরঙ্গ গড়ন। সে ক্ষেত্রে অতিপর্বের দুই মাত্রা সহায়ক হিসেবে থাকার কারণে পর্বসাম্যে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। কেন ‘বিদ্রোহী’র জন্য এ রকম বিন্যাস অপরিহার্য ছিল, সে বিষয়ে আমরা পরে আসব। আপাতত অতিপর্ব প্রসঙ্গে বলি।

নজরুলের প্রথম পর্বের, অর্থাৎ সফলতম পর্বের, কবিতার এক অনন্য বিশিষ্টতা অতিপর্ব। অন্য কিছু বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে এই অতিপর্বের বিশিষ্টতা মিলেই তৈরি হয়েছে নজরুলের সফলতম কাব্যপর্বের অতুলনীয় ছন্দবৈশিষ্ট্য। এ মর্মে ‘আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে’ কবিতার তিনটি পঙ্‌ক্তি পড়া যাক:

‘আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে—

মোর মুখ হাসে মোর চোখ হাসে মোর টগ্‌বগিয়ে খুন হাসে

আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে।

এখানে দ্বিতীয় পঙ্‌ক্তির অতিপর্বটি আসলে প্রথম পঙ্‌ক্তির ভাঙা পর্বের সঙ্গে মিলে পূর্ণ পর্বের আমেজ তৈরি করে। তৃতীয় পঙ্‌ক্তির বেলায়ও একই কথা খাটে। পরের পঙ্‌ক্তির অতিপর্বগুলোকে আগের পঙ্‌ক্তির সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়ার উপায় নেই। কারণ, তাতে অন্ত্যমিল বিঘ্নিত হয় আর অতিপর্বগুলো নিজ নিজ পঙ্‌ক্তির সঙ্গে অর্থের বাঁধনে বাঁধা। এভাবে পঙ্‌ক্তিগুলোর মধ্যে গভীর পারস্পরিকতা তৈরি হয়, যা পরেরটিকে চুম্বকের মতো টেনে আগেরটির সঙ্গে পড়তে বাধ্য করে। তৈরি হয় গতি। অতিপর্বে সুস্পষ্ট বিরাম নিতে হয় বলে প্রবহমান পয়ারের মতো লম্বা লয়ের কোনো অবকাশই থাকে না। শ্বাসাঘাতবহুল স্বরবৃত্তের সঙ্গে এরূপ দ্রুতগতির চলন যুক্ত হয়ে নিষ্পন্ন হয় উল্লাসমুখর পদপাত।

কাজী নজরুল ইসলাম

‘বিদ্রোহী’ কবিতায় এ বৈশিষ্ট্য থাকলেও ‘আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে’ কবিতার সঙ্গে এ বিষয়ে অন্তত দুটো গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য আছে। প্রথমত, ‘বিদ্রোহী’ স্বরবৃত্তের কবিতা নয়; দ্বিতীয়ত, ‘বিদ্রোহী’তে ব্যবহৃত বেশির ভাগ অতিপর্ব ‘আমি’ হওয়ায় এটি ধ্রুব পদের মতো আচরণ করে এবং অর্থগতভাবে আগের পঙ্‌ক্তির সঙ্গে বেশির ভাগ সময় পাঠ করা যায় না। ‘বিদ্রোহী’ থেকে আরেকটি অংশ উদ্ধার করছি:

‘আমি উত্তর-বায়ু, মলয়-অনিল, উদাস পূরবী হাওয়া,

আমি পথিক-কবির গভীর রাগিণী, বেণু-বীণে গান গাওয়া।’

এখানে দ্বিতীয় পঙ্‌ক্তির অতিপর্ব ‘আমি’ উচ্চারণের দিক থেকে প্রথম পঙ্‌ক্তির সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে না, যদিও দুই পঙ্‌ক্তিতেই ভাঙা পর্বের সংক্ষিপ্তির আমেজ পাওয়া যাচ্ছে। পঙ্‌ক্তি দুটি উচ্চারণগত জোর বা ঝোঁক পাচ্ছে প্রধানত দুটি অতিপর্ব থেকে। তা সত্ত্বেও তিনটি পূর্ণ পর্ব থাকায় এ অংশের গতি তুলনামূলক ধীর। এ লয়ে ‘বিদ্রোহী’ রচিত হতে পারত না। মোটেই বিস্ময়কর নয়, কবিতাটিতে এ গড়নের পঙ্‌ক্তির সংখ্যা অনেক বেশি নয়। আর পরপর কয়েকটি এ ধরনের পঙ্‌ক্তিও খুব দেখা যায় না। আকারের দিক থেকে চোখের দেখায় যেসব পঙ্‌ক্তি এ রকম মনে হয়, সেগুলোর বেশির ভাগই গড়নের দিক থেকে আমাদের পূর্ববর্ণিত গড়নে নিষ্পন্ন। ঠিক এখানেই ‘বিদ্রোহী’ কবিতার অতিবিশিষ্ট যে পঙ্‌ক্তিগড়নের কথা আগে বলা হয়েছে, তার গভীর তাৎপর্য ও অনিবার্যতা রয়েছে।

বাংলা কবিতায় ছয় মাত্রার মাত্রাবৃত্ত তুলনামূলক ধীর লয়ের গীতল ছন্দ। এ ছন্দের প্রচলিত ঢঙে তাই উত্তুঙ্গ তেজ, গতি ও বীর্য সঞ্চার করা সহজ ছিল না। তদুপরি ‘বিদ্রোহী’তে সুরের সম্মোহন প্রবল হলেও সে সুর বিপ্লব ও বিদ্রোহের। সে সুর লড়াই ও যুদ্ধের হুংকার। কাজেই ছয় মাত্রার সমপার্বিক মাত্রাবৃত্ত এ কবিতার জোশ ধারণ করতে পারত না। তাহলে কি স্বরবৃত্ত হতে পারত তুলনামূলক ভালো বিকল্প? সম্ভবত না। নজরুল স্বরবৃত্তকে তাঁর বিপুল প্রকল্পের অধীন করেছেন সত্য; কিন্তু এর তুলনামূলক চটুল ভঙ্গির আধিক্য অস্বীকার করার জো নেই। অন্যদিকে ‘বিদ্রোহী’তে পাচ্ছি এমন বহু পঙ্‌ক্তি, যেগুলো গতি ও স্থিতির মধ্যে আপসরফার মধ্য দিয়েই আকার পেয়েছে। এ দুই বিপরীতের টানে কবিতাটি নিজের ছন্দ হিসেবে একদিকে বেছে নিয়েছে পেশল মাত্রাবৃত্ত, অন্যদিকে অনেকগুলো তুলনারহিত কারিগরির মধ্য দিয়ে ওই মাত্রাবৃত্তের মধ্যেই নিশ্চিত করেছে স্বরবৃত্তের গতি, প্রায় বিরামহীন প্রস্বর, আর যুদ্ধক্ষেত্রের অবিরাম রণভেরীর মতো তুঙ্গ সব মুহূর্ত। দীর্ঘ পঙ্‌ক্তিকে নানাভাবে ছোট করে আনায় এবং ছোট-বড় পঙ্‌ক্তি স্বাধীনভাবে বিন্যস্ত হওয়ায় এ ধরনের বিচিত্র মাত্রা সম্ভবপর হয়েছে। এর এক বাহ্য প্রমাণ এই যে একাধিক প্রস্বরযুক্ত ছোট পঙ্‌ক্তির পরই দীর্ঘ পঙ্‌ক্তি রচিত হয়েছে। যেন–বা পর্যাপ্ত দম নিয়ে তারপর বিস্তারে যাওয়া, যেন সুরের-গতির-প্রস্বরের তুঙ্গ অবস্থাটি শিথিল হওয়ার সুযোগ না পায়।

ওপরে উদ্ধৃত প্রথম উদাহরণটি আবার স্মরণ করা যাক এবং এরপর পড়া যাক পরের পঙ্‌ক্তি:

‘আমি উচ্ছল জল-ছল-ছল, চল-ঊর্মির হিন্দোল্-দোল্।’

আগের চারটি ছোট অংশের পর পাচ্ছি এই পূর্ণ পঙ্‌ক্তি। একটি অতিপর্বসহ সাড়ে তিন পর্বের বিন্যাস। এ পঙ্‌ক্তির অপরাপর কারিগরি ও ভাবের দিকে এখানে আর মনোযোগ দিচ্ছি না। ওপরে আমরা যে দ্বিতীয় উদাহরণটি দিয়েছি, সেখানেও দেখি প্রায় একই ধরনের বিন্যাস। তিনটি ছোট অংশের পর পাচ্ছি পূর্ণ পঙ্‌ক্তি। ছন্দের সঙ্গে উচ্চারণ আর উচ্চারণ-কালের সম্পর্কের কথা মাথায় রাখলে এ রকম বিন্যাসের মর্ম উপলব্ধি করা যাবে।

কিন্তু ছন্দ-সুরের তেজোদীপ্তি অনর্জিতই থেকে যেত, যদি নজরুলের ওই পর্বের শব্দ সঞ্চয়ের বিশেষ প্রবণতা তার সঙ্গী না হতো। অন্ত্যমিলের কথাও এ প্রসঙ্গে স্মরণীয়। এমনিতেই নজরুল অন্ত্যমিলের সম্রাট, যেমনটি বলেছিলেন আবদুল মান্নান সৈয়দ; তার সঙ্গে এখানে ব্যাপকভাবে যুক্ত হয়েছে মধ্যমিল। মধ্যমিলের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হলো এ কারণে যে পঙ্‌ক্তিবিন্যাসের যে প্রধান সূত্রকে আমরা ‘বিদ্রোহী’র ছন্দের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কলা হিসেবে সাব্যস্ত করেছি, মধ্যমিল তার অন্যতম অনুঘটক। মিলের বাইরেও সুরের সম্মোহনই ছিল এ কবিতার শব্দ সঞ্চয়ের প্রধান রীতি। নির্বিচার শব্দ সংগ্রহ এবং গৃহীত শব্দকে সুরের প্রবাহে সমর্পিত করতে পারার সাফল্য ‘বিদ্রোহী’র ছন্দ-সাফল্যের গোপন মন্ত্র। সৈয়দ আলী আহসান লিখেছেন, ‘শব্দকে কাজী নজরুল ইসলাম একটি প্রবল স্রোতোধারার প্রবাহের মতো ব্যবহার করেছেন, যে ভঙ্গিকে ইডিথ সিটওয়েল পর্বতশিখর থেকে নিম্নভূমিতে গড়িয়ে পড়ার ভঙ্গি বলে আখ্যায়িত করেছেন। একটি প্রবল প্রবাহে... কোনো বিশেষ অঞ্চল অথবা উপলখণ্ড অথবা ভঙ্গুর তরঙ্গচূর্ণ—কোনোটাই বিশেষভাবে চোখে পড়ে না, চোখে পড়ে শুধু একটি তীব্র যাত্রা... সমগ্রভাবে এ গতি আমাদের শ্রুতি এবং অনুভূতিতে জাগে।’ নজরুলের কবিতার শব্দস্বভাব, গতি ও সুর সম্বন্ধে এ এক অন্তর্ভেদী অবলোকন। তবু আমরা এ ব্যাপারে একটু ভিন্ন প্রস্তাব করতে চাই। পাহাড়ি নদীর স্রোতোধারার বদলে দুরন্ত সৈনিক দলের অগ্রযাত্রার উপমায় পড়লে তাঁর কবিস্বভাবের অধিকতর কাছাকাছি পৌঁছানো যাবে বলে আমাদের ধারণা। সৈনিক দলের চলার পথ পূর্বনির্ধারিত বা অভ্যস্ত শাসনে বাঁধা থাকে না। প্রতিমুহূর্তের বিচিত্র প্রয়োজনে তাদের সাড়া দিতে হয়। কিন্তু সর্বাবস্থায় সামষ্টিক ঐকতান আর তেজোদীপ্ত গতিটি বলবৎ থাকে। ‘বিদ্রোহী’ ছাড়া ‘অগ্নি-বীণা’র বেশ কয়েকটি কবিতার ছন্দ সম্পর্কেও এ কথা বলা যাবে।

নদীর স্রোতই বলি আর সৈনিকের গতিই বলি, শুধু গতির নিরিখে ‘বিদ্রোহী’র ছন্দের কিনারা করা যাবে না। আগেই ইঙ্গিত দিয়েছি, এর অন্তরে আছে প্রস্বর বা ঝোঁকের প্রবলতা। নজরুলের এ পর্বের আরও অনেক কবিতার মতো ‘বিদ্রোহী’ কবিতায়ও আছে এ বস্তুর বিরামহীন সংস্থান। রবীন্দ্রনাথ লক্ষ করেছিলেন, ব্যঞ্জনান্ত শব্দ প্রাকৃত বাংলার প্রাণ; আর এ ধরনের বৈশিষ্ট্যই বাংলা ছড়ার–ছন্দের প্রবলতার উৎস। ‘বিদ্রোহী’তে প্রাকৃত বাংলার ব্যবহার খুব বেশি নয়। আছে যুক্তব্যঞ্জন ও হলন্ত শব্দের প্রবল প্রতাপ। অতিপর্বের সঙ্গে এ দুই উপাদানের নিপুণ বিন্যাসেই সম্ভব হয়েছে কবিতাটির অবিস্মরণীয় প্রস্বর বা ঝোঁক।

সব কটি বৈশিষ্ট্যই একাকার হয়ে কাজ করেছে মুক্তক মাত্রাবৃত্তের এই অতিবিশিষ্ট রূপে। বস্তুত, ‘মুক্তক’ কথাটি বাংলা ছন্দে সম্ভবত আর কখনো ‘বিদ্রোহী’র মতো তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠেনি।