আধুনিক বাংলা কবিতার ইতিহাসে এককভাবে সবচেয়ে বিস্ময় আর অস্বস্তি তৈরি করা কবিতার নাম ‘বিদ্রোহী’। বাংলা ভাষা যে এতটা আণবিক, দাহ্য আর শক্তিমান, তা আগে কারও জানা ছিল না। ১০০ বছর ধরে ইংরেজ উপনিবেশের গভীর ছায়ার নিচে যে মসৃণ, অভিজাত, প্রসাধিত, ব্যক্তিমুখ্য ও মেনিমুখো কবিতার ধারা গড়ে উঠেছিল, এই কবিতা সেই ধারাকে আঁতকা একটা ধাক্কা দিল। কবিতাকে মাঠে–ময়দানে বহু মানুষের কোলাহলের মধ্যে টেনেহিঁচড়ে নামিয়ে নিয়ে এল। শুধু তা–ই নয়, নজরুলের এ কবিতা এবং এর সহোদরস্থানীয় আরও কবিতা শাসকের গর্দানে দুরমুশ পেটাতে থাকল। এসবই সমকালে একই সঙ্গে বিস্ময় আর অস্বস্তি তৈরি করেছে।
হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের কবি-সাহিত্যিক ও ‘ধর্মপ্রাণ’ মানুষদের একটি অংশ ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় প্রকাশিত নজরুলের ধর্মানুভূতি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। ‘আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান–বুকে এঁকে দিই পদ–চিহ্ন’—এই লাইন নিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি মহলে কাড়ানাকাড়া বেজে ওঠে। আবার ‘খোদার আসন “আরশ” ছেদিয়া/উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ব-বিধাতৃর!’—চরণটিকে গর্হিত জ্ঞান করে ‘বিদ্রোহী’ প্রকাশের মাসখানেকের মধ্যে কবি গোলাম মোস্তফা সওগাত পত্রিকায় ‘নিয়ন্ত্রিত’ নামে একটি প্যারোডিতে বলেন, ‘ওগো “বীর”!/সংযত কর, সংহত কর “উন্নত” তব শির।’ ইসলাম-দর্শন পত্রিকায় মুনশী রেয়াজুদ্দিন আহমদ লেখেন, ‘লোকটা মুসলমান না শয়তান’। পত্রিকাটির সম্পাদক আবদুল হাকিম তাঁর প্যারোডি কবিতায় নজরুলকে বলেছেন, ‘বেল্লিক বেঈমান’, ‘নমরুদ’, ‘ফেরাউন’, ‘ভ্রাতৃদ্রোহী বিভীষণ’।
শনিবারের চিঠির ‘বিদ্রোহী সংখ্যা’তেই প্রকাশিত হয় ‘বিদ্রোহী’র বিখ্যাত প্যারোডি ‘ব্যাং’। এটি রচনা করেন সজনীকান্ত দাস। একই সংখ্যায় প্রকাশিত হয় যোগানন্দ দাস, সজনীকান্ত দাস ও অশোক চট্টোপাধ্যায়ের সম্মিলিত প্যারোডি ‘আমি বীর’। সজনীকান্ত তাঁর আত্মস্মৃতি গ্রন্থে দাবি করেছেন, রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘ব্যাং’ প্যারোডিকে ‘ভালো’ বলে প্রশংসা করেছিলেন। ছদ্মনামে প্রকাশিত হওয়ায় নজরুল ধারণা করেছিলেন ‘ব্যাং’ মোহিতলাল মজুমদারের লেখা। ফলে একসময়ের ঘনিষ্ঠজন ও শুভাকাঙ্ক্ষী মোহিতলালকে মাথায় রেখে রচিত ‘সর্ব্বনাশের ঘণ্টা’ কবিতায় লেখেন, ‘মিত্র সাজিয়া শত্রু তোমারে ফেলেছে নরকে টানি,/ঘৃণার তিলক পরাল তোমারে স্তাবকের শয়তানী!’ এই কবিতা পড়ে মোহিতলাল ‘দ্রোণগুরু’ কবিতাটি লেখেন। কবিতাটি শনিবারের চিঠির ‘বিশেষ বিদ্রোহ সংখ্যা’য় ছাপা হয়। সেখানে তিনি নিজের ব্রাহ্মণত্বে ভর করে নজরুলকে মূলত অভিসম্পাতই করেছেন। বলেছেন, ‘আমি ব্রাহ্মণ, দিব্যচক্ষে দুর্গতি দেখি তোর/অধঃপাতের দেরি নাই আর, ওরে হীন জাতি-চোর।’ সজনীকান্ত দাস একে ‘বাংলা সাহিত্যে অভিশাপের একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ’ বলে চিহ্নিত করেছেন তাঁর আত্মস্মৃতি গ্রন্থে। শনিবারের চিঠি মাঝে বন্ধ থেকে ১৩৩৪ সালের ভাদ্র মাস থেকে মাসিক আকারে বের হতে থাকে। এবারও প্রথম সংখ্যাতেই আবার ‘বিদ্রোহী’ কবিতার প্যারোডি প্রকাশিত হয়। কবিতার নাম ‘তোমাদের প্রতি’।
নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা নিয়ে যে ব্যঙ্গ সমকালে প্রকাশিত হয়েছে, তার পেছনে নন্দনতাত্ত্বিক রাজনীতির বিষয়টি নিয়ে সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ আছে। কারণটা দানা বাঁধে তখনই যখন শনিবারের চিঠি ও সজনীকান্ত কেবল ‘বিদ্রোহী’ কবিতার প্যারোডি লিখেই থেমে থাকেননি; কল্লোল, কালি-কলম ও নজরুলের বিরুদ্ধে ১৯২৬ সালে সজনীকান্ত এক চিঠিও লেখেন রবীন্দ্রনাথকে। সেই চিঠির জবাবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে কথা বলেছেন, তা আমাদের এ আলোচনার জন্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি বলেছেন, ‘আধুনিক সাহিত্য আমার চোখে পড়ে না। দৈবাৎ কখনো যেটুকু দেখি, দেখতে পাই, হঠাৎ কলমের আব্রু ঘুচে গেছে। আমি সেটাকে সুশ্রী বলি এমন ভুল করো না।...আলোচনা করতে হলে সাহিত্য ও আর্টের মূলতত্ত্ব নিয়ে পড়তে হবে।’ অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত তাঁর কল্লোল যুগ বইয়ে জানাচ্ছেন, ‘নিজের মুখে কারণে-অকারণে সে [নজরুল] স্নো ঘষত খুব, কিন্তু তার কবিতার এতটুকু প্রসাধন করতে চাইত না। বলত, অনেক ফুলের মধ্যে থাক না কিছু কাঁটা, কণ্টকিত পুষ্পই তো নজরুল ইসলাম। কিন্তু মোহিতলাল তা মানতে চাইতেন না। নজরুলের গুরু ছিলেন এই মোহিতলাল।’ এই যে রবীন্দ্রনাথ কথিত ‘আব্রু ঘুচে যাওয়া’ আর মোহিতলালের কবিতাকে প্রসাধিত করার অবস্থান এবং নজরুলের বিপরীত অবস্থান—নন্দনতত্ত্বের এ এক জমাট রাজনৈতিক বাহাসই বটে। মনে রাখতে হবে, রবীন্দ্রনাথ, সজনীকান্ত, মোহিতলাল প্রমুখের নন্দনতাত্ত্বিক ঘরানাটিই বিগত ১০০ বছরের সাহিত্যকে নিয়ন্ত্রণ করে এসেছে। নজরুলের ‘বিদ্রোহী’সহ অনেক কবিতা ওই ধারার বাইরের বলে সমকালে অনেকের মধ্যেই তা অস্বস্তি আর ব্যঙ্গকে উসকে দিয়েছিল।
বিষয়টি স্পষ্ট করার জন্য ‘বিদ্রোহী’ কবিতার কিছু প্যারোডির ভেতরে ঢোকা যেতে পারে। ‘ব্যাং’ প্যারোডির এক জায়গায় সজনীকান্ত বলেছেন, ‘আমি ...গেয়ে যাই গান/“আসমান”/ফেড়ে ফেড়ে/মিছে বলে লোক গলাটা আমার হেঁড়ে।’ এই হেঁড়ে গলার বিদ্রূপ বিষয়টা ‘প্রসাধনের’ আর ‘আব্রু’র পক্ষেই কথা বলেছে। আবার বিদ্রূপ জমাতে আরও এক জায়গায় সজনীকান্ত বলেছেন, ‘আমি ভাদ্রের বান পৌষের শীত/“অরিয়েন্টাল আর্ট” আমি; আমি কালোয়াতি গীত।’ এগুলো সুস্পষ্টভাবে নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার গণমুখী নন্দনতত্ত্বের বিপরীতেই অবস্থান নেয়।
ব্যক্তি নজরুলের প্রতিভা সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের মনে কোনো সংশয় ছিল না। তিনি নজরুলকে প্রশ্রয়ও দিয়েছেন অন্য অনেকের চেয়ে বেশি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের কাছে যখন বারবার সজনীকান্তরা কল্লোল, কালি-কলম আর নজরুল সম্পর্কে বিষোদ্গার করে ধরনা দিচ্ছেন, তখন ১৩৩৪ সালের শ্রাবণ সংখ্যা বিচিত্রায় রবীন্দ্রনাথ ‘সাহিত্যধর্ম’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘মত্ততার আত্মবিস্মৃতিতে একরকম উল্লাস হয়; কণ্ঠের অক্লান্ত উত্তেজনায় খুব একটা জোরও আছে, মাধুর্যহীন সেই রূঢ়তাকেই যদি শক্তির লক্ষণ ব’লে মানতে হয় তবে এই পালোয়ানির মাতামাতিকে বাহাদুরি দিতে হবে সে কথা স্বীকার করি।’ রবীন্দ্রনাথের এই খোঁচার মাথায় নজরুলও যে আছেন, তাতে সন্দেহ নেই। এই নন্দনতত্ত্বের সঙ্গই ‘বিদ্রোহী’ কবিতার প্যারোডিগুলো গাঁটছড়া বাঁধা।
পৃথিবীতে নিরপরাধ ঠাট্টা বলে আদৌ কিছু আছে কি! আসলে ‘বিদ্রোহী’ কবিতার ভেতর দিয়ে নজরুল এতকাল দাঁড়িয়ে থাকা সাহিত্যের প্রাসাদটিতে দারুণ এক কাঁপুনি লাগিয়ে দিয়েছিলেন। অভ্যস্ত উপনিবেশিত মনে ও তজ্জাত নন্দনতত্ত্বে এক অনভ্যস্ততার ধাক্কা দিয়েছিলেন। এ ধাক্কার প্রকাশ হিসেবেই সমকালে ‘বিদ্রোহী’ কবিতাকে কেন্দ্র করে জমে উঠেছিল ঠাট্টা-তামাশা-প্যারোডির পসার।
কুদরত-ই-হুদা: শ্রীনগর সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক