লেখকদের নিয়ে যত ঘটনা-৫: কবি মহাদেব সাহার চায়না বিল্ডিংয়ের বাসা

কবি ও কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক ঢাকা শহরে এসেছিলেন আশির দশকে, রংপুর থেকে। পণ করেছিলেন লেখক হবেন। প্রখ্যাত লেখকদের অনেক মজার ঘটনার তিনি সাক্ষী। এই নিয়মিত কলামে তিনি বিখ্যাত মানুষদের জীবনের মজার ঘটনাগুলোর স্মৃতিচারণা করবেন। অন্য আলো ডটকমে এটি প্রতি মঙ্গলবার প্রকাশিত হচ্ছে।

গ্রাফিকস: আমিনুল ইসলাম

আমি উচ্চমাধ্যমিক পাস করি ১৯৮৩ সালে। বছরখানেক বসে থাকার পর আমাদের ক্লাস শুরু হয় ১৯৮৪তে। শহীদ স্মৃতি হলে থাকি। কবি হতেই হবে—এই হলো আমার প্রতিজ্ঞা। একটা নোট বইয়ে আমি লিখি: ১. ফার্স্ট ইয়ারে আমি জয় করব আমার হল।
২. সেকেন্ড ইয়ারে আমি সীমানা বাড়াব সমস্ত বুয়েট।
৩. থার্ড ইয়ারে বেরিয়ে পড়ব ঢাকায়।
৪. ফোর্থ ইয়ারে টার্গেট সারাটা দেশ।

হলে সাহিত্য সাংস্কৃতিক সপ্তাহ হচ্ছে। আমি নানা বিষয়ের প্রতিযোগিতায় অংশ নিই। ব্যাপক প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় চম্পক ভাইয়ের সঙ্গে। শেষে চ্যাম্পিয়ন হই। রচনা প্রতিযোগিতা, কবিতা, ছোট গল্প—তিনটাতেই ফার্স্ট হই। কবিতার বিচারক ছিলেন কবি মহাদেব সাহা। তিনি মন্তব্য করেন, আনিসুল হক মিটুন ছেলেটা কে? এর কবিতা কবিদের মতো। শুনে আমি মহাদেব সাহার সঙ্গে দেখা করতে যাই। সেটা কি তাঁর আজিমপুর চায়না বিল্ডিংয়ের গলির বাসায়, নাকি ‘ইত্তেফাক’ অফিসে তাঁর চেম্বারে, তা আর মনে করতে পারছি না। প্রথম দেখাতেই মহাদেব সাহা সেই একই কথা বলেন, তোমার কবিতা তো কবিদের মতো। আমি বলেছি...আমি বলেছি...আনিসুল হক মিটুন ছেলেটা কে?

এরপর থেকে আমি নিয়মিতভাবে মহাদেবদার বাসায় যাতায়াত শুরু করি। তাঁর স্ত্রী নীলা বৌদি পাতলা করে মাছের ঝোল রাঁধতেন। আমি ওই বাসায় গেলে ভাত খেয়ে তবে হলে ফিরতাম। মহাদেবদার দুই ছেলে—তীর্থ সাহা, সৌধ সাহা। তখন তারা এত্তটুকুন। তারা আমাকে ডাকে মিটুন কাকু বলে। মহাদেবদার ঘরে বিশাল বইয়ের আলমারি। তাতে নানা রকমের ইংরেজি বই। আমি হাঁ করে দেখি। দাদা বলেন, মিটুন, তীর্থ আর সৌধর জন্য টিচার লাগবে। বুয়েটে তোমার কোনো বন্ধুবান্ধবকে দাও। আমি আমার বন্ধু মাহমুদ আলমকে সঙ্গে করে নিয়ে যাই। মাহমুদ এই বাড়িতে টিউটরের কাজ করতে থাকে। তাতে আমার আরও সুবিধা হয়। মহাদেবদার বাড়িতে প্রায় নিয়মিত হাজিরা দিতে কোনো উপলক্ষ লাগে না।

দাদা পরেন খদ্দেরের পাঞ্জাবি। সঙ্গে প্যান্ট। চুল লম্বা রাখেন। মোটা ফ্রেমের চশমার নিচে বড় বড় ভেজা দুটো চোখ। মানুষ হিসেবে এত নরম! আমি আমার চেয়েও নরম মানুষ ঢাকায় একজনকেই দেখেছি, তাঁর নাম মহাদেব সাহা। কবিতাও লেখেন খুব নরম। তাঁর একটা কবিতা আছে, করুণা করে হলেও চিঠি দিও। কবিতাটি তুলে দেওয়া যাক:

চিঠি

করুণা করে হলেও চিঠি দিও, খামে ভরে তুলে দিও
আঙুলের মিহিন সেলাই

ভুল বানানেও লিখো প্রিয়, বেশি হলে কেটে ফেলো তাও,
এটুকু সামান্য দাবি, চিঠি দিও, তোমার শাড়ির মতো
অক্ষরের পাড়-বোনা একখানি চিঠি।

চুলের মতন কোনো চিহ্ন দিও বিস্ময় বোঝাতে যদি চাও…
বর্ণনা আলস্য লাগে তোমার চোখের মতো চিহ্ন কিছু দিও!

আজও তো অমল আমি চিঠি চাই, পথ চেয়ে আছি,
আসবেন অচেনা রাজার লোক
তার হাতে চিঠি দিও, বাড়ি পৌঁছে দেবে…
এমন ব্যস্ততা যদি শুদ্ধ করে একটি শব্দই শুধু লিখো, তোমার কুশল!…

করুণা করে হলেও চিঠি দিও, ভুলে গিয়ে ভুল করে একখানি চিঠি
দিও খামে
কিছুই লেখার নেই তবু লিখো একটি পাখির শিস
একটি ফুলের ছোট নাম,

টুকিটাকি হয়তো হারিয়ে গেছে কিছু, হয়তো পাওনি খুঁজে
সেই সব চুপচাপ কোন দুপুরবেলার গল্প
খুব মেঘ করে এলে কখনো কখনো বড় একা লাগে, তাই লিখো

করুণা করে হলেও চিঠি দিও, মিথ্যা করে হলেও বোলো, ভালোবাসি!

কবি মুহাম্মদ সামাদ ভাই বলেন, মহাদেবদার এই কবিতাটা কিন্তু খুব ভালো। এত নরম!
এত নরম যে আমার মতো নরম মানুষের কাছেও এটাকে বেশি নরম বলে মনে হয়। মনে হয়, করুণা করে লেখা চিঠি আমি কেন নেব।

মহাদেব সাহা একদিন বলেছিলেন, এই যে আমি সারাটা জীবন পাঞ্জাবি পরলাম, চুল বড় রাখলাম, এর কি কোনো মানে নেই? আমার কি শার্টপ্যান্ট, জিনস পরতে ইচ্ছা করেনি। পরিনি, কারণ কবি হতে চেয়েছি।

আমি মনে করি, মহাদেবদার এই কথার একটা তাৎপর্য আছে। আজকালকার বিজনেস-পড়া ছেলেমেয়েরা বলবে, এর নাম হলো ব্র্যান্ডিং। ব্র্যান্ডিং ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলামকে দেখলেই আমরা বুঝব, তাঁরা কবি। চুল বড় না রাখলেও কবি হওয়া যায়। জীবনানন্দ দাশ যেমনটা ছিলেন। তবুও নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহার চেহারা দেখলেই লোকে বুঝে নেবে, এঁরা কবি বা শিল্পী। আবার আইয়ুব বাচ্চু বা জেমসকে দেখলেই বোঝা যাবে, এঁরা ব্যান্ড গায়ক। আপনি যখন এই মেকাপ-গেটাপটা নেন, তখন আপনি ২৪ ঘণ্টাই নিজেকে বলতে পারেন, আমি কবি। আমি শিল্পী। আয়নার সামনে দাঁড়ালেই আপনি নিজের ব্রতটাকে চিনে নিতে পারেন। আপনার তখন সংকল্পচ্যুত হওয়ার সম্ভাবনা কমে আসে।

মহাদেব সাহা
ছবি: সংগৃহীত

শিল্প-সাহিত্য প্রায় অর্থহীন এবং অপ্রয়োজনীয় জিনিস। একটা মানুষ কোনো বই না পড়ে, কোনো পেইন্টিংয়ের মর্ম না বুঝেই খুব সফল জীবন যাপন করতে পারে। কবিতা ছাড়াও বেশ বাঁচা যায়। যৌবনে প্রায় সবাই কবি। আপনি চল্লিশ বছর বয়সের পরেও কবিতা লেখেন কি না, সেটা হলো আসল। আপনার চাল-চলন, পোশাক-আশাকের মধ্য দিয়ে আপনার ব্যক্তিত্ব তৈরি হয়, প্রকাশিতও হয়।

মহাদেব সাহা আমাকে আরেকটা উপদেশ দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, কবি যদি হতে চাও, গদ্য লিখবে না। একবার গদ্য লিখতে শুরু করলে যত ভালো কবিতাই লেখো না কেন, লোকে তোমাকে আর কবি হিসেবে মানতে চাইবে না। আমি তাঁর উপদেশ শুনিনি। তার প্রতিফলও আমি হাড়ে হাড়ে বুঝছি।

মহাদেবদার দুটো কবিতার কোনো তুলনা হয় না। ‘কফিনকাহিনী’ আর ‘তোমার বাড়ি’। দুটো কবিতাই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা। এ কবিতা দুটিও পড়ে ফেলি, চলুন:

কফিনকাহিনী

চারজন দেবদূত এসে ঘিরে আছে একটি কফিন
একজন বলল, দেখো ভিতরে রঙিন
রক্তমাখা জামা ছিল হয়ে গেছে ফুল
চোখ দুটি মেঘে মেঘে ব্যথিত বকুল!
চারজন দেবদূত এসে ঘিরে আছে এক শবদেহ
একজন বলল, দেখো ভিতরে সন্দেহ
যেমন মানুষ ছিল মানুষটি নাই
মাটির মানচিত্র হয়ে ফুটে আছে তাই!
চারজন দেবদূত এসে ঘিরে আছে একটি শরীর
একজন বলল, দেখো ভিতরে কী স্থির
মৃত নয়, দেহ নয়, দেশ শুয়ে আছে
সমস্ত নদীর উৎস হৃদয়ের কাছে!
চারজন দেবদূত এসে ঘিরে আছে একটি কফিন
একজন বলল, দেখো ভিতরে নবীন
হাতের আঙুলগুলি আরক্ত করবী
রক্তমাখা বুকজুড়ে স্বদেশের ছবি!

তোমার বাড়ি

এই বাড়িটি একলা বাড়ি কাঁপছে এখন চোখের জলে
ভালোবাসার এই বাড়িতে তুমিও নেই, তারাও নেই!
এই বাড়িটি সন্ধ্যা-সকাল তাকিয়ে আছে নগ্ন দুচোখ
একলা বাড়ি ধূসর বাড়ি তোমার স্মৃতি জড়িয়ে বুকে
অনাগত ভবিষ্যতের দিকেই কেবল তাকিয়ে থাকে,
কেউ জানে না এই বাড়িটি ঘুমায় কখন, কখন জাগে
স্তব্ধ লেকের কান্নাভেজা এই বাড়িটি রক্তমাখা!
এই বাড়িতে সময় এসে হঠাৎ কেমন থমকে আছে
এই বাড়িটি বাংলাদেশের প্রাণের ভিতর মর্মরিত,
এই বাড়িতে শহীদমিনার, এই বাড়িতে ফেব্রুয়ারি
এই বাড়িটি স্বাধীনতা, এই বাড়িটি বাংলাদেশ
এই বাড়িটি ধলেশ্বরী, এই বাড়িটি পদ্মাতীর
এই বাড়িটি শেখ মুজিবের, এই বাড়িটি বাঙালির!

মহাদেব সাহা কাজ করতেন দৈনিক ‘ইত্তেফাক’–এ। সহকারী সম্পাদক। সম্পাদকীয় লিখতেন, উপসম্পাদকীয় লিখতেন। রিকশায় করে আজিমপুর থেকে টিকাটুলী যেতেন। সপ্তাহে গোটা দুয়েক লেখা লিখতে হতো। যেদিন তাঁর লেখা থাকত, সেদিন সকাল থেকে বলতে শুরু করতেন, আজকে আমার লেখা আছে। আজকে আমার লেখা আছে।

কী আরামের চাকরিই না তাঁরা করতেন।

একবার বইমেলায় মহাদেবদার কবিতার বই বেরোল, ‘আমি ছিন্নভিন্ন’। সেবারই নির্মলেন্দু গুণেরও কবিতার বই প্রকাশিত হলো, ‘দুঃখ কোরো না, বাঁচো’ নামে। মহাদেবদার দুই ছোট্ট ছেলে তীর্থ আর সৌধ বইমেলায় এলে আমরা তাঁদের বললাম, দেখেছ, তোমাদের নির্মল কাকু তোমাদের বাবাকে বলেছেন, দুঃখ কোরো না, বাঁচো। তীর্থ বলল, পড়ে দেখুন, ঠিকই আছে!

নির্মলেন্দু গুণ মহাদেবদা সম্পর্কে বলতেন, মহাদেব আসলে মহৎ হতে চায়, অমর হতে চায়।

আমি নিয়মিতভাবে মহাদেবদার বাসায় যাতায়াত শুরু করি। তাঁর স্ত্রী নীলা বৌদি পাতলা করে মাছের ঝোল রাঁধতেন। আমি ওই বাসায় গেলে ভাত খেয়ে তবে হলে ফিরতাম। মহাদেবদার দুই ছেলে—তীর্থ সাহা, সৌধ সাহা। তখন তারা এত্তটুকুন। তারা আমাকে ডাকে মিটুন কাকু বলে। মহাদেবদার ঘরে বিশাল বইয়ের আলমারি। তাতে নানা রকমের ইংরেজি বই। আমি হাঁ করে দেখি। দাদা বলেন, মিটুন, তীর্থ আর সৌধর জন্য টিচার লাগবে। বুয়েটে তোমার কোনো বন্ধুবান্ধবকে দাও। আমি আমার বন্ধু মাহমুদ আলমকে সঙ্গে করে নিয়ে যাই। মাহমুদ এই বাড়িতে টিউটরের কাজ করতে থাকে। তাতে আমার আরও সুবিধা হয়। মহাদেবদার বাড়িতে প্রায় নিয়মিত হাজিরা দিতে কোনো উপলক্ষ লাগে না।

গুণদা জীবনকে নিয়ে অনেক ছিনিমিনি খেলেছেন। গুণদার কথা এমন, জীবনে খুব মূল্যবান দুটো বিষয় নিয়ে আমি হেলাফেলা করেছি, টাকা আর নারী। কথা সত্য। গুণদা বল্গাহীন জীবন যাপন করেছেন, আবার সেসব তিনি অকপটে নিজের আত্মজীবনীতে কিংবা কবিতায় লিখে রেখে গেছেন। মহাদেবদা অনেক শুদ্ধাচারী। তাঁকে দেখেছি, বোতলে করে ফোটানো পানি নিয়ে বেরোতেন। এর আগে আমার ধারণা ছিল না যে বিশুদ্ধ পানি সঙ্গে করে নিয়ে বের হতে হয়। আমরা তো হলের ক্যানটিনের চৌবাচ্চায় জমানো পানি গেলাসে করে খেতাম। কোনো সমস্যা মনে করতাম না। এখন অবশ্য নিজেই বোতলের পানি ছাড়া খাই না।

একদিন ২৫ মার্চে ‘ইত্তেফাক’ থেকে তাঁকে বলা হলো, সম্পাদকীয় লিখুন কাঁচা পায়খানা নিয়ে।

মহাদেবদা বললেন, ২৫ মার্চ কাঁচা পায়খানা নিয়ে সম্পাদকীয় হতে পারে না। আমি পারব না। বরং ওই কাজটা করে দিতে পারব।

মহাদেবদা আরেকটা কবিতা লিখেছিলেন একেবারে লক্ষ্যভেদী। ‘বাংলাদেশ চায় না তোমাকে তুমি চলে যাও’:

বাংলাদেশ চায় না তোমাকে, তুমি চলে যাও, যাও
কত যে মায়ের খালি বুক ফেলে দীর্ঘশ্বাস—
রক্তমাখা হাত, তুমি ক্ষমা চাও, ক্ষমা ভিক্ষা চাও।
তোমাকে চায় না এই সোনালি ধানের ক্ষেত, কচি দূর্বা, দীর্ঘ শালবন...
এটা তিনি লিখেছিলেন নব্বইয়ের গণ–আন্দোলনের তুঙ্গ মুহূর্তে। এটা লিফলেট পোস্টার করে মিছিলে মিছিলে বিলি করা হয়েছিল।

মহাদেব সাহা এখন আরও নরম হয়ে গেছেন। স্বাধীনতা পুরস্কার পেলেন, সেটা নিতেও তিনি যাননি। তিনি বলেন যে তাঁর শরীরটা ভালো নেই। কোথাও বের হন না। তাঁর জন্মদিনে একটা লেখা লিখেছিলাম, পড়ে তিনি কাঁদতে লাগলেন। মিটুন, তোমরা আমাকে এত ভালোবাসো, এত ভালোবাসো! মহাদেব সাহা যাতে স্বাধীনতা পুরস্কার পান, সে জন্য আমি ফেসবুকে ব্যাপক আন্দোলন করেছিলাম!

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে মহাদেব সাহার একটা মূল্যায়ন জানতে পেরেছিলাম তাঁর সঙ্গে আড্ডায়। তিনি বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধু ছাড়া আর কে আমাদের দিয়েছে ধর্মনিরপেক্ষতা? আর কে দিতে চেয়েছে সমাজতন্ত্র! তাঁকে ভালোবাসব, না তো কাকে ভালোবাসব!

আমি মনে করি, বঙ্গবন্ধুকে বোঝার জন্য এই উপলব্ধিটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দুটো মাত্র বাক্য, কিন্তু এর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সারা জীবনের সাধনার, অভীষ্টের একটা বড় পরিচয় খুব সহজে স্পষ্ট হয়!