আত্মজীবনীতে ২০২১ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত জীবন নদীর বাঁকে বাঁকে গ্রন্থটি লিখেছেন সুফিয়া খাতুন। জন্ম ১৯২৩ সালে ময়মনসিংহে, খরস্রোতা ব্রহ্মপুত্রের তীরে। বিদুষী এই লেখকের জীবন-আলেখ্যর নামকরণে তাই ‘নদী’ শব্দটি পেয়েছে প্রতীকী তাৎপর্য। দেশ ও বিদেশের নানা স্থানে জীবন কেটেছে তাঁর। শৈশব ও কৈশোরে বাবার, বিয়ের পর স্বামীর চাকরিসূত্রে এবং পরবর্তী জীবনে ছেলেমেয়েদের জন্য তিনি হেঁটেছেন পৃথিবীর পথে পথে। এ যাত্রায় তাঁর অভিজ্ঞতা বিচিত্র। নদীর মতো প্রবহমান সেই জীবনের বিভিন্ন ধাপ ও মোড় পরিবর্তনের ইতিবৃত্ত তিনি তুলে এনেছেন তাঁর বইয়ে।
বইটির সময়কাল ১৯৩০ থেকে ২০০৩ সাল। সময়ের এই পরিসরে একজন সাধারণ নারীর অসাধারণ হয়ে ওঠার গল্প রচিত হয়েছে জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, ভালো-মন্দ মিলিয়ে। তবে ব্যক্তির জীবন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সমাজঘনিষ্ঠ। তাই আত্মজীবনীটিতে শুধু ব্যক্তিগত ঘটনাই নয়, বরং একটা দীর্ঘ সময়ব্যাপী দেশের আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটের একটি প্রচ্ছন্ন ছায়াপাত আছে। সরল গদ্যধর্মী ঢঙে তিনি নিজের ও ভাইবোনদের জন্ম এবং বেড়ে ওঠার ছবিগুলো মূর্ত করেছেন আত্মীয়স্বজন পরিবেষ্টিত এক আন্তরিক পরিমণ্ডলে। নানাবাড়ি ভুবনঘর আর দাদাবাড়ি অষ্টগ্রাম ঘিরে কেটেছে সুফিয়া খাতুনের জীবনের রঙিন দিনগুলো।
বইটি পড়তে পড়তে পাঠকের চোখের সামনে কখনো ভেসে উঠবে ব্যারাকপুর, কলকাতা, কৃষ্ণনগর, মুর্শিদাবাদ থেকে শুরু করে কুমিল্লা, পাবনা, বরিশাল, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধাসহ দেশের নানা স্থান। আবার কখনো তাঁদের নিয়ে যাবে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ডসহ বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় লেখকের জীবনের অতিবাহিত দিনগুলোতে। তিলোত্তমা ঢাকা শহর প্রায় গড়ে উঠতে দেখা যায় এই আত্মজীবনীর পাতায় পাতায়।
গ্রামীণ জীবন, মানুষে মানুষে আন্তরিক সম্পর্ক, খাবারদাবার, নানা উৎসব আয়োজন উঠে এসেছে লেখকের প্রাণবন্ত বর্ণনায়। আবার তাঁর পরিবারের সদস্যদের মৃত্যুর বর্ণনাগুলো কখনোবা অশ্রুসিক্ত করে তোলে। সুফিয়া খাতুনের বাবা, মা, মাতামহী, দাদা, জীবনসঙ্গী, বাল্যকালের গৃহশিক্ষক কফিলউদ্দীনসহ সবাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিচরণ করেছে আত্মজীবনীটির পৃষ্ঠাজুড়ে। উঠে এসেছে মুনীর চৌধুরীসহ বিভিন্ন বিখ্যাত ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর হৃদ্যতার সম্পর্কের নানা প্রান্ত।
এই আত্মজীবনীতে কালের যে বিস্তৃতি, সেখানে স্বভাবতই স্থান পেয়েছে ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ পালাবদলগুলো। মুসলিম সমাজে নবজাগরণ, সমাজে হিন্দু-মুসলমান সহাবস্থান ও পরবর্তী সময়ে দাঙ্গা, কলেরা মহামারি, দুর্ভিক্ষ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দেশভাগ, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, সামরিক শাসন, বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা—প্রায় সব ঘটনারই সাক্ষী তিনি।
বইয়ের শেষে বলেছেন, ‘জীবননদী বয়ে যাচ্ছে নিরবধি আর বাঁকে বাঁকে সঞ্চয় করেছে বিচিত্র সম্ভার।’ এটি পড়লে বোঝা যায় একজন নারী ও পরবর্তী জীবনে একজন সফল স্কুলশিক্ষক হিসেবে তাঁর অভিজ্ঞতাগুলো ছিল জীবনমুখী। সমাজসেবাধর্মী নানা কর্মকাণ্ডেও নিয়োজিত ছিলেন তিনি। গড়ে তুলেছিলেন ‘উষা মৈত্রী’ ও ‘হেমন্তিকা’ নামের সংগঠন। একজন নারী হিসেবে সমাজ, সম্পর্ক ও মানুষকে দেখার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ছিল লেখকের। সাবলীল বর্ণনায় তাই ফুটে উঠেছে তাঁর ইতিবাচকতা ও কল্যাণকামী জীবনদর্শন। ফলে আত্মজীবনীর বলয় অতিক্রম করে এটি হয়ে উঠেছে সমকালীন সমাজ ও ইতিহাসকে দেখার এক আয়না। পাশাপাশি একজন নারী হিসেবে রক্ষণশীল মুসলিম পরিবার থেকে উঠে এসে ধীরে ধীরে সমাজের কেন্দ্রে নিজের আত্মপ্রতিষ্ঠার যে দৃঢ় ভূমিকার কথা তিনি উল্লেখ করেছেন, তা নারী ক্ষমতায়নে আগ্রহী যেকোনো পাঠক ও গবেষককে অনুপ্রাণিত করবে।
জীবন নদীর বাঁকে বাঁকে
সুফিয়া খাতুন
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা
প্রকাশকাল: মার্চ ২০২২
প্রচ্ছদ: মাহ্বুব রহমান
৬৪০ পৃষ্ঠা, দাম: ৮৫০ টাকা।
বইটি পাওয়া যাচ্ছে
prothoma.com এবং মানসম্মত
বইয়ের দোকানে।