অনলাইনে পাঠকেরা কীভাবে পড়েন

প্রযুক্তির নতুন দুনিয়ায় এখন বদলে গেছে পাঠকের পড়ার রীতিনীতি। স্বভাবতই অনলাইনে সাহিত্যপাঠের ক্ষেত্রেও এর প্রভাব পড়েছে। অনলাইনে এখন পাঠকেরা কীভাবে পড়েন? পড়ার ধরন, পাঠের বিষয়বস্তু ও অনলাইন উপস্থাপনায় বৈচিত্র্যের কারণে পাঠকের মনস্তত্ত্বে কি কোনো প্রভাব পড়েছে? কোনো একটা লেখা পড়ার ক্ষেত্রে কী কী বিষয় মাথায় থাকে পাঠকের? বিভিন্ন গবেষণা, পরিসংখ্যান ও অনলাইনে পড়ুয়াদের মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ করে প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার চেষ্টা।

অলংকরণ: আরাফাত করিম

ইন্টারনেটে মানুষ সবচেয়ে বেশি সময় কাটায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। বিশ্বের প্রতি দুজনের মধ্যে একজনের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট আছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪ কোটি ৩২ লাখ। (সূত্র: স্টেসি জো ডিক্সন, ২৯ আগস্ট, ২০২৩) ফেসবুকে এই ব্যবহারকারীরা মূলত একে অন্যের মধ্যে লেখা, ছবি ও ভিডিও শেয়ার করেন; কখনো কখনো এসব শেয়ার করা হয় না-পড়ে, না-শুনে, এমনকি না-দেখেও! অনলাইনের পাঠকদের এই আচরণকে অনেকেই মজা করে বলে থাকেন—‘এটাই সায়েন্স’!

কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও মাইক্রোসফটের গবেষকেরা দেখেছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করা ১০০ লিংকের মধ্যে ৫৯টি লিংকেই শেয়ারকারী প্রবেশ করেন না! মানে তিনি পড়েন না, দেখেন না বা শোনেন না। তাহলে কীভাবে লিংক শেয়ার করেন তাঁরা? কখনো শিরোনাম দেখে, কখনো থাম্বনেইলের ছবি দেখে কিংবা কখনো কনটেন্ট বা আধেয় নির্মাতার নাম বা প্রতিষ্ঠান দেখেই সাধারণত বেশির ভাগ শেয়ারের ঘটনা ঘটে। গবেষণা বলছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যবহারকারীরা এ কাজ করেন দুটি কারণে—তাঁরা ভাবেন, এতে তাঁরা ‘বিশেষজ্ঞের পর্যায়ে উন্নীত হচ্ছেন’ অথবা স্রোতের সঙ্গে আছেন। স্রোতের সঙ্গে না থাকার একটা পোশাকি নামও আছে—‘ফোমো’ (ফিয়ার অব মিসিং আউট)। আর এ কারণে আমরা সবাই-ই ঝাঁপিয়ে পড়ে লাইক, শেয়ার করতে ভালোবাসি।

অধুনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এমন প্রবণতা দেখে মনে হতে পারে, অনলাইনে মানুষের পড়ার অভ্যাসের বর্তমান ধরনের জন্য এই মাধ্যমগুলো দায়ী। কিন্তু ২৬ বছর আগে করা নিয়েলসন নর্ম্যান গ্রুপের এক গবেষণা সে কথা বলে না। বিশ্বখ্যাত এ প্রতিষ্ঠান ১৯৯৭ সালে অনলাইনে পড়ুয়াদের পড়ার ধরন নিয়ে একটি গবেষণা করে। এর ২৩ বছর পর ২০২০ সালে তারা আবার একই গবেষণা করেছে। দুই গবেষণাতেই ফুটে উঠেছে একই চিত্র—‘অনলাইনে পড়ুয়ারা আসলে শব্দের পর শব্দ পড়েন না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাঁরা দ্রুত ওয়েবপেজটি স্ক্যান করেন। এভাবে কোথাও চোখ “আটকে” গেলে সেটা নিয়ে ভাবেন কিংবা নিজের দরকারি তথ্যটি পেয়ে গেলে তখন মনোযোগ দেন।’ ২৩ বছর আগে-পরের এ গবেষণায় দেখা গেছে, অনলাইনের ৭৯ শতাংশ ব্যবহারকারীই এ দলের।

এ জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আপনি যখন অনুষ্ঠেয় কোনো অনুষ্ঠানের বর্ণনা দিয়ে লেখেন—‘অনুষ্ঠানটি সবার জন্য উন্মুক্ত’, তখন মন্তব্যে অনেকেই জানতে চান, ‘আমি কি যেতে পারব?’

নিয়েলসন নর্ম্যানের গবেষণাটি করা হয়েছে পড়ার সময় মানুষের চোখের তারার ছোটাছুটি অনুসরণের মাধ্যমে। সেই সঙ্গে দেখা হয়েছে তাঁদের পড়ার ধরনও। আর সেখান থেকেই বেরিয়ে এসেছে চমকপ্রদ সব তথ্য।

ঘাস কাটার যন্ত্র

আরবি, জাপানি—এ রকম কয়েকটি ভাষা ছাড়া অন্যান্য ভাষার পড়ুয়ারা বাঁ থেকে ডানে পড়েন। লাইন শেষ হলে আবার নিচের লাইনে শুরুর বাঁ থেকে পড়তে শুরু করেন। কয়েক হাজার বছর ধরে এভাবেই পড়ার অভ্যাস তৈরি হয়েছে মানুষের। কিন্তু অনলাইনে মানুষ যখন কোনো কিছু পড়েন, তখন তাদের মধ্যে একধরনের অস্থিরতার প্রকাশ লক্ষ করেছেন গবেষকেরা। তাঁরা দেখেছেন, অনলাইনে পড়ার সময় চোখের তারার ছোটাছুটির কারণে পাঠক প্রথমত ওয়েবপেজের বাঁ দিকের প্রথম লাইন ধরে শুরু করে শেষ পর্যন্ত যান। তারপরই তিনি নেমে পড়েন বরাবর নিচের লাইনে! অর্থাৎ দ্বিতীয় লাইনের শেষ থেকে পাঠক আবার বাঁ দিকে আসতে থাকেন। পদ্ধতিটি যন্ত্রের মাধ্যমে যেভাবে ঘাস কাটা হয়, অনেকটা সে রকম। এর ফলাফল সহজেই অনুমেয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোনো একটা নিবন্ধের মূল ভাব পাঠকের আয়ত্তের বাইরে থাকে। কিন্তু এই দ্রুত পঠন বা ‘স্ক্যান করা’র কল্যাণে বিষয়বস্তু সম্পর্কে পাঠক একটা ধারণা পান। আবার এই ছোটাছুটির মধ্যে তিনি যদি অন্য কোনো লেখা, অনলাইনে যাকে ‘কনটেন্ট’ বলা হয়, তার লিংক পান, তাহলে চকচক করে ওঠে তাঁর চোখ। এর প্রধান কারণ, লিংকের লেখাটির রং সাধারণ মূল লেখার রঙের চেয়ে ভিন্ন ও দৃষ্টি আকর্ষণীয় হয়। ফলে পাঠক খুব দ্রুতই অন্যদিকে ছুটে যান।

তবে একই গবেষণায় দেখা গেছে, যদি এর মধ্যে লেখক বা নির্মাতা কোনো পাঠক-দর্শকের কাঙ্ক্ষিত মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারেন, তাহলে পাঠক তাতে মনোযোগ দিতে দ্বিধা করেন না। দুঃখের কথা হলো, এ রকম মনোযোগী পাঠক ১৬ শতাংশ। অন্যদের মনোযোগ ‘আধামাধা’।

যেভাবে অনলাইনে পড়েন পাঠকেরা

অনলাইনে পড়ার সময় পাঠক প্রথমত এভাবে ওয়েবপেজের বাঁ দিকের প্রথম লাইন ধরে পড়তে শুরু করে শেষ পর্যন্ত যান। তারপরই নেমে পড়েন বরাবর নিচের লাইনে।

অনলাইনে কোনো কিছু খোঁজার সময় পাঠকের চোখের তারার নড়াচড়া হয় একেবারেই বল্গাহীনভাবে, অনেকটা ওপরের ছবির মতোই।

সার্চ ইঞ্জিনের প্রভাব

অনলাইনে পড়ুয়াদের পড়ার অভ্যাসের আরেকটি ধরন ঠিক করে দিয়েছে গুগল। ১৯৯৭ সালে নিয়েলসন নর্ম্যান প্রথম যখন গবেষণা করেন, তখন ইয়াহু থাকলেও গুগল ছিল না। ১৯৯৮ সালের সেপ্টেম্বরে গুগলের আবির্ভাবের পর থেকে ইন্টারনেটে তথ্য খোঁজার ধারায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। সার্চের খবর দেখানোর ক্ষেত্রেও হয়েছে নানা পরিবর্তন। বর্তমানে যেকোনো তথ্য খুঁজলে বা সার্চ করলে আপনি গুগলের ফলাফল পেজের শুরুতে একাধিক লিংক ছাড়াও ভিডিও এবং নানা ছবির লিংক পাবেন। আবার সার্চ পেজে (SERP—Search Engine Result Page) জায়গা করে নেওয়ার জন্য হাজির থাকেন বিজ্ঞাপনদাতারাও। গুগল যে সত্যগুলো দেখায়, সেগুলো বিভিন্ন ওয়েবসাইট থেকে নিয়ে আসে। যেসব ওয়েবসাইট তাদের তথ্য গুগল-নির্দেশিত পদ্ধতিতে সাজিয়ে রাখে, সার্চ পেজে সেগুলোই প্রাধান্য পায়। আদর্শ ক্ষেত্রে সার্চ পেজে থাকে অর্গানিক ও বিজ্ঞাপন রেজাল্ট ছাড়া রিচ স্নিপেট (গোছানো তথ্য), ছবি, ম্যাপ, সংজ্ঞা, প্রশ্ন-উত্তর, ভিডিও ইত্যাদি। এ রকম পেজে পাঠকের চোখের তারার নড়াচড়া হয় একেবারেই বল্গাহীনভাবে। তাই সাধারণত প্রথম লিংকের পরেই তাঁর দৃষ্টি চলে যায় ডান দিকের গোছানো তথ্যে, সেখান থেকে মূল জায়গায় প্রথমে সে দেখে ভিডিও, তারপর চোখ যায় অন্য ফলাফলে। এর মধ্যে ৩১ শতাংশ লোক প্রথম লিংকে ক্লিক করতে পছন্দ করেন। যেহেতু পৃথিবীতে এখন কোটি কোটি ওয়েবসাইট আছে, কাজেই অধিকাংশ ওয়েবসাইটই চেষ্টা করে সার্চ ইঞ্জিনের শুরুতে থাকতে, যাতে তারা তাদের পাঠকদের ডেকে আনতে পারে। বলা বাহুল্য, এই ডাকাডাকির কারণেই অনলাইনে যাঁরা পড়েন, তাঁদের চোখের তারার চলাচল নানামুখী হয়ে যায়।

  • সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করা ১০০ লিংকের ৫৯টিতেই শেয়ারকারী প্রবেশ করেন না!

  • অনলাইনের ৭৯ শতাংশ ব্যবহারকারীই শব্দের পর শব্দ পড়েন না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দ্রুত ওয়েবপেজটি স্ক্যান করেন। কোথাও চোখ ‘আটকে’ গেলে সেটা নিয়ে ভাবেন কিংবা দরকারি তথ্যটি পেয়ে গেলে মনোযোগ দেন।

  • অনলাইনে পাঠকের হরেদরে পছন্দ ৬০০-৮০০ শব্দের লেখা।

  • অনলাইনে মনোযোগী পাঠক ১৬ শতাংশ। অন্যদের মনোযোগ ‘আধামাধা’।

পাঠকেরা অনলাইনে কী পড়েন

অনলাইনের পাঠকেরা সর্বভুক—তাঁরা প্রায় সবই পড়েন। তবু পাঠাভ্যাসের ধরন বিচারে তাঁদের মোটাদাগে কয়েক ভাগে ভাগ করা যায়—সংবাদ, বিনোদন, খেলার তথ্য, বিসিএসের প্রস্তুতি ইত্যাদি; ই-কমার্স সাইটে অর্ডার দেওয়া বা কেনাকাটার জন্য খোঁজাখুঁজি; সরকারি-বেসরকারি সেবার অনলাইন ফরম—যেমন ভূমির খাজনা বা পাসপোর্টের জন্য আবেদন প্রভৃতি পূরণ করা। বলা দরকার, তৃতীয় ক্ষেত্রে ব্যক্তির সতর্কতার অভাব হয় না। দ্বিতীয় দলও ‘ঠিকমতো না জানলে ঠকে যাব’—এই মনোভাব থেকে সর্বদা সতর্ক থাকে। কেবল প্রথম দলের পাঠকদের বেলায় মানবিক মনস্তত্ত্বের পরিপূর্ণ প্রকাশ ঘটে।

সাম্প্রতিককালে দেশের অনলাইন সংবাদমাধ্যমের বিভিন্ন কনটেন্ট পড়ার হার পর্যালোচনা করলে পাঠকদের মজার সব বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। দেখা যায়, যাঁরা খেলার খবরে আগ্রহী, তাঁদের বড় অংশই বিনোদন ও রাজনীতি বিষয়েও খোঁজখবর রাখেন। অন্যদিকে একদল একনিষ্ঠ রাজনীতির পাঠক পাওয়া যায়, অন্য কিছুতে যাঁদের আগ্রহ কম। আবার বিনোদন জগতের খোঁজখবর যাঁরা রাখেন, তাঁদের মধ্যে বিতর্কিত বিষয় বা আলোচিত তারকাদের খবরাখবরে দেখা যাচ্ছে আগ্রহ সবচেয়ে বেশি। যেমন পরীমনি-সংক্রান্ত যেকোনো সংবাদ। অবশ্য এই দলের পড়ুয়াদের এমনকি বিনোদনের অন্যান্য খবরেও আগ্রহ কম দেখা যায়। আর অন্য বৈশিষ্ট্যের যেসব পড়ুয়া রয়েছেন, তাঁদের অধিকাংশই অনলাইনে নির্দোষ কৌতুক বা মজার (ফান) কনটেন্ট পড়তে আসেন। যেকোনো ওয়েবসাইটে তাঁরা কেবল এ-সংক্রান্ত কনটেন্টেই ঢুঁ দেন এবং সাধারণত সেটা পড়েই সটকে পড়েন।

কী করলে পড়েন তাঁরা

অনলাইনের পাঠকদের চোখের তারার ছোটাছুটি আর অস্থির মনস্তত্ত্বের কারণে অনলাইন তথ্যভান্ডারগুলোকে নিজেদের নানাভাবে পরিবর্তন করতে হয়। গবেষকেরা বলেন, সেই ওয়েবসাইটই পড়ুয়াদের ধরে রাখতে পারে, যারা কিনা তাদের কনটেন্টকে নিচের মতো করে সাজিয়ে নেয়—ক. পরিষ্কার শিরোনাম ও উপশিরোনাম, এ ক্ষেত্রে চতুরতার আশ্রয় নেওয়া যাবে না; খ. শুরুতেই কিছু বিশেষ তথ্যের অবতারণা; গ. পুরো কনটেন্টকে ছোট ছোট অংশে ভাগ করা এবং ছোট অনুচ্ছেদ ও ছোট বাক্যে লেখা; ঘ. কনটেন্টের মধ্যে কোনো তালিকা থাকলে তাকে ক্রমানুসারে সাজিয়ে দেওয়া (এই তালিকার মতো); ঙ. সহজ ও প্রচলিত শব্দের ব্যবহার, যেমন ‘শাখামৃগ’ না লিখে ‘বানর’ লেখা; চ. একটি কনটেন্টের সঙ্গে ওই বিষয়সংক্রান্ত আরও লিংক (যদি থাকে) তা যথাযথভাবে দেওয়া; ছ. ছবি ও ভিডিও (যদি থাকে) সেগুলোকে ওপরের নিয়ম মেনে সাজিয়ে দেওয়া ইত্যাদি।

অনলাইন-সাহিত্যের কেমন হাল

ওপরের আলোচনা থেকে বোঝা যাচ্ছে, অনলাইনের পাঠক একটু ভিন্ন প্রকৃতির। তাঁদের পড়ার বিষয়বস্তু বা পড়ার ধরন প্রাক্‌-ইন্টারনেট তথা বই–যুগের মতো নয়। তাঁরা দ্রুত পড়তে চান, একনজর চোখ বুলিয়ে চলে যেতে চান লেখার জরুরি অংশে। কিন্তু সেখানেও যে তাঁরা স্থির থাকতে পারেন, এমন নয়। আবার পাঠকের মনোযোগ যাতে বিভ্রান্ত হয়, সে জন্য কেবল কনটেন্টের মধ্যে শুধু ইন্টারলিংক নয়, থাকে চটকদার ভিডিও ও বিজ্ঞাপনও। এত কিছুর মধ্যে প্রকৃত পাঠানুরাগী পাঠকের পক্ষে নিজের লক্ষ্যে স্থির থাকা কঠিন। তারপর আছে লেখার আকার। অনলাইনে পাঠকের হরেদরে পছন্দ ৬০০-৮০০ শব্দের লেখা। কিন্তু এত কম শব্দে গল্প, প্রবন্ধ কিংবা সাহিত্যের আলোচনা সহজ কর্ম নয়। ফলে অনলাইনে সাহিত্যের পাঠকের সংখ্যা স্বাভাবিকভাবেই কম। আবার যাঁরাই সাহিত্যপাতায় উঁকিঝুঁকি দেন, তাঁরাও টানা লেখায় আকর্ষণ বোধ করেন না। কিন্তু পাঠক আকৃষ্টের জন্য গল্পের মধ্যে উপশিরোনাম যোগ করা, বুলেট পয়েন্ট করে লেখা, বিন্যস্ত করা—এগুলো তো সম্ভব নয়। ফলে টানা লেখা পড়ার ব্যাপারে পাঠকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটে অনেক ক্ষেত্রেই। আবার বেশির ভাগ অনলাইন সাহিত্য কোনো না কোনো অনলাইন সংবাদমাধ্যমের অংশ। কাজেই সেখানে বিজ্ঞাপনের উপস্থিতিও থাকে। সব মিলিয়ে অনলাইনে তাই সাহিত্যের নিবিষ্ট পাঠক পাওয়া খানিকটা কষ্টকরই বটে। তবে কলকাতার ‘ডাকবাংলা’ বা বাংলাদেশের ‘শ্রী’র মতো ওয়েবসাইট যদি শুধু সাহিত্যনির্ভর হয়, তাহলে ভিন্ন কথা।

অনলাইনে সাহিত্যের এ অবস্থা দেখেই ২০০৭ সালে অনলাইনে বই বিক্রেতা অ্যামাজন তাদের বই পড়ার ডিজিটাল ডিভাইস ‘কিন্ডল’-এর বাজারজাত করা শুরু করে। ডিজিটাল মাধ্যমে বই পড়ার এটিই এখন বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় মাধ্যম। পাশাপাশি এখন অনেক ই-বুক অ্যাপ পাওয়া যায়। এই অ্যাপগুলোতে আপনি নিরবচ্ছিন্নভাবে বই পড়তে পারবেন। মুঠোবই, বইটই, সেই বই, বইঘর, বইপোকা ইত্যাদি ই-বুক অ্যাপ থেকে সাহিত্যানুরাগীরা তাঁদের পছন্দের লেখকদের বেছে নেন। এগুলোর সুবিধা হলো, প্রায় সব কটিতেই প্রচুর ধ্রুপদি সাহিত্যের বই কপিরাইট ছাড়া বিনা মূল্যে পড়া যায়।

অনলাইন-সাহিত্যে পাঠককে যুক্ত করার উপায় কী

বোঝাই যাচ্ছে, কাজটা খুব একটা সহজ হবে না। কেননা, সাহিত্যপাঠে যে অনুরাগ ও ধৈর্যের দরকার হয়, অনলাইন-সংস্কৃতির মধ্যে তা ধরে রাখতে হলে প্রথমত নিরলস চেষ্টা করতে হবে, বুঝতে হবে পাঠকের মনস্তত্ত্ব। পাঠক যেন পথ হারিয়ে না ফেলেন, সে জন্য সাহিত্যের ওয়েবসাইটে লেখার মধ্যে বিজ্ঞাপন ও অনাবশ্যক লিংক দেওয়া বন্ধ করার সুপারিশ করেন গবেষকেরা। একই সঙ্গে আকৃষ্ট করতে হবে জনপ্রিয় ও প্রকৃত সাহিত্যিকদের। আমাদের দেশে অনেক লেখকই এখনো অনলাইন পোর্টালগুলোতে লেখা প্রকাশে আগ্রহী নন। এর অন্যতম কারণ ভবিষ্যতের জন্য লেখা সংরক্ষণে দুর্বলতা। বেশির ভাগ পোর্টালে কয়েক বছর পর ওই লেখার লিংক আর খুঁজে পাওয়া যায় না। এতে সাহিত্যিকেরা, যাঁরা কিনা সাহিত্যকর্মকে যুগজয়ী করতে চান, তাঁরা খুব একটা ভরসা পান না। এ জন্য অনলাইন আর্কাইভিংয়ের সংস্কৃতিও যথাযথভাবে অনুসৃত হওয়া দরকার, যেন লেখক-গবেষকেরা সহজেই খুঁজে পেতে পারেন তাঁদের প্রয়োজনীয় লেখা। পরিবর্তন দরকার আমাদের পড়ার ধরন ও মানসিকতায়ও। এ ছাড়া কী করলে নিজের লেখা আরও বেশি পাঠক পড়বেন, সে বিষয়েও লেখকের ভাবনা থাকা দরকার। আর আমাদের দেশে কেবল সাহিত্যের জন্য আলাদা অনেক বেশি পোর্টাল যখন তৈরি হতে শুরু করবে, তখন দৃশ্যপট পরিবর্তিত হবে বলে মনে হয়। তবে মুশকিল হলো, লক্ষ্মীর সঙ্গে সরস্বতীর চিরন্তন বিবাদের কারণে এগুলো শুরু হলেও শেষ পর্যন্ত মুখ থুবড়ে পড়ে।

কিন্তু সংবেদনশীল সমাজ ও চিন্তাশীল একটি প্রজন্ম যদি আমরা গড়তে চাই, তবে সাহিত্য আমাদের পড়তেই হবে। অনলাইনে শুধু তথ্য খোঁজার মানসিকতা মানুষ হিসেবে অবশ্যই আমাদের পরিপূর্ণ করবে না। তাই আগামী দিনের অনলাইন-প্রজন্মকে সাহিত্যের রস আস্বাদনের সঙ্গে যুক্ত করাটাও খুব জরুরি, প্রয়োজনীয়ও বটে। গবেষকদের পরামর্শ মেনে আন্তরিকভাবে চেষ্টা করলে তা অসম্ভব থাকবে বলে মনে হয় না।