ইলা মিত্রের ইতি নেই

ইলা মিত্র
ছবি: সংগৃহীত

প্রথম বাঙালি মেয়ে হিসেবে ১৯৪০ সালে জাপানে অনুষ্ঠিত অলিম্পিকের জন্য নির্বাচিত হয়েছিলেন ইলা মিত্র। যদিও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে বাতিল হয়ে যায় সেই অলিম্পিক, তবে ১৯২৫ সালের ১৮ অক্টোবর জন্ম নেওয়া এই নারী নিজের লড়াকু মনোভাব চিনিয়েছিলেন সেই কিশোরী বয়সেই। পরবর্তীকালে কলকাতার বেথুন কলেজে বাংলা সাহিত্যে বিএ সম্মান শ্রেণির ছাত্রী থাকাকালীন রাজনীতিতে প্রবেশ ঘটে তাঁর। নিজেকে সম্পৃক্ত করেন ‘মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি’ নামের সংগঠনের সঙ্গে। সেখানে নারীদের অধিকার নিয়ে শুরু হয় তাঁর আন্দোলন এবং খুব দ্রুতই ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় কর্মী হয়ে ওঠেন, যখন তাঁর বয়স মাত্র ১৮। সেই থেকে শুরু তাঁর অপরাজেয় জীবনযাত্রা, যা সমুজ্জ্বল আজওÑতাঁর মৃত্যুর পরেও। সরদার ফজলুল করিম এ প্রসঙ্গে যথার্থই বলেছিলেন, ‘ইলাদি, আপনি মৃত নন; জীবিত। আপনার কাছে আমাদের জীবনের ঋণের শেষ নেই। আপনি আমাদের পাশে আছেন; আমাদের সাথে আছেন এবং আমাদের সংগ্রামের লাইনের একেবারে সম্মুখে আছেন। আমরা বলছি: জয়তু ইলা মিত্র। জয়তু ইলা মিত্র।’

এ মাসে ছিল বিপ্লবী নেত্রী ইলা মিত্রের জন্ম ও মৃত্যুদিন। ১৯২৫ সালের ১৮ অক্টোবর জন্ম নেওয়া এই মহীয়সী নারী মারা যান ২০০২ সালের ১৩ অক্টোবর। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা।

১৯৪৫ সালে কমিউনিস্ট রমেন্দ্র (রমেন) মিত্রের সঙ্গে বিবাহের সূত্রে জমিদার পরিবারের পুত্রবধূ হন ইলা মিত্র। শ্বশুরবাড়ির কাছেই স্থাপিত মেয়েদের জন্য একটি স্কুলের দায়িত্ব নেন তিনি। সুপরিচিত হয়ে ওঠেন গ্রামবাসীর কাছে। জীবনসঙ্গী রমেন মিত্রের উৎসাহ ও অনুপ্রেরণায় কৃষকদের পাশে দাঁড়িয়ে জমিদারি প্রথার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমে পড়েন ওই কাছাকাছি সময়েই। ১৯৪৬ থেকে প্রায় ১৯৫০ সাল পর্যন্ত রাজশাহীর নবাবগঞ্জ অঞ্চলে তিনি ‘তেভাগা আন্দোলনে’র নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এসবের ফলে গ্রামের কৃষক ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছে তিনি হয়ে ওঠেন তাঁদের ‘রানীমা’। ১৯৪৬ সালে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার সময় কমিউনিস্ট পার্টির হয়ে নোয়াখালীর দাঙ্গাবিধ্বস্ত হাসনাবাদ এলাকায় সেবা ও পুনর্বাসনের কাজে নিয়োজিত হন। তাঁর দৃঢ় পদক্ষেপ প্রশংসিত হয় নানা মহলে।

স্বামী রমেন্দ্র মিত্রের সঙ্গে ইলা মিত্র
ছবি: সংগৃহীত

দেশভাগ–পরবর্তী সময়েও তেভাগা আন্দোলন অব্যাহত থাকে। কিন্তু সে সময় কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় এবং এ আন্দোলন দমন করতে মরিয়া হয়ে ওঠে স্বয়ং রাষ্ট্রযন্ত্র। ফলে অন্যান্য অনেক নেতার মতো ইলা মিত্র ও তাঁর স্বামী রমেন্দ্র মিত্রকেও চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোলের একটি গ্রামে আত্মগোপনে চলে যেতে হয়। কারণ, দেশভাগের পর তাঁরা প্রাণভয় উপেক্ষা করে রয়ে গিয়েছিলেন পূর্ব বাংলায়। নাচোলের আদিবাসী সাঁওতাল কৃষকদের মধ্যে ছিল তাঁর তুমুল জনপ্রিয়তা। সাঁওতাল মেয়েদের রাজনীতিসচেতন করতে তিনি অপরিসীম দক্ষতার পরিচয় দেন। তবে তেভাগা আন্দোলন রোধে তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকেরা যে নিপীড়ন শুরু করেন, তাতে লাঞ্ছিত ও নিপীড়িত হতে হয় ইলা মিত্রকে। ১ নম্বর আসামি করে তাঁকেসহ ২৩ জনকে দেওয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। তাঁর মুক্তির দাবিতে বিভিন্ন মহল সোচ্চার হয়ে ওঠে সে সময়। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় এলে চিকিৎসার প্রয়োজনে প্যারোলে মুক্তি দেওয়া হয়। কলকাতায় চলে যান ইলা মিত্র। আর ফিরে আসেননি পূর্ব বাংলায়। তবে সেখানেও নিশ্চিত হয়নি রাজনৈতিক আশ্রয়। পড়তে হয় দুরবস্থার মধ্যে। পরে এমএস পাস করে কলকাতার সিটি কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন। পরবর্তী জীবনে ভারতের শিক্ষা আন্দোলন ও নারী আন্দোলনে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত থাকার পাশাপাশি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রাদেশিক পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্বে ছিলেন অনেক বছর।

তাঁকে নিয়ে লেখা ‘ইলা মিত্র’ নামের গ্রন্থটিতে মালেকা বেগম তাই যথার্থই বলেছিলেন, ‘ইলা মিত্রের ইতি নেই। অন্তহীন তাঁর ইতিহাস, ইতিবৃত্ত ও ইতিকথা।’ মালেকা বেগমের মতে, ইলা মিত্র এমন এক ব্যক্তিত্ব, যিনি কখনো অতীত হতে পারেন না।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের পক্ষে জনমত গড়ে তুলতেও ইলা মিত্রের ছিল সক্রিয় ভূমিকা। প্রগতিশীল নারী, তুখোড় মেধাবী, খেলোয়াড়, সাহসী রাজনৈতিক কর্মী ও শিক্ষক হওয়ার পাশাপাশি নিজেকে লেখক হিসেবেও পরিচিত করে তুলতে সফল হয়েছিলেন তিনি। অনুবাদ করেছিলেন বেশ কয়েকটি রুশ গ্রন্থ। ‘হিরোশিমার মেয়ে’ গ্রন্থটি অনুবাদের জন্য তিনি লাভ করেন ‘সোভিয়েত ল্যান্ড নেহরু অ্যাওয়ার্ড’। তবে তাঁর জীবনের গতিপথ কখনোই মসৃণ ছিল না, আর তা নিয়ে তিনি কখনো করেননি আক্ষেপও। ২০০২ সালে মৃত্যুবরণের আগপর্যন্ত তিনি রাজনৈতিকভাবে সচেতন ও সক্রিয় ছিলেন। বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে টিকে থাকার সংগ্রামী মানসিকতা তাই মৃত্যুর পরও তাঁকে স্মরণীয় করে রেখেছে সর্বস্তরে। তাঁকে নিয়ে লেখা ‘ইলা মিত্র’ নামের গ্রন্থটিতে মালেকা বেগম তাই যথার্থই বলেছিলেন, ‘ইলা মিত্রের ইতি নেই। অন্তহীন তাঁর ইতিহাস, ইতিবৃত্ত ও ইতিকথা।’ মালেকা বেগমের মতে, ইলা মিত্র এমন এক ব্যক্তিত্ব, যিনি কখনো অতীত হতে পারেন না। সম্প্রতি ছিল এই কিংবদন্তি নারীর ৯৭তম জন্মবার্ষিকী এবং এ মাসেই তাঁর মৃত্যুরও পেরিয়ে গেল ২০ বছর। কিন্তু কখনোই ‘অতীত’ না হওয়া তেজোদীপ্ত ইলা মিত্র যেন স্বমহিমায় ভাস্বর চিরকাল।