ক্যামেরায় মুখাবয়ব বয়নের কারিগর

নাসির আলী মামুনের প্রদর্শনীতে দর্শক
নাসির আলী মামুনের প্রদর্শনীতে দর্শক

অনেক অনেক দিন পর আলোকচিত্রশিল্পী নাসির আলী মামুনের প্রদর্শনী দেখার সৌভাগ্য হলো বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের বদৌলতে।

জাদুঘরের নলিনীকান্ত ভট্টশালী গ্যালারির চার দেয়ালজুড়ে অতীতের কীর্তিমান মুখগুলো সাদা-কালোর রাহস্যিকতায় ভরে উঠলে আমাদের কাঙাল চোখগুলো যেন ইতিহাসের ওপর আবার আস্থা ফিরিয়ে আনে। কোথাও তৃতীয় বর্ণবিভাস নেই, কিন্তু আমরা একের পর এক নানা পথের আত্মনিবেদিত পথিক, যাঁদের অসীম সাহস, শিল্পকলাপ্রকাশ, বিদ্যা ও বহুমুখীন কর্মতৎপরতা আমাদের একটি জাতীয় বাসনা গড়ে তুলেছিল, মামুনের ক্যামেরার ম্যাজিক-উল্লাস বহুস্তরা সাদা-কালোয় তাঁদের উদ্ভাসিত করে তুলেছে। এই প্রদর্শনীটি তাই আলোকচিত্রের নেহাতই শৈল্পিক উপস্থাপন না হয়ে থেকে কীর্তিমান মুখগুলোর সামনে আমাদের এক সওয়াল-জবাবের বন্দোবস্ত করে। ছবি দেখা অন্যান্য শিল্পের মতোই এ এক অনন্য অভিজ্ঞতা।

আলোকচিত্র আসলে একটি চক্ষুকেন্দ্রিক শিল্প। ফলে আলোকবিজ্ঞানের নিয়ম অনুযায়ী ছবির মধ্যে আলোছায়ার যে জ্যামিতি বিন্যাস ছবির সাবজেক্ট বা যে পোর্ট্রেটকে দর্শকের সামনে হাজির করা হয়, তখন চক্ষু-ইন্দ্রিয়ের দায়িত্ব এক প্রস্থ বেড়ে যায়, এই স্বার্থে চোখকে আর সব ইন্দ্রিয় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। আমাদের নিউরোলজিক্যাল আচরণের বিধি অনুসারে ছবির অর্থের (মিনিং) জোগানে আমরা যে ভাষায় কথা বলি, তার সঙ্গেও যুক্ত হয়ে পড়ে দর্শকের নানা জিজ্ঞাসা। তখনই আসলে শুরু হয় আলোছায়া, আর বিকিরিত সরল ও অসরল রেখার ঝুঁকিপূর্ণ অবয়ব গঠনের তৎপরতা, যে অবয়ব কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যক্তির তথাকথিত প্রতিচ্ছবি হলেও তার অতিরিক্ত ব্যঞ্জনা তৈরি করে। এই অতিরিক্ত ব্যঞ্জনা বা সারপ্লাস দিতে যিনি যত পারঙ্গম, তিনি তত বড় শিল্পী হিসেবে পরিগণিত হন। বলার কথা হলো, মামুন তাঁর ক্যামেরাশিল্পের এই সারপ্লাস নিজের একার জন্য কুক্ষিগত না করে আমাদের বিতরণ করে যাচ্ছেন সুদীর্ঘ অর্ধশতক ধরে। যদিও যেভাবে তিনি আলোকচিত্রশিল্পের সিন্দাবাদ হয়ে উঠলেন, সেই গল্প কিন্তু অতটা মসৃণ নয়।

শিল্পের দায় বলে যে একটা কথা চালু আছে, তা মামুনের মধ্যে তৈরি হয় ক্যামেরার মুখোমুখি দাঁড়ানো মানুষের চোখের দিকে তাকিয়ে। এই তাকানো বা দেখা তিনি খালি চোখে দেখেন না, দেখেন ক্যামেরার পেছনের ফুটো দিয়ে। কিন্তু যাকে তিনি ক্যামেরার পেছন থেকে দেখছেন, সেই লক্ষ্যবস্তু কিন্তু মামুনের চোখ সরাসরি দেখতে পাচ্ছে না। এই স্নিগ্ধ ষড়যন্ত্র আমাকে রাধা-কৃষ্ণের লীলার কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। আবার শিল্পীর কাছে ক্যামেরার উল্টো দিকে তাক করা মুখটি যে আচরণ করে, তা মায়া হরিণের মতো।

মানুষের মুখমণ্ডল আপাত-স্থির মনে হলেও তার মাংসপেশি সার্বক্ষণিক কম্পনশীল। দ্বিতীয় কারণ, বাইরের আলোর তাপ ও গুণমাত্রা, এরপর পরিভ্রমণরত সূর্যের অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে পটভূমি বা তার ওপর পড়া বিভিন্ন বস্তুর ছায়ার ছক। মামুন প্রায় এক-দুই নিশ্বাসের মধ্যে সেই চিন্ময় মুহূর্তটি শাটার টিপে বাক্সবন্দী করে ফেলেন। এখানেই ছবিশিল্পের গল্প শেষ হয় না। বরং বিশেষ রাসায়নিক প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে আলোকছাপকে ছবিতে রূপান্তরিত করতে হয়। বর্তমানে যদিও রসায়নের এই কাজটি আর করতে হয় না ডিজিটাল ক্যামেরার আগমনে।

কী পরিমাণ ধৈর্য ও ধীশক্তি থাকলে একজন মানুষ পঞ্চাশ বছর ধরে একটুও না থেমে বিখ্যাত ব্যক্তিদের মুখাবয়ব সাধনা করে যাচ্ছেন, তা ভাবতে অবাক লাগে। যাঁরা এই প্রযুক্তিনির্ভর কর্মটির শিল্পস্বভাব একটু তলিয়ে দেখেন, তাঁরা নিশ্চয় বুঝতে সক্ষম হবেন। একদিকে বিশেষ একশ্রেণির মানুষ, যাঁরা নিজ নিজ ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রেখেছেন বা রাখছেন, সেই সব ব্যক্তির মুখাবয়ব সাধনা যে কত কঠিন, তা জাদুঘরের গ্যালারি ঘুরে দেখতে দেখতে শুধু আমার নয়, আরও দর্শকের নিশ্চয়ই একই কথা মনে হয়েছে। তৃতীয় নজর হিসেবে আমাকে তাই একবার ছবি, আরেকবার যে দর্শক ছবি দেখছেন, তাঁদের দিকে তাকাতে হয়েছে। আমার এ জন্য মনেই হয়, ক্যামেরায় পোর্ট্রেট তোলার আয়োজনটি মানুষের আসলে অবয়নের মনস্তত্ত্ব পাঠ, এ-ও কি সহজ মানুষ সাধনার দিক থেকে অর্থ নির্মাণের আরেক ডাইমেনশন নয়?

অভিনেত্রী ফেরদৌসী মজুমদারকে নিজের প্রদর্শনী দেখাচ্ছেন নাসির আলী মামুন
অভিনেত্রী ফেরদৌসী মজুমদারকে নিজের প্রদর্শনী দেখাচ্ছেন নাসির আলী মামুন

যাহোক, ক্যাটালগে মুদ্রিত ছবির সন-তারিখ অনুযায়ী আমরা দেখি প্রদর্শনীতে যে ছবিগুলো প্রদর্শিত হচ্ছে, তা তোলা হয়েছে ১৯৭১ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে। নিশ্চয়ই শিল্পী এর আগে-পরে আরও ছবি তুলেছেন কিন্তু প্রদর্শনীতে একটা ছবির রূপকথা সাজানোর তাগিদে এই নির্বাচন তাঁকে করতেই হয়েছে। মজার ব্যাপার হলো, সব ছবিই তাঁর সাদা-কালো। ভাবতে আশ্চর্য লাগে, প্রাক্-যৌবন থেকে আজ মধ্যবয়স পেরিয়ে তিনি কেমন করে প্রথম ধ্যানটিকেই এখন পর্যন্ত জারি রেখেছেন। সাদা-কালো সাধনা এখানে তাই একটি বিশেষ দ্যোতনা বহন করে, তা বাংলাদেশের জগদ্বিখ্যাত চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানই হন বা সদ্য প্রয়াত কেমব্রিজের জগদ্বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক স্টিফেন হকিংই হন।

কালো-সাদার এই সাধনার গোপন দার্শনিক তত্ত্বটি খুঁজে পাই ক্যাটালগে লেখা মামুনের লিখিত জবানিতে। জবানিতে মামুনের প্রথম বাক্যটিই আমাদের তাঁর শিল্পচিন্তার ধারণার কাছে পৌঁছে দেয়, যেখানে তিনি লিখছেন, I worship black spaces, মানে তিনি ধ্যান করেন কৃষ্ণকালো নিখিল জগৎকে, যেখানে তিনি আলোর রেখার জ্যামিতি দিয়ে সত্য আবিষ্কার করতে চান।

কমবেশি আমি নাসির আলী মামুনের ছবির সঙ্গে পরিচিত প্রায় সত্তর দশকের শেষ প্রান্ত থেকে। এই গল্পটি বলে এই লেখার ইতি টানব। আমি টাঙ্গাইলে তখন উচ্চবিদ্যালয় ডিঙিয়ে কলেজের ছাত্র। একদিন শিল্পী টাঙ্গাইল এলেন। উদ্দেশ্য আলোকচিত্র প্রদর্শনী করবেন। জেলা পরিষদের আয়োজনে শিল্পীর আলোকচিত্র প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করার চেষ্টা চলছে, সেখান থেকে কিছু সহযোগিতা পাওয়ার আশ্বাস আছে। কিন্তু টাকা? তখন সেই করুণ মুহূর্তে আমি, কবি জাহিদ মুস্তাফা, ছড়াকার শফিক ইমতিয়াজ এবং অসীম রায় দু-চার টাকা করে করে এর-ওর কাছ থেকে নিয়ে প্রদর্শনীকে বাস্তব করে তোলার চেষ্টা করি। এর পরের কাহিনি এতটাই করুণ যে তা এখানে আর না-ই বললাম। আজ সেসব ভুলে যাচ্ছি এই ভেবে যে, খেয়ে না-খেয়ে, এক পা-ও নিজের বিশ্বাস থেকে না সরে কীর্তিমানদের অবয়ব ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য তিনি ইতিহাসের আলোকচিত্র মহাফেজখানা তৈরি করে যাচ্ছেন। পৃথিবীর আর কোথাও এমন একজন আলোকচিত্রী কথা আমি জানি না, যিনি সাদা-কালো মাধ্যমে মুখাবয়ব ক্যামেরায় ধরে রাখার জন্য এমন জীবনবাজি রেখেছিলেন বা রাখছেন।

১০ এপ্রিল শুরু হওয়া প্রদর্শনীটি শেষ হবে আগামীকাল ৫ মে।