'জীবন আমাকে অনেক দিকে নিয়ে গেছে'

নিজের বাড়ির বারান্দায় আল মাহমুদ। ছবি: খালেদ সরকার
নিজের বাড়ির বারান্দায় আল মাহমুদ। ছবি: খালেদ সরকার

বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান কবি আল মাহমুদ এখন খুব অসুস্থ। কথা প্রায় বলতেই পারেন না। লিখতে পারেন না কবিতাও। ১৯৩৬ সালে জন্ম নেওয়া এই কবির জন্মদিন ছিল ১১ জুলাই । বছর দুয়েক আগে এই সাক্ষাৎকার যখন নেওয়া হয়, সে সময় বেশ কথা বলতে পারতেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন শ্যামল চন্দ্র নাথ

শ্যামল চন্দ্র নাথ: দীর্ঘ একটা জীবন কাটালেন। জীবন নিয়ে কোনো অপ্রাপ্তি বা হতাশা কি আছে নিজের ভেতরে?

আল মাহমুদ: না, অপ্রাপ্তি তেমন নেই, আছে কিছু দুঃখ। মানুষ যা চায়, তা সে পায় না। সেই অপ্রাপ্তিটুকু আছে। তবে কোনো হতাশা নেই। যা চেয়েছি, তা পাইনি, কিন্তু যা পেয়েছি, সেটুকুও অনেক বেশি।

শ্যামল: এখন আপনার দিন কাটে কীভাবে?

মাহমুদ: আমি তো বৃদ্ধ লোক। একা কোথাও বেরোতে পারি না। আর বাসার কেউই আমাকে বেরোতে দেয় না। আমি তাই ঘরেই থাকি। আল্লাহ আল্লাহ করি। আর সারা দিনই তো মানুষজন আসে আমার কাছে।

শ্যামল: কাদের কবিতা পড়ে কবি হয়েছেন? এখন কোন কোন কবির কবিতা আপনার প্রিয়, কেনই-বা প্রিয়?

মাহমুদ: আমার প্রিয় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সুযোগ পেলেই তাঁর কবিতা পড়ি। তবে গত শতকের তিনের দশকের কবিরা—জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে—এঁরা আমাকে খুবই আলোড়িত করেছেন। সবাই আমার আগের সময়ের কবি। এ ছাড়া তরুণদের মধ্যে অনেকের কবিতাই আমি পড়ি। পড়ি মানে অন্যরা পড়ে আমাকে শোনায়, আমি শুনি। কিন্তু সমস্যা হলো, নির্দিষ্ট কোনো নাম আলাদাভাবে বলতে পারব না। আর সবার নাম যে জানি, এমনও নয়।

শ্যামল: আনন্দ-বেদনা দুই-ই আছে মানবজীবনে। আপনার আনন্দ ও বেদনা সম্পর্কে যদি জানতে চাই...

মাহমুদ: কবিতা লিখতে পারাটাই একসময় আমার কাছে সবচেয়ে আনন্দের ব্যাপার ছিল। এখনো কষ্টটষ্ট করে, ডিকটেশন দিয়ে একটা কবিতা সৃষ্টি করতে পারলে মনে খুবই পুলক জাগে আমার, আনন্দ হয়। আর বেদনা? মানুষ কথা দিয়ে কথা না রাখলে আমার কষ্ট হয়। কেউ কথা দিলে আমি অপেক্ষা করে থাকি।

শ্যামল: বর্তমানে শারীরিক কোনো সমস্যা বা অসুবিধা কি পোহাতে হচ্ছে?

মাহমুদ: হচ্ছে না মানে! কানে শুনি না, চোখে ঠিকমতো দেখি না। যাহোক, বার্ধক্যজনিত কারণেই চোখে সমস্যা। এই চোখ আমি সারা দুনিয়ায় বড় বড় চিকিৎসককে দেখিয়েছি। তাঁরা আফসোসই করেছেন। ওষুধ দিয়েছেন, চশমা ব্যবহার করতে দিয়েছেন, এই আরকি।

শ্যামল: কবিতা লেখার ক্ষেত্রে আপনার সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা কী? কে বা কারা আপনাকে উৎসাহ দেন?

মাহমুদ: তাঁদের তো নাম বলা মুশকিল। তবে তাঁদের মধ্যে আমার স্ত্রীর কথা অবশ্যই বলতে হবে। আমার স্ত্রী যদিও বেশি শিক্ষিত ছিলেন না, তবু আমি কবিতা আবৃত্তি করলে তিনি তন্ময় হয়ে শুনতেন।

শ্যামল: যদ্দুর জানি, ছোটবেলায় রাত জেগে জেগে গৃহশিক্ষকের মুখে ঠাকুরমারঝুলির গল্প শুনতেন। সেই কল্পনার জগৎই পরবর্তীকালে আপনাকে করে তুলল কবি ও ভাবুক। মনে পড়ে সেই দিনগুলোর কথা?

মাহমুদ: আমার শৈশবের স্মৃতির মধ্যে লেগে আছে ঠাকুরমার ঝুলি। আমাদের বাড়ির লোকদের পেশা যদিও ছিল ব্যবসা-বাণিজ্য, কিন্তু এঁদের মধ্যেই কেউ কেউ আবার গানবাজনা পছন্দ করতেন। যেমন আমার বাবা হারমোনিয়াম বাজিয়ে গাইতে পারতেন। তবে যখন স্কুলে পড়ি, সেই সময় আমার মনে হলো আমিও তো কবিতা লিখতে পারি! সে সময় থেকে ভাবি, আমি কবিতাই লিখব। লিখতে শুরু করলাম। লিখি আর পত্রপত্রিকায় পাঠিয়ে দিই। এখন বলতে পারি, তখনো আমার কবিতা অগ্রাহ্য হয়নি, বরং যথেষ্ট আদরসহকারেই ছাপা হয়েছে। এতে দারুণ উৎসাহ পেয়েছি আমি।

শ্যামল: পরপর তিনটি কাব্যগ্রন্থ লোক লোকান্তর, কালের কলসসোনালী কাবিনের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে নিজের কণ্ঠস্বর প্রতিষ্ঠিত করলেন আপনি। গ্রামীণ পটভূমি ও আঞ্চলিক শব্দের প্রয়োগ আপনার কবিতাকে যেমন অনন্যতা দিয়েছে, একইভাবে আপনি তৈরি করেছেন স্বতন্ত্র এক কাব্যভাষা। এটি কীভাবে সম্ভব হলো?

মাহমুদ: শুরু থেকে সবাই স্বীকার করে নিয়েছেন, আমার কবিতার ভাষায় লোকজ উপাদান, শব্দ, দৃশ্যকল্প, উপমা, উৎপ্রেক্ষা—এগুলো হঠাৎ এমনভাবে উপস্থিত হয় যে মানুষের অন্তরে কাঁপন ধরে যায়। এটাকে আমার কৃতিত্ব বলে অনেকেই সে সময় খুব উৎসাহ দিয়েছেন। বলেছেন, এগোও, এগোও। আমিও দুঃসাহসী ছিলাম। ক্রমাগত লিখতে লাগলাম কবিতা। প্রথম বই বেরোল—লোক লোকান্তর। যখন বইটা বের হলো, প্রকাশনা উৎসবও হয়েছিল। সেখানে বক্তৃতা করেছিলেন সৈয়দ আলী আহসান। তিনি আমাকে জীবনানন্দ দাশ ও জসীমউদ্‌দীনের চেয়ে আলাদা কাব্যপ্রতিভা বলেছিলেন। আমার জন্য এটা ছিল চমৎকার স্বীকৃতি। একটা কথা মনে রাখতে হবে, আধুনিক ধারার মধ্যেই আমি লোকজ শব্দ, উপমা, উৎপ্রেক্ষা ব্যবহার করেছি, গ্রামীণকে আত্তীকরণ করেছি, কিন্তু গ্রাম্যতাকে স্থান দিইনি।

শ্যামল: আপনার অনন্য এক কাব্যগ্রন্থ সোনালী কাবিন। এর চৌদ্দটি সনেট এবং অন্যান্য কবিতা মানুষের মুখে মুখে ফেরে। এই কাব্যগ্রন্থ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?

মাহমুদ: নিজের মূল্যায়ন তো বলা দুষ্কর। এটুকু বলতে পারি, এখনো বইটার নতুন নতুন সংস্করণ হচ্ছে, বিক্রিও হচ্ছে। বাংলাদেশের কয়টা বই এ সম্মান পেয়েছে? আমার বই পেয়েছে।

শ্যামল: গদ্যসাহিত্যেও বিস্তর অবদান আপনার। অনেকে বলেন আপনার গদ্য অন্য রকম। এ ব্যাপারে কী বলবেন?

মাহমুদ: এই ব্যাপারে অনেকবারই বলেছি। আমার কোমরে দুটো তরবারি আছে—একটা কাব্যের, আরেকটা গদ্যের। সবাই বলেন, গদ্যও আমি ভালো লিখেছি। সবচেয়ে বড় কথা হলো, কবি জসীমউদ্‌দীন আমাকে একটা চিঠি লিখেছিলেন। আমাকে তিনি বলেছিলেন, তুমি কবিতা ভালো লেখো এবং তোমার গদ্যের হাতও অসাধারণ। গদ্যচর্চা তুমি ছেড়ো না। তাঁর উপদেশ আমি শিরোধার্য করেছি। যদিও ওই সময়ে বুদ্ধদেব বসুই ছিলেন গদ্যসাহিত্যের অন্যতম সম্রাট। আমরা তাঁকে অসম্ভব পড়তাম। বলা যায়, সাহিত্যের নতুন রাস্তা আমাদের বুদ্ধদেব বসুই দেখিয়েছিলেন। একটা জিনিস তিনি আমাদের শিখিয়েছিলেন, সেটা হলো সাহিত্যের আন্তর্জাতিকতা। সাহিত্য সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে গেছে, এটা আমি তাঁকে পাঠ করেই উপলব্ধি করেছিলাম।

শ্যামল: আপনার জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য সময় কেটেছে গণকণ্ঠ পত্রিকায়। সত্তরের দশকে তুমুল জনপ্রিয় হয়েছিল পত্রিকাটি। আপনি ছিলেন এ পত্রিকার সম্পাদক। যে কারণে আপনাকে জেলেও যেতে হয়েছিল। আবার ওই সময়েই আপনার কবিখ্যাতিতে মুগ্ধ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আপনাকে মুক্তি দিয়ে শিল্পকলা একাডেমিতে চাকরি দেন। সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়ে?

মাহমুদ: হ্যাঁ, ভীষণভাবে মনে পড়ে। বঙ্গবন্ধু আমাকে বলেছিলেন, ‘দেখ আমি ওই শিল্পকলা একাডেমি করেছি, তুই এখানে জয়েন কর। আমি তোকে পৃষ্ঠপোষকতা দেব, তুই জয়েন কর।’ বলেই আমার সামনে তিনি নিজের টেলিফোনটা নিয়ে আমার বাসার ফোন নম্বর জিজ্ঞেস করলেন। আমি বললাম, তিনি টেলিফোন করলেন। এরপর ফোনে আমার স্ত্রীকে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘আমি ওকে শিল্পকলা একাডেমিতে জয়েন করতে বলেছি, তুমি তাকে রাজি করাবে।’ কথা বলা শেষ ফোনটা রেখে দিলেন তিনি। আসলে একজীবনে কত যে ঘটনা! জীবন আমাকে অনেক দিকে নিয়ে গেছে।

শ্যামল: আপনার সমসাময়িক কবি শামসুর রাহমান। কবি হিসেবে তাঁকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

মাহমুদ: তিনি বড় কবি। ভালো মানুষ। তবে মানুষ মনে করে যে তাঁর সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভালো ছিল না। প্রকৃতপক্ষে তাঁর সঙ্গে আমার সম্পর্ক খুবই ভালো ছিল। তিনি মাঝেমধ্যে আমার বাসায় এসে চুপচাপ বসে থাকতেন। আমি বলতাম, কী ব্যাপার ভাই? তিনি বলতেন, ভাল্লাগে না ভাই, তাই এখানে বসে থাকি।