করোনাকাল

করোনাকালে ইরানি শিল্পীর অাঁকা এ ছবিটি সারা িবশ্বের মানুষের মর্মস্পর্শী বেদনাকে তুলে ধরেছে
করোনাকালে ইরানি শিল্পীর অাঁকা এ ছবিটি সারা িবশ্বের মানুষের মর্মস্পর্শী বেদনাকে তুলে ধরেছে
বিশ্বব্যাপী মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস নিয়ে উদ্বিগ্ন বিশ্বের তাবৎ বুদ্ধিজীবী। মানবসভ্যতার ওপর কী প্রভাব ফেলবে করোনাভাইরাস? কতটুকুই-বা বদলে যাবে বিশ্বের অর্থনীতি, রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতি? এই সব নিয়েই কথা বলেছেন সমকালীন দুই জনপ্রিয় লেখক ও চিন্তক ইয়োভাল নোয়াহ হারারিস্লাভোই জিজেক। ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন মারুফ ইসলাম
িনউইয়র্ক শহরের এই দেয়ালচিত্র বর্তমান করোনা–বাস্তবতার প্রতিফলন। ছবি: ডেইলি ওয়ার ডটকম–এর সৌজন্যে
িনউইয়র্ক শহরের এই দেয়ালচিত্র বর্তমান করোনা–বাস্তবতার প্রতিফলন। ছবি: ডেইলি ওয়ার ডটকম–এর সৌজন্যে

মানবজাতি পারস্পরিক অবিশ্বাসেও আক্রান্ত

ইয়োভাল নোয়াহ হারারি

করোনাভাইরাসের জন্য দায়ী কে? অনেকের অভিযোগ, এর জন্য একমাত্র দায়ী বিশ্বায়ন। সংগত কারণে বলা হচ্ছে, এর থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় হচ্ছে ‘অবিশ্বায়ন’। অর্থাৎ দেয়াল তোলো, ভ্রমণ নিষিদ্ধ করো, ব্যবসা-বাণিজ্য কমাও। এতে কি সমস্যা পুরোপুরি দূরীভূত হবে? মহামারি ঠেকাতে এই বিচ্ছিকরণ পদ্ধতি একটি সমাধান বটে, তবে দীর্ঘমেয়াদে এর ফল হবে ভয়াবহ। অর্থনীতি ভেঙে পড়বে। অতএব, চলুন বিপরীতটা ভাবি। এই ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য পারস্পরিক পৃথকীকরণ নয়, বরং পারস্পরিক সহযোগিতার হাত বাড়াই।

পৃথিবীতে যখন বিশ্বায়নের কাল শুরু হয়নি, তখনো মহামারিতে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আজ থেকে গুনে গুনে ঠিক ৫০০ বছর আগে, অর্থাৎ ১৫২০ সালের মার্চ মাসে ফ্রান্সিসকো দ্য এগুইয়া নামের এক ব্যক্তি, যিনি গুটিবসন্তের বাহক ছিলেন, তিনি মেক্সিকোতে যান। তখন মধ্য-আমেরিকার দেশগুলোতে কোনো ট্রেন ছিল না, বাস ছিল না, এমনকি যানবাহন হিসেবে গাধাও ছিল না। তারপরও গুটিবসন্ত গোটা মধ্য-আমেরিকায় মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছিল। প্রাণহানি হয়েছিল মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ মানুষের।

এরপর ১৯১৮ সালে এল ‘ফ্লু’। কয়েক মাসের মধ্যে পৃথিবীর দূরতম প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল এই ক্ষতিকর ভাইরাস। সংক্রমিত করেছিল অন্তত ৫০ কোটি মানুষকে, যা সেই সময়ের গোটা পৃথিবীর জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশের বেশি। প্রাণনাশ ঘটিয়েছিল ১ কোটি থেকে ১০ কোটি মানুষের। সংখ্যাটি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নিহত মানুষের চেয়ে বেশি।

আঠারো শতকের পরের শতাব্দীতে এসে বর্ধনশীল জনসংখ্যা ও উন্নত পরিবহনব্যবস্থার কারণে মানবজাতি আরও অরক্ষিত হয়ে গেছে মহামারির কাছে। মহামারির জীবাণুরা এখন মধ্যযুগের ফ্লোরেন্স শহরের চেয়ে টোকিও বা মেক্সিকো শহরের মতো অত্যাধুনিক শহরের মানুষদের খুব সহজেই আক্রান্ত করতে পারে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এই সময়ের বৈশ্বিক পরিবহনব্যবস্থা ১৯১৮ সালের তুলনায় অনেক উন্নত এবং দ্রুততর। ফলে একটি ভাইরাস ২৪ ঘণ্টার কম সময়ের মধ্যে প্যারিস থেকে টোকিও এবং মেক্সিকোতে পৌঁছে যেতে পারে। অতএব ধরে নেওয়া যায় যে আমরা সংক্রমিত রোগের নরকেই বসবাস করছি, যেখানে প্লেগের মতো মহামারি একের পর এক মানবজাতিকে আক্রমণ করতে পারে।

এরূপ সম্ভাবনার পরও মহামারির প্রভাব ও প্রকোপ নাটকীয়ভাবে কমে গেছে বলতে হবে। এইডস কিংবা ইবোলার মতো ভয়ংকর রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে বটে, তবে ইতিহাসের অন্য যেকোনো মহামারির তুলনায় একবিংশ শতাব্দীতে এসে এসব ভাইরাস-সংক্রান্ত মহামারি অনেক কমসংখ্যক মানুষের প্রাণহানি ঘটাতে পেরেছে। এর পেছনে কারণ কী থাকতে পারে? কারণ হচ্ছে জীবাণুর বিরুদ্ধে মানুষের মূল প্রতিরক্ষাটা হয়ে উঠেছে তথ্য বিনিময়—পৃথক থাকা নয়। মহামারির বিরুদ্ধে মানবজাতি তাদের যুদ্ধজয় অব্যাহত রেখেছে, এর কারণ, জীবাণু গবেষক ও চিকিৎসকেরা মহামারি ভাইরাসের অমিত শক্তির ওপর নির্ভর না করে নির্ভর করেছেন তথ্য–উপাত্ত ও বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের ওপর।

গত শতাব্দীর বিজ্ঞানী, গবেষক, চিকিৎসক ও নার্সরা মিলে সারা পৃথিবী থেকে মহামারির বিভিন্ন তথ্য–উপাত্ত সংগ্রহ করেছেন এবং তা ব্যাখ্যা–বিশ্লেষণের মাধ্যমে বুঝতে পেরেছেন এই সব মহামারির কার্যকারণ প্রক্রিয়া। এসব থেকেই মানুষ মহামারি মোকাবিলার কৌশল রপ্ত করেছে, যার ফলে মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যেই করোনাভাইরাস সম্পর্কে মানুষ জানতে পেরেছে। শুধু তা–ই নয়, বিজ্ঞানীরা এই নতুন ভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্স আবিষ্কার করতে পেরেছে এবং ভাইরাস আক্রান্ত মানুষকে শনাক্ত করার পরীক্ষা-নিরীক্ষাও রপ্ত করে ফেলেছে।

অতএব ধারণা করা যায়, এর প্রতিষেধক আবিষ্কার, অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার, স্বাস্থ্যবিধি এবং চিকিৎসাব্যবস্থার উৎকর্ষের ফলে মানবজাতি এই অদৃশ্য ঘাতক জীবাণুর বিরুদ্ধে জয়লাভ করতে পেরেছে। ১৯৬৭ সালে গুটিবসন্ত প্রায় ১ কোটি ৫০ লাখ মানুষকে আক্রমণ করেছিল, যার মধ্যে মৃত্যু হয়েছিল ২০ লাখ মানুষের। এর পরের দশকেই গুটিবসন্তের টিকা আবিষ্কৃত হয়। ফলে ১৯৭৯ সালেই বিশ্বস্বাস্খ্য সংস্থা বিশ্বব্যাপী গুটিবসন্ত নির্মূল হওয়ার ঘোষণা দিতে সক্ষম হয়।

ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে আমরা এখন ভাবতে পারি, করোনা মহামারি আমাদের কী শিক্ষা দিল। প্রথম শিক্ষা, সীমান্ত চিরতরে বন্ধ করে দিয়ে আপনি আপনাকে সুরক্ষিত রাখতে পারবেন না। আপনি যদি ভাবেন বৈশ্বিক যোগাযোগ কমিয়ে দিয়ে ১৩৪৮ সালের ইংল্যান্ডের মতো কিছু করবেন, তাতে মনে হয় না কোনো কাজ হবে। নিজেকে পৃথক করতে চাইলে মধ্যযুগীয় পন্থা অবলম্বন করে কোনো লাভ হবে না। আপনাকে যেতে হবে প্রস্তরযুগে। কিন্তু সেটা কি আদৌ সম্ভব?

দ্বিতীয় শিক্ষা হচ্ছে, বৈশ্বিক সাহায্য সহযোগিতা ও পারস্পরিক তথ্য আদান–প্রদানের মাধ্যমে প্রকৃত সুরক্ষা অর্জন করা। এখন কোনো দেশ যদি মহামারিতে আক্রান্ত হয়, তবে সেই দেশের উচিত অন্য দেশগুলোকে বিষয়টি জানানো। অন্য দেশগুলোরও উচিত হবে ভু্ক্তভোগী দেশের তথ্য আমলে নিয়ে এবং দেশটিকে অচ্ছুৎ বা পৃথক না রেখে তার দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া, আজ চীন যেমন সারা পৃথিবীর সঙ্গে করোনাভাইরাসজনিত তাদের গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা বিনিময় করতে পারে। এ জন্য প্রয়োজন পৃথিবীর সব দেশের সৌহার্দ্যপূর্ণ মনোভাব।

মনে রাখতে হবে, মানবজাতি শুধু করোনাভাইরাসেই আক্রান্ত নয়, তারা আজ পারস্পরিক অবিশ্বাসেও আক্রান্ত। কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না। এই মহামারির বিরুদ্ধে জয়লাভ করতে হলে মানুষের উচিত বৈজ্ঞানিক তথ্য উপাত্তকে বিশ্বাস করা। নাগরিকদের উচিত, সরকার ও কর্তৃপক্ষকে বিশ্বাস করা। কয়েক বছর ধরেই আমরা লক্ষ করছি, বিশ্বের দায়িত্বজ্ঞানহীন রাজনীতিবিদেরা বিজ্ঞানের উৎকর্ষ ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার গুরুত্বকে হেয় করে যাচ্ছেন। যার ফলে কোনো সুদক্ষ নেতৃত্ব ছাড়াই আমরা এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছি। অথচ তারাই পারতেন গোটা বিশ্বকে সংগঠিত করতে এবং অর্থায়ন করতে।

বর্তমান সময়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আতঙ্ক, অবিশ্বাস ও বিচ্ছিন্নতার নীতি। কিন্তু প্রকৃত সত্য হচ্ছে এই, বিশ্বাস ও পারস্পরিক সহযোগিতা ছাড়া আমরা করোনাভাইরাসের ভয়াহতা থামাতে পারব না। আমাদের মনে রাখতে হবে, ক্রান্তিকাল মানেই একটা সুযোগ। আশা করি করোনা মহামারির মধ্য দিয়েই মানব সম্প্রদায় বৈশ্বিক অনৈক্যের বিপদগুলো বুঝতে সক্ষম হবে। উদাহরণের স্বার্থে বলি, এই মহামারি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সামনে এক বিরাট সুযোগ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে তার পুরনো ভাবমূর্তি ও জনপ্রিয়তা পুনরুদ্ধারের জন্য। এ সময় ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য দেশগুলো যদি অহেতুক বাগাড়ম্বর না করে করোনা আক্রান্ত দেশগুলোকে আর্থিক সাহায্য ও চিকিৎসা সরঞ্জাম দিয়ে সহায়তা করে, তাহলে ইউরাপীয় আদর্শ আবারও জয়ী হবে।

আর এই মহামারি যদি অনৈক্য ও অবিশ্বাসের মধ্য দিয়ে যায়, তাহলে ভাইরাসেরই জয় হবে। যদি তা না হয়, অর্থাৎ বিশ্ব যদি এই মহাদুর্যোগের কালে সহযোগিতার হাত ধরে অগ্রসর হয়, তাহলে শুধু করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধেই নয়, বরং ভবিষ্যতের সব জীবাণুর বিরুদ্ধেই জয়ী হবে।

ইয়োভাল নোয়াহ হারারি

ইসরায়েলের হিব্রু ইউনিভার্সিটি অব জেরুজালেমের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক। হোমো ডেয়াস: ব্রিফ হিস্ট্রি অব টুমরো, স্যাপিয়েন্স: ব্রিফ হিস্ট্রি অব হিউম্যানকাইন্ড ও টোয়েন্টি ফার্স্ট লেসন ফর দ্য টোয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি বইগুলো লিখে বিশ্বব্যাপী খ্যাতি কুড়িয়েছেন তিনি। তাঁকে এই সময়ের জনপ্রিয় প্রাবন্ধিক ও গুরুত্বপূর্ণ চিন্তক হিসেবেও বিবেচনা করা হয়।

যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত টাইম সাময়িকীতে ১৫ মার্চ ছাপা হয়েছে

পুঁজিবাদের কলাকৌশল কাজে লাগিয়ে কমিউনিজমের প্রতিষ্ঠা

স্লাভোই জিজেক

আমি একটু অসুস্থ। সারাক্ষণই ‘হ্যাঁচ্চো..হ্যাঁচ্চো’ করছি আর নাক টানছি। যেসব লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, তাতে মনে হতে পারে আমি ভাইরাসে আক্রান্ত। তবে আশা করি, সেই ভাইরাস করোনাভাইরাস নয়। কারণ প্রায় এক বছর ধরেই আমার মধ্যে এসব লক্ষণ ও উপসর্গ দেখা যাচ্ছে। সে যাহোক, নিজের কথা রাখি। এই মুহূর্তে সারা ইউরোপ একটা ঝড়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই ঝড় দেখে আমার মনে পড়ছে জর্জ ক্লুনির সেই চলচ্চিত্রের কথা, যার নাম দ্য পারফেক্ট স্ট্রোম। 

আপনি নিশ্চয় জানেন, প্রকৃত ঝড়ের সংজ্ঞা কী। যখন টর্নেডোর মতো ঝড় প্রকৃতিতে আঘাত হানে, তখন তার প্রভাব বহুগুণে বিস্তৃত হয় এবং চারপাশ লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। ইউরোপ এখন এ ধরনের সত্যিকারের ঝড়ের কবলে পড়েছে। আর এই ঝড়ের নাম ‘করোনাভাইরাস’। এখানে আসলে কী ঘটছে, আমি তার সবকিছু জানতে পারি না। আমি শুধু শুনতে পাই, আতঙ্কিত হবেন না, আতঙ্ক ছড়াবেন না। এটা আসলে প্রকৃত বাস্তবতাকে অস্বীকার করার একটি কৌশল। এতে অবশ্য প্রকৃত ঝড় থামে না।

আমি মনে করি, ইউরোপ এই ঝড়ে ভয়াবহ রকমের দুর্বল হয়ে পড়েছে। এতটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে যে সম্মিলিতভাবেও সেই দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠা কঠিন হয়ে পড়বে। একই সঙ্গে আমি মনে করি, করোনাভাইরাস বিশ্বের বুকে ‘কমিউনিজম’ প্রতিষ্ঠার একটা সুযোগ হিসেবে এসেছে। অবশ্যই আমি সেই প্রাক্‌আমলের সমাজতন্ত্রের কথা বলছি না। আমি আসলে সেই সমাজতন্ত্রের কথা বলছি, যেটা বলছে স্বয়ং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। তারা বলছে, এই মুহূর্তে পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়াতে হবে। যেসব দেশে মাস্কের সংকট রয়েছে, অন্যান্য চিকিৎসা সরঞ্জামের অপ্রতুলতা রয়েছে, সেসব দেশে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, এটা একটা ভয়ংকর দুর্যোগের কাল। আমাদের উচিত এই সময়কে যুদ্ধের সময় হিসেবে বিবেচনা করা। ইউরোপে সত্যিকার অর্থেই এখন যুদ্ধাবস্থা চলছে।

প্রশ্ন হচ্ছে, এ অবস্থায় পুঁজিবাদের ভালো দিক ধরে রাখা সম্ভব কি না? আমার মনে হয়, একটি সমন্বিত রাষ্ট্রব্যবস্থার মাধ্যমে এটা সম্ভব। শুধু করোনাভাইরাসের জন্যই নয়, বরং অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও সংকটের কালেও এই সমন্বিত রাষ্ট্রব্যবস্থা দরকার।

এটা গেল রাজনীতির এক দিক। আটলান্টিকের অন্য দিকের রাজনীতিতে কী চলছে? গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এই বার্তাই দিয়েছে যে বার্নি স্যান্ডার্সের চেয়ে ট্রাম্পই উত্তম। আমি লক্ষ করেছি, এটি ভোটপ্রদানজনিত ব্যবস্থার সমস্যা। গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠায়ন বলছে, বার্নি স্যান্ডার্স অতি উগ্র। তাহলে ট্রাম্প কীভাবে নির্বাচিত হন? এর অর্থ হচ্ছে, তুমি যদি নির্বাচিত হতে চাও, তবে নিরাপদে খেলো ও মধ্যপন্থা অবলম্বন করো। ভুলে গেলে চলবে না, যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির ইতিহাসে সমাজতান্ত্রিক লড়াই সংগ্রামের একটি দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। 

ডেমোক্রেটিক পার্টি ও রিপাবলিকান পার্টি ক্রমশ ‘পার্থক্যহীন’ হয়ে উঠছে। অর্থাৎ দুটি দল মুদ্রার এপিঠ–ওপিঠ। কোনো পার্থক্য নেই। এটাই গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকরণ, যার অর্থ ট্রাম্প কিংবা স্যান্ডার্স—যে–ই আসুক, অবস্থার পরিবর্তন হবে না। আমাকে যদি বলা হয়, এ সময়ের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক বিড়ম্বনা কী? আমি বলব, এটিই সবচেয়ে বড় বিড়ম্বনা।

যাহোক, আবার একটু ইউরোপে নজর দিই। ইউরোপে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি দরকার সংহতি। সাহায্য সহযোগিতার জন্য রাশিয়া ছুটছে এক দিকে, তুরস্ক ছুটছে আরেক দিকে। একেই বলে সমন্বিত রাষ্ট্রব্যবস্থা। করোনাভাইরাস সমগ্র ইউরোপকে এখন যে দুর্যোগের মধ্যে ফেলে দিয়েছে, সেই দুর্যোগ থেকে উঠে দাঁড়াতে সমন্বিত রাষ্ট্রব্যবস্থা ছাড়া উপায় নেই।

তার মানে কি পুঁজিবাদ থেকে সরে যাব? অবশ্যই আমরা পুঁজিবাদ থেকে সরে যাব না। তবে আমাদের উচিত পুঁজিবাদকে একটু ভিন্নভাবে মোকাবিলা করা। কীভাবে সেটা? পুঁজিবাদের কিছু ইতিবাচক কলা-কৌশল রয়েছে, সেসব কলা-কৌশলের সঙ্গে সমাজতন্ত্রকে সমন্বয় করে সমন্বিত রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। আমরা স্বীকার করি আর না করি, ট্রাম্পের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে উদারকেন্দ্রিক রাজনীতির মৃত্যু ঘটেছে। ট্রাম্প একজন উত্তরাধুনিক প্রেসিডেন্ট। তার কাছ থেকেও আমাদের শিক্ষণীয় রয়েছে।

আগের কথায় ফিরে যাই, ইউরোপসহ সমগ্র বিশ্ব যে ঝড়ের কবলে পড়েছে, সেই ঝড় বড় রকমের অর্থনৈতিক বিপর্যয় ডেকে আনবে। বৈশ্বিক রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ হবে। তুরস্ক আর রাশিয়া মিলে এমন এক মেরু তৈরি হবে, যারা তেল ও শরণার্থী (করোনাভাইরাসের কারণে অনেক শরণার্থী তৈরি হবে) নিয়ে ইউরোপকে ব্ল্যাকমেইল করবে। কাজেই এই সব সংকট ও সমস্যা মোকাবিলার একটাই উপায় হচ্ছে, পুঁজিবাদের কলাকৌশল কাজে লাগিয়ে কমিউনিজম প্রতিষ্ঠা করা।