রবীন্দ্রনাথের কলকাতা কলকাতার রবীন্দ্রনাথ

জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির প্রবেশপথ
জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির প্রবেশপথ

১০ সদর স্ট্রিট: রবীন্দ্রনাথের কলকাতা নামের বইটি আমাদের ভ্রমণসাহিত্যে, সত্যিকার অর্থেই, এক উজ্জ্বলতম সংযোজন। কলকাতা মহানরীকে নিয়ে বাংলাদেশের কোনো লেখক এর আগে এত বিস্তারিতভাবে কিছু লিখেছেন বলে আমার জানা নেই। মোট ১৩টি অধ্যায়ে বিভক্ত এ বইয়ে প্রায় অনুপুঙ্খভাবে কলকাতা মহানগরীকে তুলে ধরা হয়েছে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে। ভূমিকা মারফত লেখক শাকুর মজিদ জানাচ্ছেন, ‘১৯৯০ থেকে ২০১৫—এই ২৫ বছরে ২৫ বারের বেশি যাওয়া-আসা হয়েছে কলকাতায়। দেশের বাইরে একক কোনো শহর হিসেবে এই কলকাতাতেই আমার সবচেয়ে বেশি যাওয়া-আসা। কলকাতাকে আমার বিদেশি শহর মনে হয় না, আবার নিজের শহরও না। তারপরও একধরনের ভালো লাগা থেকে আমি সুযোগ পেলেই কলকাতা ঘুরে আসি।’ এই ভালো লাগা থেকে কলকাতায় বারংবার যাওয়া ও তাকে দর্শন বা পর্যবেক্ষণেরই ফসল এই বই।

১০ সদর স্ট্রিট: রবীন্দ্রনাথের কলকাতা শাকুর মজিদ
১০ সদর স্ট্রিট: রবীন্দ্রনাথের কলকাতা শাকুর মজিদ
১০ সদর স্ট্রিট: রবীন্দ্রনাথের কলকাতা শাকুর মজিদ
প্রচ্ছদ: অশোক কর্মকার
প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা
জানুয়ারি ২০১৬
২৭২ পৃষ্ঠা
দাম: ৪৫০ টাকা।

পাঠক বইটি পড়া শুরু করতে গিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেন, এর নাম ১০ সদর স্ট্রিট: রবীন্দ্রনাথের কলকাতা কেন? লেখক জানাচ্ছেন, ‘খুব সচেতনভাবে দেখলে দেখা যায়, কলকাতায় রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষদের অভিবাসন আর ব্রিটিশ বেনিয়াদের অভিবাসন প্রায় কাছাকাছি সময়েই হয়েছিল।’ ফলে, আমরা দেখি রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষ এবং রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত যত স্থাপনা ও স্থান আছে, সে সবকিছু দর্শনের বর্ণনা এ বইয়ে যেমন মুখ্য হয়ে উঠেছে, তেমনি কলকাতার দর্শনীয় বা ঐতিহাসিক স্থানগুলোর বিবরণও অকপটে তুলে ধরেছেন তিনি। তবে শাকুর মুখ্যত তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন রবীন্দ্রনাথের কলকাতাকে। সে কথা বলতে গিয়ে তিনি আবারও জানাচ্ছেন, ‘কলকাতাকে বহুবার বহু নামে ডাকা হয়েছে, কিন্তু এর মধ্যেই আমি খুঁজে পাই, এটা আসলে সিটি অব প্যালেস বা সিটি অব জয় আর নেই, কলকাতা আসলে এখন “সিটি অব টেগোর”। আর এই ঠাকুর পরিবার বেড়ে উঠেছে কলকাতার বয়সের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। একসময় আমি এও আবিষ্কার করি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গভীর সৃজনশীল মনের ভ্রূণ সঞ্চারে ও তার বিকাশে আছে প্রিয় সদর স্ট্রিটের ১০ নম্বর বাড়ি। এখান থেকেই ১৭ বছরের এক কিশোরের “নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ” হয়েছিল আর সেই থেকেই গড়ে ওঠা শুরু হয় এই কলকাতার, যা এখন রবীন্দ্রনাথের নগর।’
প্রথম অধ্যায় ‘ঠাকুরের গ্রাম’-এ তুলে ধরা হয়েছে রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষদের সংগ্রাম ও আত্মপ্রতিষ্ঠার কথা, ঠাকুরবাটী কী করে রবীন্দ্রভারতী হলো, বাদ যায়নি সে কথাও। তুলে ধরতে কসুর করেননি ঠাকুরবাড়ির চিত্রশালার বিবরণও। এসেছে রবীন্দ্রনাথের পিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুর ও পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের জীবনকথাও, এমনকি বাদ যায়নি ঠাকুরবাড়ির আঁতুড়ঘরের মনোজ্ঞ বর্ণনাও। শাকুর সরেজমিনে শুধু দেখেননি, ছবি তুলেছেন রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত নানা স্থানের। পাশাপাশি আছে ঠাকুরদের সেই সব স্মৃতিসিক্ত আবাসস্থলের কথাও, যেগুলো দর্শন করতে গিয়ে রীতিমতো গভীর হতাশায় আক্রান্ত হয়েছেন তিনি। কেননা, এসব আবাসস্থলের অনেকগুলোই চূড়ান্ত অবহেলার শিকার। ‘হায় টেগোর ক্যাসেল’ ও ‘জোড়াসাঁকোর রাজবাড়ি: রাজা নেই, ফকির আছে’ শিরোনামের উপ-অধ্যায় দুটি থেকেই এর স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়।
রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত নিদর্শন, স্থাপনা বা স্থানগুলোর পাশাপাশি পাঠক যখন ‘কলকাতার ঠাকুর’, ‘ঠাকুরের গ্রন্থনগরী’, ‘নাটকপাড়ার ঠাকুর’, ‘গঙ্গাপাড়ের খাবার’, ‘ঠাকুরের সিনেমা’, ‘ঠাকুরবাড়ির গান’, ‘কলকাতা-দর্শন’ এবং পরিশেষে ‘১০ সদর স্ট্রিট: চারুলতার নষ্টনীড়’ নামের অধ্যায়ের পর অধ্যায়গুলো পড়বেন, তাঁদের মনে সমভাবে আনন্দ-বেদনার সঞ্চার হবে। তাঁরা জানবেন এমন সব তথ্য, এত দিন যা অনেকের কাছেই অজানা ছিল।