আপা তাকে রজনীগন্ধার একটা তোড়া বানাতে বলে ফাহিমের দিকে তাকাল, ‘কি, ভাবির জন্যই তো, নাকি অন্য কেউ আছে?’ চোখেমুখে মিষ্টি হাসি।
‘অন্য কেউ তো কতই আছে, আপা!’ হাসিমুখ ফাহিমেরও, ‘তবে ফুল আপনার ভাবির জন্যই। আপনিও নিশ্চয়ই... ?’
‘হ্যাঁ, অদ্ভুত মানুষ, রজনীগন্ধা ছাড়া কিছুই পছন্দ করে না।’
‘আমিও তাইলে রজনীগন্ধাই নেব, গোলাপের যা দাম!’
‘আরে না না, ভ্যালেন্টাইন কি দামের পরোয়া করে? গোলাপই নেন।’ বলে আপা নিজেই লাগল ফুল বাছতে।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তার আন্তরিকতা দেখতে লাগল ফাহিম। কত যে বাছবিচার! এটা দেখে সেটা রেখে লাল, হলুদ, সাদা কিছু গোলাপ দিল সে ছেলেটার হাতে।
দাম মিটিয়ে একসঙ্গেই বেরোল দুজন। রিকশা নেবে, কিন্তু আপা হাঁটছে দেখে ফাহিমও চালাল পা। মোড় ঘুরতেই মিষ্টান্ন ভান্ডার। মেয়ের জন্য ল্যাংচা দিতে বলল আপা, আর রাজভোগ। ফাহিম নেবে প্যারা সন্দেশ আর হাঁড়িভাঙা, মা-বউয়ের পছন্দ। সেটা নেই। কিছুই তাই নিল না ও। বের হয়ে আপাই অবশ্য রাজভোগের প্যাকেটটা ধরিয়ে দিল ওকে, ‘নেন, আপনাদের জন্যই নিলাম।’
অপ্রস্তুত ফাহিম ‘নেব না, নেব না’ করল খানেক। ভেতরে গিয়ে পাল্টা মিষ্টি কিনবে কি না, ভাবল। কিন্তু আপার রিকশা চলে গেল দ্রুত। তাকে যে বসন্তের শুভেচ্ছা জানাবে, খচখচানির চোটে সেটাও গেল ভুলে।
বাসায় ঢুকতেই দৌড়ে এল বাচ্চাটা। আদর করল। তাকে দিল চকলেট আর মাকে ওষুধ। ফ্রিজে রাখল মিষ্টির প্যাকেট। ফুল নিয়ে তারপর গেল বীথির কাছে।
ঘর অন্ধকার। মাথাব্যথা, অফিস থেকে ফিরেই শুয়ে পড়েছে। ফুলের তোড়াটা পাশে রেখে তাই ও গেল ফ্রেশ হতে। বের হতেই দেখে উঠে এসেছে বউ। হাতে ফুল, চোখে প্রশ্ন, ‘কে দিল এত গোলাপ তোমাকে?’
শুনতেই মুখটা নিভে গেল ফাহিমের। ভারী কিছু একটা বলতে গিয়েও সামলে নিল। হাসি ফুটিয়ে বলল, ‘দোকানদার ছাড়া আর কে দেবে?’
‘হুঁ, ঢং কোরো না, আমার জন্য তো আর কেনো নাই। কোন আপা দিছে, তা–ই বলো।’
ফাহিম ততক্ষণে বারান্দায়, তোয়ালে নাড়ছে। কোনো উত্তর করল না।
মায়ের ঘরে দাদি-নাতির চকলেট–যুদ্ধ, কিচিরমিচির শোনা যাচ্ছে। দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে বীথি এল বারান্দার আলো-আঁধারিতে, ‘আমার জন্যই এনেছ! থ্যাংক ইউ! আমি ভাবলাম, কে না কে দিয়েছে, সেটাই আমাকে দিলে।’
কপালে তার আলতো আঙুলের টোকা দিয়ে ফাহিম বলল, ‘হ্যাঁ, যে যেমন, সে তো তেমনই ভাববে!’
‘মাইর খাবা কিন্তু, আমি কেমন শুনি...’ বলে তাকে তেড়ে আসতে দেখেই ফাহিম পালিয়ে এল বসার ঘরে।
ডিনারের ডাক পড়ল যখন, সে তখন ফেসবুকে।
‘বিবাহিত পুরুষের আবার কিসের ভ্যালেন্টাইন, কিসেরই–বা পয়লা ফাল্গুন! সুন্দরবন দিবসের শুভেচ্ছা সবাইকে।’ তারপর লিখে দিল সদ্য ঘটে যাওয়া ভ্যালেন্টাইন খুনসুটি তাদের। কিছুক্ষণ আগে এসে যে বউ তার হাতে টাইটানের একটা বক্স তুলে দিয়েছে, সেটাও লিখল। কিন্তু পোস্ট করার আগমুহূর্তে ঘড়ির ব্যাপারটায় ব্যাকস্পেস পড়ল, আর শেষে পড়ল কান্নার ইমো। তাতেও কি মন ওঠে? লেখার ভেতর আরও খানিক রং মেশাল, সং মাখাল, সঙ্গে তাদের পুরোনো একটা লালে লাল ছবি।
খাওয়া শেষে উঠতেই দেখে কমেন্ট বক্সে ঝড়। ওয়াও রিঅ্যাক্ট দিয়ে বীথি লিখেছে, ‘পয়েন্ট অব ইনফরমেশন: বিবাহিত পুরুষ শুধু নয়, নারীরও একই দুরবস্থা!’ ব্র্যাকেটে লেখা, ‘এটা তো অর্ধেক, বাকিটুকু লেখেননি কেন! হাঁড়ি ভাঙব নাকি?’ সেখানে একটা হা হা রিয়্যাক্ট দিতেই ফাহিমের নজর গেল জুঁই আপার দিকে। কেয়ার রিঅ্যাক্ট তার, সঙ্গে কমেন্ট, ‘আহা রে!’
উত্তরে কী লেখা যায় ভাবছে, এমন সময় পিচ্চির কান্না, ছুটতে হলো।
পরের দিন লাঞ্চের সময় আপার সঙ্গে দেখা। প্রসঙ্গ টেনে বলল, ‘ভাবি তবু ভালো, মিষ্টির প্যাকেট নিয়া ঢুকছি দেইখা আপনার ভাইয়া বলছে, প্রমোশন হইল, নাকি বোনাস পাইছ!’
‘উনি দেখছি আরও সরেস, আপা!’
‘সরেস না, বলেন স্বৈরশাসক।’ হেসে বলল আপা, ‘আমি যতই বলি শুভেচ্ছা জানানোর জন্যই সব, ততই সে বলে, ফুল দিয়ে কখনো বাড়তি বেতন লুকানো যায় না!’
শুনেই ফাহিম এডিট করল পোস্ট। ‘পুরুষ হোক, নারী হোক; বিবাহিত মানুষের আবার ভ্যালেন্টাইন কী? স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবসের শুভেচ্ছা সবাইকে।’
দেখে আপা বলল, ‘মজার মানুষ তো আপনি!’
২.
পরের বছর ফুল কিনতে গিয়ে আবার দেখা। দুজন মিলেই কেনাকাটা করল ওরা। তোড়ার বাইরে দুটো বড় গোলাপও নিল ফাহিম, আপাকে দেবে। নিয়েই কাটল জিব—এইটুকু পরিচয়ের কাউকে কি গোলাপ দেওয়া যায়, তা–ও আবার এমন একটা দিনে! মনে মনে কান ধরে সেগুলো সে গুঁজে নিল বীথির তোড়ায়।
৩.
এ বছর আপার বদলি হয়ে গেছে, দেখা তো পরের কথা, কথাও হয়নি সারা বছর। কিন্তু ভ্যালেন্টাইনের দিন সন্ধ্যায় তিনি ঠিকই হাজির। বীথির জন্য গোলাপ আর সন্দেশ কিনে এনেছে। দিতে দিতে বলল, ‘নাও, তোমাদের সুন্দরবন দিবসের শুভেচ্ছা।’
ভাইয়ার জন্য রজনীগন্ধা আর ল্যাংচা দিয়ে ফাহিম বলল, ‘স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবসের শুভেচ্ছা আপনাদের।’
তার আগে দুটো অতিরিক্ত গোলাপ কিনে অবশ্য এবারও নিজের তোড়ায়ই গুঁজে নিয়েছে সে।