২০২৫ সালের নোবেল সাহিত্য পুরস্কার ঘোষণার পরপরই লাসলো ক্রাসনাহোরকাইয়ের এই সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয় নোবেল পুরস্কারের দাপ্তরিক ওয়েবসাইটে। সাক্ষাৎকারটি নেওয়া হয় টেলিফোনে। আকস্মিক এই আলাপচারিতায় আত্মমগ্ন লেখক তাঁর জীবনের অতর্কিত পালাবদলের মুহূর্তকে অনন্য স্বতঃস্ফূর্ততায় প্রকাশ করেছেন।
সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ‘দ্য নোবেল প্রাইজ’ প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট কনটেন্ট ব্যবস্থাপক ইয়েনি রিডিন। টেলিফোনের অপর পাশ থেকে লাসলো ক্রাসনাহোরকাই যখন কথা বলছিলেন, মনে হচ্ছিল এক অবিমিশ্র বিস্ময়ে ভরা তাঁর কণ্ঠস্বর। থেমে থেমে শোনা যাচ্ছিল মৃদু ও হতচকিত হাসির স্পন্দন; আর সঙ্গে দায়িত্ববোধের গাম্ভীর্য। তিনি বলেন, ‘মহান সব লেখক ও কবির সঙ্গে এককাতারে শামিল হতে পেরে আমি যারপরনাই গর্বিত।’
লাসলো ক্রাসনাহোরকাই সমকালীন সাহিত্যিকদের মধ্যে অন্যতম অন্ধকারমুখর কথাকার। তাঁর বাক্য দীর্ঘ কিন্তু সত্য আরও দীর্ঘ। তাঁর লেখায় পৃথিবীকে ক্রমেই ভেঙে পড়তে দেখা যায়। দুনিয়াবি এই কঠিন সময়ে বেঁচে থাকার জন্য তিনি কল্পনাশক্তিকে মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে দেখেন। কল্পনা না থাকলে মানুষ বাঁচে না। মরেও না। শুধুই অস্তিত্বশীল থাকে। এই নিষ্প্রাণ অস্তিত্বশীলতা, মৃত্যু আর বেঁচে থাকার মাঝখানে যে ছায়াপথ, সেখানেই তাঁর সাহিত্য রচিত হয়। তাঁর লেখা ও কথা বলার; দুই মাধ্যমের ভাষাই হাঙ্গেরীয়। যদিও এই ভাষায় বেশি লোকজন কথা বলে না; তবু তিনি বলেন, এই ভাষাই তাঁকে অপার শক্তি দেয়। কারণ, লেখালেখি তাঁর কাছে ব্যক্তিগত শ্বাসপ্রশ্বাসের মতো। বুকের গোপন কক্ষ। কেউ সেখানে ঢুকতে পারে না।
লাসলো ক্রাসনাহোরকাইকে এই পুরস্কার দিয়েছেন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সাহিত্যমণ্ডলী। আর তিনি প্রথমে মনে করেছেন ‘বিপর্যয়’!
ফলাফলের ভার কতটা প্রাণান্ত, কেবল লেখকেরাই জানেন। স্বীকৃতি মানে চাপ। স্বীকৃতি মানেই আবার নবযাত্রা। স্বীকৃতি মানেই নিজের ভাষায় ফিরে আসা; আরও গভীরে। আরও তিক্ততায়। আরও গভীরতম সত্যে।
এই সত্যের সকাশেই লাসলো ক্রাসনাহোরকাই আলাপ চালিয়ে গেছেন ইয়েনি রিডিনের সঙ্গে; উত্তেজনাবিহীন, শঙ্কিত। তাঁর আলাপে নেই কোনো বিজয়ীর উল্লাস। এখানে আছে অনন্ত ইহজাগতিক আর মনোজাগতিক সংগ্রাম।
ক্রাসনাহোরকাইয়ের স্বীকারোক্তি: তিক্ততাই তাঁকে সৃষ্টিশীলতার শক্তি দেয় এবং কল্পনাশক্তিই তাঁর বেঁচে থাকার পাথেয়। তিনি স্পষ্ট করেই বলেছেন, ‘কল্পনাশক্তি ছাড়া জীবনটা একদমই অন্য রকম। দুনিয়ার সবচেয়ে কঠিন সময়গুলোয় বই পড়াটাই কিন্তু আমাদের টিকে থাকার শক্তি দেয়।’
ক্রাসনাহোরকাইয়ের কথায় আমি শুধু কাহিনি নয়; খুঁজে পাই কাহিনির ভেতরকার অস্থিরতা। শুধু মানুষ নয়; খুঁজে পাই মানুষের ক্ষয়। ভাষার সূচনা শুধু নয়; খুঁজে পাই ভাষার সীমান্তরেখা। খুঁজে পাই এমন এক তটস্থ তটরেখা যা আমাদের সম্পূর্ণ ডুবতে দেয় না। বরং সটান রাখে যেন পৃথিবীতে যত অন্ধকারই আসুক না কেন; শব্দ আরও তীব্রতায় জ্বলে উঠবে। — অনুবাদক
হ্যালো?
ক্রাসনাহোরকাই: হ্যাঁ।
আমি ‘দ্য নোবেল প্রাইজ’ থেকে ইয়েনি রিডিন বলছি।
ক্রাসনাহোরকাই: হাই। বলুন।
আপনি কি লাসলো ক্রাসনাহোরকাই বলছেন?
ক্রাসনাহোরকাই: হ্যাঁ, বলছি।
প্রথমেই আপনাকে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার জন্য অভিনন্দন জানাচ্ছি।
ক্রাসনাহোরকাই: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। অসংখ্য ধন্যবাদ।
এই মুহূর্তে আপনার কেমন লাগছে?
ক্রাসনাহোরকাই: বিষয়টা বিপর্যয়ের চেয়ে বড় কিছু। স্যামুয়েল বেকেটের নোবেল পাওয়ার পরের প্রতিক্রিয়ার কথা ভাবছি এখন। মনে আছে সেই রিপোর্টের কথা? কোনো প্রশ্ন নেই, কোনো উত্তর নেই। মনে করতে পারছেন ওই বিখ্যাত বাক্য: ‘কী ভয়ংকর বিপর্যয়!’
যখন বেকেট জানলেন যে তিনি নোবেল পেয়েছেন, তাঁর মুখ থেকে প্রথমে এই বাক্যই বেরিয়েছিল, ‘কী ভয়ংকর বিপর্যয়!’ এ জন্য শুরুতেই আপনাকে বললাম, বিষয়টা বিপর্যয়ের চেয়ে বড়। একই সঙ্গে আনন্দ ও গর্বের। আমি খুবই আনন্দিত এবং খুবই গর্বিত, কারণ, মহান সব লেখক ও কবিদের সঙ্গে একই কাতারে শামিল হয়ে আমি সেই শক্তিই পাই, যে শক্তি আমাকে আমার নিজস্ব ভাষা অর্থাৎ হাঙ্গেরীয় ভাষায় সাহিত্য রচনার সাহস দিয়েছে। আমি সত্যিই খুব গর্বিত ও আনন্দিত; কারণ, আমি ক্ষুদ্র এই ভাষাকে সম্বল করে লিখতে পারছি।
প্রথমেই পাঠকদের ধন্যবাদ জানাই। আমি চাই সবাই যেন তাঁদের কল্পনাশক্তি ব্যবহারের সক্ষমতা ফিরে পাক। কারণ, কল্পনাশক্তি ছাড়া জীবনটা একদমই অন্য রকম। দুনিয়ার সবচেয়ে কঠিন সময়গুলোয় বই পড়াটাই কিন্তু আমাদের টিকে থাকার শক্তি দেয়।
আমি খুব ব্যথিত হই যখন পৃথিবীর বর্তমান অবস্থা নিয়ে ভাবি। এই ব্যথাই আমার সবচেয়ে গভীর প্রেরণা। সাহিত্যে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের যাঁরা, তাঁদের জন্যও এটা অনুপ্রেরণা হতে পারে। আগামী প্রজন্মের জন্য কিছু একটা রেখে যাওয়া, যাতে তারা কোনোভাবে এই সময়টাকে উতরাতে পারে।লাসলো ক্রাসনাহোরকাই
একদম ঠিক। আচ্ছা, আপনার আশপাশের দৃশ্যটা একটু বলুন তো শুনি? কোথায় আছেন এখন? পুরস্কার পাওয়ার খবরটি শোনার মুহূর্তটা কেমন ছিল, বলুন তো শুনি!
ক্রাসনাহোরকাই: আমি এক বন্ধুর অ্যাপার্টমেন্টে আছি। ওর শরীর ভালো না। ওকে দেখতেই এসেছি ফ্রাঙ্কফুর্ট আম মাইনে। আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না যে আমি নোবেলজয়ী, কিন্তু সত্যিই খুব খুশি লাগছে।
একদমই আশা করেননি?
ক্রাসনাহোরকাই: আমি পুরোপুরি বিস্মিত। এমন কিছু ভাবিনি।
আপনার সবচেয়ে বড় প্রেরণার উৎস সম্পর্কে আমাদের কিছু বলবেন?
ক্রাসনাহোরকাই: তিক্ততা। আমি খুব ব্যথিত হই যখন পৃথিবীর বর্তমান অবস্থা নিয়ে ভাবি। এই ব্যথাই আমার সবচেয়ে গভীর প্রেরণা। সাহিত্যে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের যাঁরা, তাঁদের জন্যও এটা অনুপ্রেরণা হতে পারে। আগামী প্রজন্মের জন্য কিছু একটা রেখে যাওয়া, যাতে তারা কোনোভাবে এই সময়টাকে উতরাতে পারে। কারণ এখন সময়টা খুবই, খুবই অন্ধকার-অধ্যুষিত। এই সময় বেঁচে থাকার জন্য আমাদের আগের তুলনায় আরও অনেক বেশি শক্তির প্রয়োজন।
যেমনটা বলছিলেন, এই যে অন্ধকার সময়, এখানে বেঁচে থাকার জন্য লেখালেখি কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
ক্রাসনাহোরকাই: লেখালেখি বিষয়টা খুবই ব্যক্তিগত আমার কাছে। আমি সাধারণত কখনোই বলি না, আমি কী লিখছি এবং খুব আপনজন যাঁরা; লেখক কবি, তাঁদেরও দেখাই না। আমি একটি বই লেখা শেষ করি, তারপর প্রকাশকের হাতে দিই এবং এরপর আরও কিছু সময় প্রয়োজন হয় আমার। তারপর একদিন আসে, আবার শুরু করি। আগেরটার চেয়ে আরও ভালো কিছু করার চেষ্টা নিয়ে নতুন বই লেখা শুরু করি।
যতদূর জানি, আপনি বিভিন্ন জায়গায় থাকেন। কেবল এক জায়গায় থাকেন না, তা-ই না?
ক্রাসনাহোরকাই: ঠিক তা-ই। আমি হাঙ্গেরিতে থাকি, বুদাপেস্টের কাছে, একটা পাহাড়ের চূড়ায়। আর আমি ত্রিয়েস্তেতেও থাকি, মাঝেমধ্যে ভিয়েনাতেও। এগুলো আসলে সাবেক অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল।
কীভাবে উদ্যাপন করতে চান এই মুহূর্তকে?
ক্রাসনাহোরকাই: আমি এখন, জার্মান ভাষায় যাকে বলে আনমেলদিয়াম্ট (নিবাস নিবন্ধনের দপ্তর), সেখানে যাচ্ছি। আমি আমার দ্বিতীয় ঠিকানাটা বদলেছি এবং আমি একজন প্রশাসকের কাছে যাব জার্মানির নতুন ডাকঠিকানাটা নিবন্ধন করতে।
এটাই ছিল আপনার আজকের পরিকল্পনা? এখনো কি ঠিক এটাই করবেন?
ক্রাসনাহোরকাই: আমি এসব চমৎকার খবরের কোনো প্রত্যাশাই করিনি, তাই পরিকল্পনা বদলানোর উপায় নেই। তবে হয়তো সন্ধ্যায় কিছু বন্ধুর সঙ্গে ফ্রাঙ্কফুর্টে ডিনার করব; পোর্ট ওয়াইন আর শ্যাম্পেইনসহযোগে।
বাহ, দারুণ! অনেক ধন্যবাদ। আপনার সঙ্গে কথা বলে খুব ভালো লাগল।
ক্রাসনাহোরকাই: আপনাকেও অসংখ্য ধন্যবাদ। খুবই আন্তরিক আপনি।
ধন্যবাদ। আরও একবার অভিনন্দন জানবেন।
ক্রাসনাহোরকাই: আবারও ধন্যবাদ। অসংখ্য ধন্যবাদ।
বিদায়।
ক্রাসনাহোরকাই: ধন্যবাদ। বিদায়।